প্রতিবেশী সাহিত্য
ফোরাহ ফারুখজাদ -এর কবিতা
(অনুবাদ : সাঈফ ফাতেউর রহমান )
কবি পরিচিতি : ফোরাহ ফারুখজাদ। প্রতিবাদী ইরানী মহিলা কবি (১৯৩৫- ১৯৬৭)। খ্যাতিমান নারীবাদী চিত্র পরিচালকও ছিলেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে। মাত্র ৩২ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ তিনি। তাঁর কবিতা স্পষ্টতই তখনকার ইরানের কবিতার ধারার থেকে ভিন্নতর আঙ্গিকের। মূল কবিতার ইংরেজি অনুবাদ থেকে মুক্ত ভাষান্তর।
পাপ
পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তিতে আমি পাপ করেছি একটি
প্রজ্জ্বলন্ত আর উষ্ণতায় ভরা ছিলো সে এক আলিঙ্গন।
বাহুলগ্নতায় পাপ করেছি আমি
উষ্ণতায় নিবিড় আর দৃঢ় সন্নিবদ্ধ ছিলো সেটি।
আঁধার আর নিঃশব্দ সেই জনহীনতায়
তার রহস্যময় চোখের দিকে দৃষ্টি ছিলো আমার।
তার ব্যাকুল দৃষ্টির আকুলতার মিনতির প্রত্যুত্তরে
হৃদয়ের ব্যাগ্রতার প্রবল কম্পমান ছিলো স্তন আমার।
সেই আঁধারময় জনহীন নীরবতায়
এলোমেলো অবিন্যস্ত বসেছিলাম আমি তার পাশে।
কামনা উগরে দিয়েছিলো তার অধর আমার অধরে
হৃদয়ের উন্মথিত প্রদাহ থেকে সংগোপনে গিয়েছিলাম আমি।
ভালোবাসার কথকতা বলেছিলাম আমি তার কানে ফিসফিসঃ
জীবন আমার, তোমাকেই চাই আমি,
আমি তোমাকেই চাই, আমার জীবনসঞ্চারি আলিঙ্গন আমার,
তোমাকে চাই আমি, একাগ্র প্রেমিক আমার।
ঝলকে উঠেছিলো কামনা আগুন তার চোখে;
পাত্রে নৃত্যময় হয়ে উঠেছিলো লালাভ মদিরা।
কোমল শয্যা, শরীর আমার
মত্ততায় সুখকম্পনে মগ্ন ছিলো তার বুকে।
পূর্ণানন্দে একটি পাপ করেছি আমি
কম্পনময়তায় হতবিহ্বলতায়
সেই আঁধারময় নির্জন নীরবতায়
হে ঈশ্বর, কে জানে কী করেছি আমি।
প্রেমসঙ্গীত
এই রাত তোমার স্বপ্নে একেবারে রঞ্জিত হয়ে আছে
তোমার সৌগন্ধ আমার শ্বাসযন্ত্রকে পূর্ণতায় ভরে দিয়েছে।
আমার দৃষ্টির জন্য তুমি বিপুল খাদ্যায়োজন
মোচন করে দাও আমার সকল সঙ্কট।
বারিধারা যেমন শুচিস্নান করায় পৃথিবীকে
আমার আত্মার সব কলুষ দূর হয় তেমনই তোমার ছোঁয়ায়।
আমার উত্তপ্ত দেহে তুমি অস্ত্র বাঁক বদলের
তীব্র আগুন আবার যেন তুমি আমার চোখের পাতায়।
ফসলী সম্ভার পূর্ণ তুমি গমের ক্ষেতের সবুজ তুল্যতায়
প্রাপ্ত ফসলের চেয়েও ফলনময় তুমি পূর্ণতায়।
উন্মোচিত করে দাও দরোজা তুমি সূর্য অভিমুখ
বিপরীতে বিদূরিত হয়ে যায় সন্দেহের কালো নেকাব।
তোমার উপস্থিতিতেই নির্ভয়
আনন্দাশ্রুর বেদনা কেবল রয়ে যায়
বিষণ্ণ হৃদঞ্চল আর আলোক সুপ্রচুর
জীবনের অযাচিত কলরোল পরিপূর্ণ অবসিত হলো?
আমার আবাস তোমার চকিত দৃষ্টিপাতে
সেটাতেই চিহ্নিত করেছে চোখ আমার ঠিকানা
ইতোপূর্বে কোন ছবিই ছিলোনা আয়ত্তে আমার
অথবা হতে পারে বিবেচনা করি না কিছু অন্যতর
ভালোবাসার বেদনাঘাত পীড়ন তীব্র গভীর
অকারণে প্রাপ্তিযোগ কারো নিরন্তর প্রদাহ সর্বৈবতায়
কৃষ্ণ দৃশ্যায়ন শিক্ষা যেন বিপরীতে মানুষের
ম্লানিমায় আচ্ছাদিত করে কাউকে বা পূঁতিময় কদর্য ক্লেদময়তায়
তথাপি প্রতারণা বিষের মাঝেও অন্বেষণ সোহাগ-প্রীতির
সুজন-সাথীর হাসির মাঝেও যেন কদর্যতার উপস্থিতি
লুটেরা তস্করদের মাঝে ঢেলে দেওয়া যেন সোনার মোহর
নিরাবেগ হারিয়ে যাওয়া বাজার এবং ভিড়ের মাঝেও
তোমার সাথে অবিচ্ছিন্ন সংলগ্ন হবে আত্মা আমার
সমাধি থেকে জাগ্রত করো আমাকে একসাথে
পক্ষল স্বর্ণময় তারকার মত এক
আগত অজানা কোন ভূমি হতে তুমি।
প্রদানের তীব্র অনল প্রশমিত করে দাও তুমি
আমার দেহকে পরিপ্লুত করো আলিঙ্গনের মূর্চ্ছনায়
সেই প্রবাহই তুমি যা সঞ্চারিত হয় শুষ্ক স্তনে আমার
তোমার পবিত্র জল সিঞ্চনে আমার ধমনী ও শয্যায়
আঁধার যেখানে আসে আহারের মত করে সেই পৃথিবীতে
অগ্রবর্তী হও তুমি ভালোবেসে প্রতি পদক্ষেপে
প্রবাহিত হয়ে যেতে থাকো তুমি আমার ত্বকের নিচে।
প্রবাহিত হও সেখানে তুমি রক্তের মত
আমার কেশের বেণী দগ্ধীভূত হয় তোমার সভাঁজ হাতে
কপোল রঞ্জিত হতে থাকে তীব্র চাহিদার তাড়নায়
আমার পরিচ্ছদের কাছে আগন্তুক তুমি এক
শরীরটা আমার বারান্দার কাছে লোক চেনাজানা
উজ্জ্বল সূর্য তুমি এক মারা যায় না যে কখনো
দখিণাকাশে উদিত হয় এমন কোন সূর্য যেন
প্রভাত অরুণোদয়ের আলোর মত সতেজ সারাক্ষণ
দীপ্তিময় ও সতেজ তুমি দর্শনে বসন্তের তুল্যতায়ও
ভালোবাসা ছাড়া আর নয় কোনকিছু, অহংকার এটা
ঝাড়বাতি এক, মৃত্যু যেন শব্দহীন আর আঁধারময়
আমার হৃদয় যখন প্রলুব্ধ হয় ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায়
আত্মত্যাগের অনুভবে পূর্ণতা পেয়ে যাই আমি
আমি আর থাকি না আমি, আমি থাকি না আমি আর
অহংকারের গৌরবে শূন্য মাত্রায় উত্থিত হয় জীবন আমার
অধর আমার তোমার পুরস্কারের রঙে রঞ্জিত হয়ে যায়
তোমার অধর আমার চোখের কাছে আরাধনা-ঘর
তোমার মন্থনাচারে আমার নিকটে গীতি প্রবল্যের বিপুলতা
দেহবল্লরীর বাঁক-বিভাই তো আমার পোষাক পরিচ্ছদ
ওহ! অঙ্কুরিত হতে হতে আমি ব্যাকুল হয়ে যাই
এবং পরিতৃপ্তির সহযোগে বেদনাও নিনাদিত হতে থাকে
ওহ! কীভাবে জাগরণের অভিলাষ পোষণ করি
এবং দীক্ষিত করি আমার অশ্রুসমুদয়
হতভাগ্য হৃদয় আমার এবং ধূপময় সুঘ্রাণ?
হার্প এবং বীণার ঝংকার নন্দিত হলো কী প্রার্থনালয়ে?
শূন্যতার অনুভব আর বিলোল উড্ডীন প্রহর?
গীতাবলী এ’সকল আর আর রাত-কাতরতা?
তোমার চোখের দৃষ্টিতে অলৌকিক নিদ্রা আহ্বানের গান
দোল দিয়ে যায় বিরতিবিহীনভাবে শিশুদের
অতীন্দ্রিয় বাতাসের প্রবাহ তোমার নিঃশ্বাসে
ধৌত করে দেয় আমার অপ্রতিভতার শিহরণ
নিদ্রার আবেশ লাভ করে আমার আগত প্রহর
গভীর গভীরতর হতে থাকে অভিভূত পৃথিবী আমার
উত্থিত করে দাও তুমি আমার ভেতরে প্রবল কামনা কবিতা
সহসা আগুনের শিখা রোপণ করো তুমি আমার ভেতরে
তীব্র বাসনা প্রাবল্য জ্বালাও আমার ভেতরে
কবিতা এভাবেই প্রজ্জ্বলমান হতে থাকে আমার ভেতর।
ঢেউ তুমি এক
ঢেউ তুমি এক
আমার কাছে;
কোথাও স্থিত হলে না তুমি!
এখানে কখনো ছিলে না, ওখানেও না!
আঁকড়ে ধরো তুমি,
টেনে নাও কাছে, অতঃপর সরে পড়ো দূরবর্তীতায়,
মারণ ঘাতক প্লেগের মত বিস্তৃত হয়ে যাও তুমি দ্রুত,
ভিন্নতর ভূমি অনুসন্ধানে ত্রস্ত ধাবমান, গন্তব্য অনির্ধারিত
তোমার।
প্রত্যক্ষগোচর তুমি-
অতি দূরবর্তীতা থেকেও,
পীড়িত দৃষ্টিতে আমার -
বিদ্রোহী দুরন্ত জোয়ার তুমি এক-
অন্তহীন মসৃণ চলন।
একগুঁয়ে তুমি, ধৈর্যহীন, অতঃপর অস্থিত পরিব্রাজী তুমি,
অভ্যন্তরে প্রশান্ত সুনিশ্চিত তুমি, বহিরঙ্গে ধৈর্যহারা
সহজেই।
আর জানা হয়ে গেছে এখন আমার, অনুশোচনার সমুদ্দুর, স্বদেশ
তোমার।
স্বীকার্য, অনিয়ন্ত্রিত জোয়ার আমি এক!
সদাসর্বদাই তাই চলমান
অসমাপ্য পিচ্ছিল পথে পরিক্রমণ।
কোন এক রাতে, তবে,
মুখোশাবৃত করব মুখ আমার
দূরাতিদূর সৈকত
আর জনমানবহীন বেলাভূমির
তৃষ্ণায় সৃজিত হবে যা।
আর পিঞ্জরাবদ্ধ করবো তোমাকে আমি-আমার শোষক বালুর মাঝে
তোমার জলযান-জনমভূমি হতে চিরতরে দূরবর্তীতায়।
কবিতার অপূর্ব ও রূপ ফুটে ওঠে কালিমাটি পত্রিকায়।
উত্তরমুছুন