কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

মোজাম্মেল হক




হা লং-এর গুহাপথে...



হা লং বে। উত্তর পশ্চিম ভিয়েতনাম এর এক নিসর্গ। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একে এনে দিয়েছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর থেকেই এখানে পর্যটকের আগ্রহ বাড়ছে। ২০১৮ সালে ৫৫ লক্ষ পর্যটক হা লং বে পরিদর্শনে গেছে, যার অর্ধেকেরও বেশি বিদেশী পর্যটক। হা লং বে আকর্ষণে কোয়াংনিন প্রদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে, বাড়ছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কর্মসংস্থান। সামগ্রিক অর্থে ভিয়েতনাম এর অর্থনীতিতে হা লং বে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

প্রায় ১৬০০এর বেশি ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে হা লং বে। কথিত আছে ভিনদেশী আক্রমণকারীদের হাত থেকে ভিয়েতনামীদের রক্ষায় ঈশ্বরের ইশারায় এক ড্রাগন পরিবার মর্ত্যে নেমে আসে। তাদের মুখনিসৃত থুথু-লালা মণি-মুক্তা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সাগরে। এই মণিমুক্তা থেকেই জেগে উঠে পাহাড়প্রমাণ দ্বীপ, যা সমুদ্রে আক্রমণকারীদের পথরোধ করে দাঁড়ায়। এভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আক্রমণকারীগণ ধ্বংস হয়ে যায়। শান্তি ফিরে আসে। শান্তিময় স্থানে যেখানে মা ড্রাগন অবতরণ করেছে তার নাম হয়েছে হা লং। ভিয়েতনামী শব্দহা লংএর অর্থ হলোভূমিতে নেমে আসা ড্রাগন


সম্প্রতি সুযোগ হয়েছিল হা লং বেতে বেড়াতে যাবার। আমাদের ১০ জনের গ্রুপ- ভিয়েতনাম এর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে গিয়েছিলাম এক শিখন সফরে। এই সফরসুচিতে হা লং বে পরিদর্শন অন্তর্ভূক্ত ছিলনা। সফরসূচি অনুযায়ী বাকনিন প্রদেশে স্থানীয় সরকার এর কাজ সম্পর্কে জেনে আমাদের হ্যানয় ফিরে যাবার কথা। ভিয়েতনাম এসে হা লং বে না দেখে ফিরে যেতে কারোই মন সায় দিচ্ছিল না। তাই সকলে মিলে ঠিক করলাম বাকনিন থেকে পরদিন সকালে হ্যানয়ে না ফিরে রাতেই হা লং চলে যাবার। যে কথা-সেই কাজ। এক ট্যুর কোম্পানি থেকে হা লং- হ্যানয় এর প্যাকেজ নিয়ে আমরা বাকনিন এর হোটেল ছেড়ে দিলাম। প্যাকেজে থাকলো ট্যুর কোম্পানির লাক্সারি বাসে হা লং যাত্রা, রাত্রি যাপন, পরদিন ক্রুজে করে হা লং বেতে ভেসে বেড়ানো এবং সন্ধ্যায় হ্যানয় ফিরে রাত্রি যাপন। সব মিলে জনপ্রতি খরচ ১৮০ ডলার। রুম শেয়ার করে থাকতে চাইলে মাত্র ১৩৫ ডলার।

সময়মতো ট্যুর কোম্পানির গাইড ভিনি এলো। আমরা হোটেল এর লবিতে অপেক্ষায় ছিলাম। তার সাথে কথা বলে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলাম। ভিনি একজন অভিজ্ঞ গাইড। পনের বছরেরও অধিক সময় তিনি গাইড হিসেবে কাজ করছেন। খুব সুন্দর ইংরেজি বলেন। গাড়িতে উঠেই আমাদের বুঝিয়ে দিলেন যাত্রাপথে আমরা কি কি দেখতে পাবো, কতক্ষণে পৌছাবো, রাতে কোথায় থাকবো, কোথায় খাবো ইত্যাদি। এছাড়া হা লং নিরাপত্তার বিষয়াদিও বুঝিয়ে দিলেন।



বাকনিন থেকে সড়কপথে ঘণ্টা সময় নিয়ে আমরা হা লং শহরে পৌছালাম। যটপট চেক-ইন হলো গোল্ডেন হা লং হোটেলে। এরপর ফ্রেশ হয়ে বাইরে যাবার তাড়া। সন্ধ্যার পর হা লং এর রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম আমরা। আলো ঝলমল শহরে রাস্তায় সারি সারি খাবার দোকান। কোথাও হচ্ছে লাইভ মিউজিক। তরুণেরা দল বেধে হল্লা করে ঢুকছে-বেরুচ্ছে। মজা করছে। ফুটপাতে প্রদর্শিত জীয়ল মাছ, শামুক-ঝিনুকসহ মজাদার সামুদ্রিক খাবারের ছড়াছড়ি। রেস্তোরার ভেতরে-বাইরে বসা নানা বয়সের, নানা বর্ণের পর্যটক। পছন্দসই খাবার বেছে খাচ্ছে।

আমাদের দলের কয়েকজন হালাল আর বাঙলা খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত। রেস্তোরায় ঢুকছে আর মেন্যু উল্টে-পাল্টে দেখে ফিরে আসছে। ভাষা সমস্যা দূর করতে খাবারের ছবিই ভরসা। নানা রেস্তোরায় উকি দিয়ে এক জায়গায় এসে থিতু হলাম। আমাদের দলের একজন সহকর্মী কিচেনে ঢুকে ভাত, শাক আর ডিম ভাজি করে দেবার মেন্যু বুঝিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়-খাবার মজাদার করতে এবং হালাল নিশ্চিত করতে কিচেনে দাঁড়িয়ে থেকে সব ব্যবস্থা করলেন। আমাদের বাঙালি রসনা হলো অল্প খরচে। তৃপ্তি করে খাবার খেয়ে কেনাকাটায় আর ঘুরা-ফেরায় অনেক রাত হলো। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।


পরদিন সকালে চেক-আউট হয়ে নাস্তা সেরে গাড়িতে উঠলাম। এবার যাত্রা সাগরপথে। আমাদের অপেক্ষায় ঘাটে দাঁড়ানো ক্রুজ। আমাদেরকে ক্রুজে উঠিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাদি সম্পর্কে জেনে নিলেন গাইড ভিনি। এরপর হা লং বে সবুজাভ জলে ভাসলো আমাদের ক্রুজ। ক্রুজে অন্য কোন যাত্রী নেই। পুরোটাই আমাদের দখলে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় শুধুই জলরাশি আর পাহাড়। চুনাপাথরের এই পাহাড়গুলো আসলে একেকটি দ্বীপ। মানুষের বসতিহীন এই দ্বীপগুলো বেশ সুরক্ষিত। আমাদের সঙ্গীরা ক্রুজের ছাদে উঠতে তৎপর হলো। ছাদে আরাম কেদারায় শুয়ে-বসে আর সেলফি তুলে আমাদের আনন্দযাত্রা শত শত দ্বীপকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো। চারপাশে দ্বীপের ছড়াছড়ি দেখে আমাদের আনন্দধ্বনি যখন চিৎকারে রূপ নিয়েছে তখন এক দ্বীপে এসে নোঙর করলো আমাদের ক্রুজ।

আমরা গাইডকে অনুসরণ করে গুহাপথে চলতে শুরু করলাম। গুহাপথ শুনেই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠলো, দম বন্ধ হয়ে এলো। কিন্ত না, এই গুহাপথ আদতেই সেরকম নয়। খাগরাছড়ি আলুটিলা গুহার মতো এখানে মশাল জ্বেলে পথ চলতে হয়না। জুতা হাতে কাপড় গুটিয়ে কাদাজল মারিয়ে শ্বাপদসংকুল পথ অতিক্রমের ঝক্কিও নেই। প্রাকৃতিক এই গুহাপথকে চলাচল উপযোগী করা হয়েছে নান্দনিক শিল্পছোঁয়ায়। আলো-আধারি গুহাপথে চলা মানুষের দিকে তাকালে বৈচিত্রময় পৃথিবী দেখা হয়ে যায়। নানা বর্ণের- নানা ভাষার মানুষের মাঝে ক্ষণিকের তরেই সখ্যতা গড়ে উঠতে দেখা যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে ধরে রাখতে শুধু সেলফি নয়- অবলীলায় একজন অচেনা মানুষ ফটোগ্রাফার হয়ে যায়। অপার আনন্দ নিয়ে গুহাপথ পাড়ি দিয়ে আবার ক্রুজে ফিরে এলাম।


এবার যাত্রা অন্য এক দ্বীপে। কিছুটা দূরে এক জেটিতে নোঙর করলো আমাদের ক্রুজ। গাইডকে অনুসরণ করে সকলে নেমে এলাম। নীল রঙের লাইফ জ্যাকেট পরে ছোট নৌকায় চড়ে আমরা দ্বীপ-সুরঙ্গপথে রওনা হলাম। বিভিন্ন দ্বীপ ঘুরে দেখলাম। দ্বীপের সরু পথে এগিয়ে গেলে মনে হলো কোন এক নির্জন গ্রামে ঢুকে পড়লাম। এখানে জল কিছুটা নিস্তরঙ্গ। কয়েকটা দ্বীপ যেন বিপুল জলরাশিকে আটকে দিয়েছে একটা লেকে। শান্ত সবুজ জল সোনারোদে চিকমিক করছে। দূর থেকে বিভিন্ন দ্বীপের মাঝে ক্রুজগুলোকে মুক্তোদানার মত লাগছে। ছোট ছোট নৌকায় অনেক পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুনশান নিরবতায় সজোরে আওয়াজ তুলে প্রতিধ্বনি শুনছে। আমরাও তাদের অনুকরণ করলাম। প্রায় আধাঘণ্টা নৌকা চালিয়ে জেটিতে ফিরলাম।

ক্রুজ আবার চলতে শুরু করেছে। সৈকত সংলগ্ন এক দ্বীপে এসে নোঙর করলো। গাইড ভিনি জানালেন এই দ্বীপের ওপর থেকে হা লং বে সৌন্দর্য দর্শন অনেক মনোমুগ্ধকর। গুহাপথ ভ্রমণে ক্লান্ত আমাদের দল আর কোন দ্বীপ সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে নারাজ। সৈকতে নামার যথাযথ প্রস্তুতিও নেই। অনেকটা বেমানান হলেও শত শত মানুষের জলকেলি দেখে সৈকতের জল স্পর্শ নিতে ছাড়েনি অনেকেই। আমাদের দেশের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের তুলনায় এই বিচ ততোটা মনোলোভা না হলেও মানুষের স্বাধীন বিচরণে তা অনন্য হয়ে আছে।

এবার ফেরার পালা। ক্রুজে ফিরে দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি। খেতে খেতেই ফিরে চললাম হা লং শহরে। নিঃশব্দে নিঃসঙ্গতায় দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলোর বুক চিড়ে শত শত ক্রুজে হাজারো মানুষ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবগাহন করছে। ক্রুজের ভেতর ভিয়েতনামী কারুপণ্যের সাজানো পসরা থেকে স্যুভিনিয়র কিনতে কিনতে আমরা স্মৃতিকাতর হই। পরিবেশ রক্ষায় সকলকে যত্নবান দেখে সহজেই বুঝে যাই কেন সারা দুনিয়া থেকে মানুষ হা লং বেতে ছুটে আসে। কেনইবা হা লং বে ইউনেস্কো স্বীকৃত হ্যারিটেজ। এই ভাবনা থেকেই তীরে ফিরে আসি। 

আমাদের গাড়ি মায়াবী হা লং শহর ছেড়ে ছুটে চলে হ্যানয় এর পথে। অদ্ভূত এক ভাল লাগার অনুভূতি নিয়ে ভিয়েতনাম এর সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই মানসপটে ভাসতে থাকে আমাদের সুন্দরবন আর প্রিয় কক্সবাজার। সুন্দরবনকে ঘিরে ইউনেস্কো শঙ্কা-জীববৈচিত্র বিনাশের হাত থেকে একে রক্ষা করতে পারলে এই সুন্দরবনও হবে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ। আমাদের দেশেও ভিড় করবে সারা দুনিয়ার পর্যটক। দেশের খ্যাতি অতিথিপরায়ণ সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। এমন ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতেই আমরা হ্যানয় ফিরে আসি।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন