কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

ভাস্কর চন্দনশিব




প্রতিবেশী সাহিত্য



ভাস্কর চন্দন শিব’এর গল্প     

(অনুবাদ : মিতা দাস)





লেখক পরিচিতি :

জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৯৪৫, হাইস গাঁও, কালাম্ব, উষ্মানাবাদ, মহারাষ্ট্রতিনি কেবল গ্রামীণ জীবনকে চিত্রিত করেননি, বরং কৃত্রিমভাবে গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। সমসাময়িক বাস্তবতার অন্বেষণ করার পাশাপাশি তিনি মানুষের জৈবিক চাহিদার উপরও নজর রেখেছেন। এ কারণে  মহারাষ্ট্রের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামীণভিত্তিক ভাস্কর চন্দন শিবের লেখা পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


লাল কাদা  
                                        
সোমবার, বাজারের দিন এই বাজার প্রত্যেক সপ্তাহে সোমবারেই বসেআজ ইস্কুলেরও হাফটাইমে ছুটি। এখন সবাই ঝুড়ি ও পুঁটলি মাথায় বাজার মুখো ছুটছে। ছাগল, মোরগ, বলদ, মোষ, ফল-তরকারি, ধান-চাল আরও অনেক যাবতীয় বিক্রির জিনিসপত্র বাজারের দিকে নিজের নিজের মালিকদের কাঁধে, ঝুড়িতে ও পুঁটলিতে করে বাজারের দিকে হাঁটছিলগাধা, ঘোড়া, গরুর গাড়ি ও সাইকেলের ভিড় গোটা রাস্তা জুড়েমেয়েমানুষেরাও ঝুড়ি বা পুঁটলি মাথায় ছুটছিল। বাজারে বেশ হট্টগোল, লোকেরা বন্যার জলের মতন তীব্র ও দিশাহীন বয়ে যাচ্ছিলো বাজারের দিকে। বাজারেও একটা বেশ রমরমা ভাবমানুষের ভিড় ঠেলে ও ধাক্কা-ধাক্কি করে আমিও বাজারের দিকে এগিয়ে চললাম। আমার বুকের শ্বাসপ্রশ্বাসে বেশ তখন উঠানামা। কিন্তু দেরি যেন না হয় তাই ভয়ে ভয়ে সজোরে পা ফেলে হাঁটা। আমার মাথার চিন্তা ভাবনাটা কাঁটাটা তীব্র গতিতে ঘুরছিল। বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই মা আমায় বলে দিয়েছিল - "বাবাসোনা,  গত বাজারের মত নয়, এবারে সোজা হাটে গিয়ে আগেভাগে ভালো ও বড় জায়গা ধরবি ইস্কুল থেকে ঘণ্টাখানেক আগেই বেরিয়ে পড়বিইস্কুলের পড়ার ক্ষতি হলে হোক, চলবেমা’র কথা মাথায় রেখে পীঠে ইস্কুলের ব্যাগ ঝুলিয়ে  হাঁটা দিলাম বাজারের দিকে

হঠাৎ আমার পীঠের ব্যাগ ধরে কেউ টান মারলমনে হল যেন আমার ব্যাগটা কোথাও আটকে গেছেপেছন ফিরতেই দেখতে পেলাম কালো গিনা আমার পীঠের ব্যাগটা ধরে টানছে
“শালা বাপ্প্যা, বোবা হয়ে গেলি নাকি? কত করে ডাকছি সাড়া দিচ্ছিস না যে?”  
গিনা রাগে থমত্থম করছিল
“কেন, কী ব্যাপার?” আমি প্রশ্ন করলামগিনা ছেঁড়া ধুতির কাপড়ে জড়ানো কিছু রুটি আমার হাতে তুলে দিল আর বলল, “তোর বুড়ি মা পাঠিয়েছে, বলেছে বাজারে গিয়ে বেশ বড় জায়গা ঘিরে বসতে” তারপর গিনা বাজারের ভীড়ে হারিয়ে গেল। আমিও রুটি ব্যাগে পুরে নিয়ে কাঁটাঘেরা তার টপকে এক লাফে বাজারে পৌছে গেলাম

বাজারে পৌঁছে দেখি লোকেরা আগে ভাগেই এসে ইট, পাথর, কাপড়, থলি, ঝুড়ি, বাক্সপত্র দিয়ে বা চকমাটি দিয়ে দাগ কেটে কেটে নিজের নিজের জায়গা ভাগ করে নিয়েছে। আমিও বড় জায়গার খোঁজে বাজারের এই কোণা থেকে ওই কোণা, এ মাথা থেকে ওই মাথা খানিকক্ষণ বড় বড় চোখ করে দেখলামচারিদিকে বেশ একটা রমরমা ব্যাপার। যার সবব্জি সে সবজি, যার বাসনকোসন সে বাসনকোসন ও মাছওয়ালা নিজের রকম রকমের মাছ গোছাতেই মত্ত। বেশ লাগছে বাজারটা, অর্ধেক সাজানো অর্ধেক ছড়ানো ছিটানো হঠাৎ মাছের ও চামড়ার একটা বিশ্রী ও বিকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পাট, দড়ি,  ঝাডু, সুতোও এই বাজারে বিক্রি হয়। এক কোণায় বাসনকোসনের দরদাম নিয়ে চাতুরী ও ছল করার তাগিদে মশগুল দোকানদারেরাওরা বেশ একটা লম্বা জায়গা ধরে বসেছিল। আর মাঝে মাঝে দেখলাম এক তারা, দু’তারাওয়ালা,  পালকীওয়ালা, মাছওয়ালারা যে যার নিজের নিজের খদ্দেরদের জন্য অপেক্ষারতআমিও গোটা বাজারটা ঘুরে এক কোণায় একটি খালি জায়গা দেখে মা’র দেয়া ধুতিটা চড়িয়ে বেশ একটা বড় জায়গা ধরে নিলাম। ধুতিটা যেন উড়ে না যায়, তাই আসেপাশের পাথর তুলে ওটাকে চাপা দিয়ে রাখলাম। জায়গাটা দেখলাম তিনজনের বসার জন্যে একটু ছোট এই জায়গা মা আর আবা’রই লাগবে তাহলে আমি কোথায় বসবো? আমি আবার নিজের জন্য জায়গার খোঁজে গোটা বাজারে নজর ঘোরালাম খানিক দূরেই দেখলাম একটা জায়গা খালি রয়েছে। আমি উঠে সেই জায়গায়ে চলে গেলাম। ব্যাগটা রেখেই পাশের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মামা জায়গাটা খালি তো? আমি কি এখানেই বসি?” লোকটা আমার দিকে ফিরেও তাকালো না, নিজের কাজেই ব্যস্ত একটু পরে জবাব   দিল, “কী বেচবি এখানে বসে?
“সবজি”
“কোন গ্রামে থাকা হয়?” ও একটু গর্বের সুরেই বলল
“হাস্য়া গ্রাম”
“একটু দূরে সরে বস!”

আমি আগে ভাগেই একটা বড়সড় পাথর জায়গাতে রেখে দিয়েছিলায়এখন সেই পাথরে বসে ব্যাগটা নিজের কোলে তুলে নিলামওই লোকটা কিন্তু নিজের কাজেই মগ্ন ছিল। এবার আমি ধুতিটা বিছিয়ে ভালো করে জায়গাটা দেখলাম তারপর ইস্কুলের ব্যাগ থেকে রুটি বার করে একটু একটু চিড়ে চিড়ে মুখে দিয়ে চিবোতে আরম্ভ করলাম
“ইস্কুলে যাস?” নিজের কাজ সেরে সে আমার ব্যাগটা দেখে বলল
“হ্যাঁ” আমি চাটনিতে রুটির টুকরো চুবিয়ে বললাম
“কোন ক্লাসে পড়িস?”
“দশম শ্রেণীতে” রুটি চিবোতে চিবোতে জবাব দিলাম
“দশম শ্রেণী? তাহলে তো বেশ কঠিন রে বাছা!”

রুটির টুকরাটা আমার গলায় আটকে গেল। আমি দেখলাম লোকটি নিজের ধুতিটা তুলে ঘাম মুচ্ছে আমিও আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রুটি খেতে লাগলাম কিন্তু ওর বলা কথাটা ‘তাহলে তো বেশ কঠিন রে বাছা’ আমার মাথায়ে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। যোশী মাস্টারের বলা কথাগুলি মনে পড়ে গেল উনি পড়াতেন ‘মহাত্মা ফুলে’র পাঠ। সেই পাঠে কুন্জরাটি ঠিক আমার আবা’র মতই হবে, হুবহু আবা’র মত। আমি আর থাকতে পারলাম না আমি ইস্কুলের বই বার করে শুকনো রুটির টুকরো চিবোতে চিবোতে বইয়ের পাতা উল্টোতে লাগলাম। বইয়ের পাতায় আন্ডারলাইন করা লাইনগুলি চোখ হতে মনে প্রাণে ও মাথার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। “আমাদের ক্ষেতে মেহনত  করে লাগানো ও ফলানো সবজি যদি শহরের বাজারে বিক্রি'র জন্য আনা হয় তখন ম্যুনিসিপালটির লোক আমাদের মত চাষীদের কাছ থেকে ট্যাক্স উসুল করে এবং আমাদের শোষণ করে। এই মেহনতেরও কোনো দাম নেইযে গাড়ি করে এই ফসল আনা হয়, তার ভাড়াটাও চাষীদের পকেট থেকেই যায়। আর নিজে ও বউ বাচ্চা সবাই খালি পেট ও নগ্ন থাকতে ও ঘুমোতে বাধ্য হয়... এই দেশের নেতা ও গণমান্যরা এতই অধম যে, ওদের কিছুই যায় আসে না কিন্তু ওরা যদি চাষীদের কথা না ভাবে, তাহলে চাষীরা বাঁচবে কী করে? আমার মাথায় পুরনো বইয়ে পড়া পাঠ ইতিহাসের পাতা নাচতে লাগলো ... মঙ্গলদের যুদ্ধ ... সাধারণ জনতাদের লুট, ছিনতাই, মারপিট ... ওদের জিনিস টাকাপয়সা দিয়ে ইংরেজদের ব্যবসা ... মহাজন, ব্যবসাদার ও জমিদারদের বিলাসিতা। আর বহুকাল ধরে শোষিত, দলিত, পীড়িত বহুজন সমাজের সব ব্যথা, দুঃখ আমার চোখে জীবন্ত হয় ভাসতে লাগলো। আমি আমার তন্দ্রায় ডুবে ছিলামইংরেজরা অনেক কিছু উদ্ধার করেছিল? না, না, বরং লুটন, ছিনতাই ও জবরদস্তি উসুলির কাজের ভালই ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। ওরা বড় বড় যোজনা তৈরী করে নিয়েছিল 

“এই ছেলে!”
কারোর ডাকে আমার তন্দ্রা ভাঙ্গল, আমি চকিত হয় দেখলাম, সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের গ্রামের সটোবা তেলি
“এই পাগলা, তুই এখানে ধুনি জমিয়ে ধ্যানে মগ্ন, ওদিকে তোর বাবা-মা বোঝা মাথায় নিয়ে তোকে খুঁজে মরছেতোকে না জায়গা ধরে রাখতে বলা হয়েছিল? আমি ব্যাগ ওখানেই ফেলে রেখে আবা ও মা’কে খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই লঙ্কা বাজারের মুখে দু’জনকে বস্তা মাথায় এদিকেই এগিয়ে আসতে দেখলাম এক দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে একটা বস্তা মা'র মাথা থেকে নামিয়ে নিলাম 
“বাছা, ও আমার বাবা, আস্তে ধীরে তুলিস। দেখবি আবার যেন পেটে টান না পড়ে!” বলতে বলতে মা’র শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছি্ল। মা হাঁফাতে লাগলো। আমি  বস্তা তুলে বিছানো ধুতিটির দিকে এগিয়ে গেলাম তারপর সেখানে বস্তাটা নামিয়ে রাখলাম। তারপর মায়ের মাথা থেকে দ্বিতীয় বস্তাটা নামাতে এগিয়ে গেলাম। বস্তাটা নামিয়ে রাখলাম ধুতির উপরএকটি বস্তায় পিয়াঁজ আর দ্বিতীয়টিতে মটরসুটি

পিয়াঁজের বস্তা মা’র কাছে ছেড়ে মটরসুটির বস্তা নিজের জায়গায় তুলে নিয়ে এলাম। বস্তা খুলে সবুজ সবুজ, নরম নরম মটরসুটিগুলিকে একটু সুন্দর করে ছড়িয়ে দিলামতারপর মায়ের কাছে ফিরে এলামততক্ষণে আবাও বাজারে এসে পৌঁছলো। আবা’র বস্তাগুলি এক এক করে নামিয়ে রাখলামসেই বস্তায় টমেটো ছিল, আমাদের ক্ষেতের টমেটোআবা সেগুলি বেশ যত্ন করে এতদূর নিয়ে এসেছিল মাথায় করে ভয় ছিল, টমেটোগুলি চাপে ফেটে যেত যদি? আবা টমেটোগুলি বড় বড় নরম আকন্দ গাছের পাতা দিয়ে মুড়িয়ে ঝুড়ির ভিতর সুন্দর করে রেখে দুটোই ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে করে নিয়ে বাজারে এসে পৌছে ছিল আর এক দৌড়ে আমি সেগুলি আবা’র কাঁধ থেকে আস্তে ধীরে নামিয়ে রাখছিলামতারপর চটপট করে আবা’র সঙ্গে ঝুড়িগুলি খুলতে সাহায্য করলামলাল লাল টমেটোগুলি দেখে বেশ আনন্দ লাগছিল এক একটা টমেটোর সাইজ এমন যে তিন চারটে বাটখারায় রাখলে ওর ওজন হবে ঠিক এককিলো আবা একটি ঝুড়ি খুলল মাত্র, দ্বিতীয়টি পেছনে আকন্দ পাতা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল। তারপর বাটখারা ও বাট, আর যে সব বাট ছিল না তার মাপের পাথরগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখল। ওদিকে মাও নিজের পিয়াঁজগুলি একটু নেড়ে চেড়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল। এবার আবা একবার গোটা বাজারে চোখ বুলিয়ে একটি ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো, “আজ তো যেদিকে দেখি শুধু টমেটো আর  টমেটো! যতদূর নজর যায় শুধু টমেটোই চোখে পড়ছে” আবা উদাস হয়ে উঠলো আবা একবার ঘুরে মায়ের দিকে তাকালোআবা দেখল যে মাও টমেটোগুলির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেতারপর আবা আমার দিকে ঘুরে আমায় দেখল আর দূর থেকেই আমায় মটরসুটির দরদামের কথা বোঝাতে লাগলো টাকাপয়সা কীভাবে যত্ন করে রাখতে হয় সব বলে দিলকিছুক্ষণ পরেই নিজের জায়গায় উঠে দাঁড়ালো ও হাঁক পেরে খদ্দেরদের ডাকতে লাগলো, “এসো এসো, নিয়ে যাও লাল-লাল টমেটো, তাজা-তাজা টমেটো, এই যে দেখুন না বেশ সস্তায় ... আজ জলের দামে কিনে নিয়ে যান লাল-লাল টমেটো! ও মশায় নিন না টমেটো ... একবার দেখুন না, রক্তের মত লালএ বাজারে এ রকম মাল আর পাবেন না যে ... ও দাদু ... ও কাকা ... খুবই সস্তা যে ... দেখুন এক্কেবারে তাজা ও সস্তাও ... নিন না ... কত নেবেন ... একবার হাতে তুলে দেখুন না মাখনের মত টমেটো!” বারবার আবা সস্তা দামের উপর জোর দিয়ে বলছিল ও খদ্দেরদের ডাকছিল আমার মাও জোর গলায় খদ্দেরদের ডেকে  ডেকে পিয়াঁজ বিক্রি করছিল। ওদের দেখে আমি নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।

এখন বাজারে বেশ চমক লেগেছে, লোকজনে লোকারণ্য হয় বেশ দেখাচ্ছিল। যেদিকে নজর যায় লোকে লোকারণ্য ভীড় আর ভীড়, বাজারটা বেশ জমে উঠেছিল। গ্রাহকেরা দামদস্তুরে মগ্ন হয়ে গোটা বাজারটা চষে বেড়াচ্ছিল। রঙ্গীন ছাতা মাথায় ও হাতে সুন্দর সুন্দর হালকা ফুলকা বাস্কেট দুলিয়ে মেয়েরা, বউরা বাজারে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্তরের দর দাম নিয়ে, পাঁচ-দশ পয়সার জন্য তর্কে মেতে উঠছিলআমার কিন্তু ওদের স্বভাব দেখে বেশ রাগ হত, কিন্তু কখনো কখনো মায়াও হতবাজারে আসলেই জানি না কেন সবাই কেমন যেন হয়েই যায়! সেটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়ওরা বাজারে আসলেই কেমন যেন আজব আজব কথাবার্তা বলে ও আজব আজব ব্যবহার করে। ওরা দু’দুজন বা চার-চার জনের গ্রুপে আসে, আর প্রত্যেকটি জিনিসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, উলোট পালোট করে দেখেকিলোর দরদাম ক’রে নেয় মাত্র একশো বা আড়াইশো গ্রামতারপর খুচরো নেই বলে তাল বাহানা ক’রে দশ-পাঁচ পয়সা কম দিয়ে এগিয়ে যায়। দশ পয়সার যদি ধনেপাতাও কিনতে হয়, ওরা এক একঘন্টা ওর জন্যও দরদাম করে আর গোটা বাজারে ঘোরেওদের ভেতর পুরুষ গ্রাহকেরা তাও ভালো, কিন্তু মহিলা খদ্দেররা হলে তো আর কোনো কথাই নেই! ঘন্টার পর ঘন্টা মাথা খাবে, আর দরদাম করবে, তারপর সব জিনিসে খুঁত ধরবে আর কিছুই না কিনে এগিয়ে যাবে। বড়ই আজব এই বাজার! এই বাজারে পয়সা পয়সার পেছন ছোটে মনে হয় প্রত্যেক মানুষ যেন কাউকে ঠকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে  আর সেই মানুষকে খুঁজে মরছে। আমি আবা’র দিকে ফিরে তাকালাম, আবা হাত তুলে গ্রাহকদের ডেকেই চলেছে, একই সুরে টমেটোর প্রশংসা করেই চলেছে , আর সস্তা দামে কেনার জন্য পিড়াপিড়ি করছেমা'ও নিজের পিয়াঁজ বিক্রি করার জন্য সবাইকে নানান রকমের লোভ দেখিয়ে ডাকছিল। ওদের এইভাবে সবজি বিক্রি করার জন্য লোকেদের পিড়াপিড়ি করতে দেখে আমার অন্তরে একটি ব্যথা জন্মালো। মন চাইলো আমিও ওদের মতো করেই জোর গলায় খদ্দের ডাকিকিন্তু পারলাম নাসামনে চেয়ে দেখলাম আমার ক্লাসের ছেলে - ছোকরারা এদিকেই এগিয়ে আসছে কিছু কিছু আমার ইস্কুলের মেয়েরাও এদিকেই ঘোরাফেরা করছে। আমি এক্কেবারে মনমরা হয়ে গেলামমেয়েরা আমায় চোখের আড়ালে চেয়ে চেয়ে বিশ্রী হাসি হাসছিলকেউ কেউ আমার পাশেই সবজি বিক্রি করছে এমন সবজিওয়ালার কাছে গিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে দর দামে ব্যস্ত হয়ে আমাকে লজ্জা দেয়ার চেষ্টা করছিলমিথ্যা সবজি কেনার ভান করছিলআমি লজ্জায় পড়ে মাথা হেট কোরে মাটির দিকে চেয়ে রইলাম, কারণ জানি দ্বিতীয় দিন ইস্কুলে ওদের সঙ্গে আমি আর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবো নাআমার এখন আর সাহসেই কুলোচ্ছিল না

“এসো ভাই এসো ... ও দিদি আসুন না দেখে যান! হলো কী, দেখে যান না একবার খুবই সস্তা, লাল-লাল টমেটো ... এক্কেবারে তাজা সব আমার ক্ষেতের ... জলের দামে ... ও দাদা দেখুন না ...”! আবা উঁচু গলায় চেঁচাচ্ছিলগ্রাহকেরা আসছিল, টমেটোগুলিকে ধরে টিপে দেখছিল, তারপর অর্ধেক দামে কেনার জন্য অস্থির হয়ে উঠছিলো। আবা এই ধরনের কথাবার্তা শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে উঠছিল, কারণ এখনো আবা’র কিছুই বিক্রি হয়নিএকটা কালো চশমাওয়ালা গ্রাহক বারবার টমেটোগুলিকে টিপে টিপে দেখছিল, তারপর সেগুলিকে উলোট পালোট করে দেখছি ওকে এইভাবে ঘাঁটতে দেখে আবা হঠাৎ রেগে মেগে একসা! কিন্তু কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও কিছুই বলল না। নিজেকে সংযত রেখে বলল, “যাও ভাই যাও, পরের বাজারে এসো, আজ আর এর চেয়ে দাম কমাবো নাআমায় পোষাবে না” গ্রাহকটি মনে মনে কিছু বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেল আবা আবার গলা ফাটিয়ে জোর গলায় গ্রাহকদের ডাকতে লাগলোমাঝে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, মা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
আবা হঠাৎ মায়ের উপর খেঁকিয়ে উঠলো, “বোবা হয়ে গেলি নাকি? আওয়াজ লাগাও জোরে!” মা ভয়ে আবার জোরে জোরে গ্রাহকদের ডাকতে লাগলো। এবার আমার পালা আবা এবার আমার দিকে মুখ করে চেঁচালো, “এই ছেলে, মুখে  কথা নেই কেন?” আমি আনমনা ভাবে উঠে দাঁড়ালাম, আর চেনাশোনাদের চোখ বাঁচিয়ে ওদের আড়াল করে খদ্দের ডাকা আরম্ভ করলাম

সন্ধে ঘনিয়ে এলো বাজারে এবার লোকজনের আসাযাওয়া একটু কমে এলো। লোকেরা নিজের নিজের ছোট ছোট পুঁটলি গুটিয়ে অন্ধকার বাড়ার আগে ভাগেই গ্রামে ফিরে যেতে লাগলো। বাকি পড়ে থাকা মালগুলি বিক্রি করার ব্যাকুলতা বাড়তে লাগলো, কিন্তু লাভ নেওয়ার তাগিদে কম দামে জিনিস বিক্রি করার ইচ্ছে হলো না। কিন্তু না বিক্রি করে ওরা সেগুলি নিয়ে করবেই বা কী? কম দামে দিতে না চাইলেই বা কী! ওদের তো আর কোনো উপায়ও নেই ওরা ওদের মালগুলি ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে শেষমেষ রাখবেই বা কোথায়? সব জিনিস পচে যাবে, তারপর সেগুলি ফেলে দিতে হবে। তাই ওদের মন এইসব ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠছিলোতাই দু’টাকা দামের সবজিগুলি ওরা একটাকা দিয়ে বিক্রি করে ঝুড়ি বা বস্তা খালি করছিলো। চার টাকার দড়ি তিন টাকায় দিতে রাজি হয়েছিলকিন্তু এমনি গ্রাহক, সে দু’টাকায় নেবার জন্য জিদ ধরে বসেছিল
এখন সবাই হাটের কেনাকাটা তাড়াতাড়ি সেরে নিতে চাইছিলমার সব পিয়াঁজ ফুরিয়ে গেছে, মা’র বস্তা খালি, আমারও মটরসুটি মাত্র দু’কেজি বাকি, কিন্তু  আবা’র টমেটো যতটা সে এনেছিল প্রায় অতটাই পড়ে রইলো বড় জোর অর্ধেক ঝুড়ি বিক্রি হয়েছে হয়তোএকটা ঝুড়ি পাতা দিয়ে যেমন ঢাকা দেয়া ছিল অমনিই ঢাকা পড়ে রইলোসকাল থেকেই টমেটো'র সেই রকম কোনো গ্রাহক'ই জুটলো না

শুধু আজকের বাজারেই নয় গোটা একমাস ধরেই এইরকম দৃশ্য, টমেটো'র বাজার মন্দাফসল এই বছর প্রচুর হয়েছে। বাজারে টমেটো থৈ থৈ করছেদরদাম করতে প্রাণটা যেন যাই যাই অবস্থাগ্রাহকেরা এরকম সুন্দর সুযোগ হারাতে চাইছিল না বেশি মাল পাবার লোভে ওরা আরো দরদামে মশগুল। আবাও দু’টাকা কিলো টমেটো এক টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হলোকারণ  লোকেরা টমেটো দেখে দেখে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। যখন আবা দেখল যে বাজারটা বেশ খালি হয়ে এসেছে, আবা টমেটোগুলির দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আবার গ্রাহক ডাকতে শুরু করলো, “এসো এসো ভাই, সস্তা টমেটো, এক্কেবারে সস্তা টমেটো ... নিয়ে যান ... বারোআনা কিলো টমেটো, বারোআনা ...!”  লোকেরা একবার ফিরে তাকালো আর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল
এই মশায় নিন না ... আটআনা কিলো ... আটআনা, আসুন নিয়ে যান লাল লাল টমেটো!” লোকেরা আবার এই অবস্থা দেখে হাসছিলআবা পাগলের মত চিত্কার করে করে লোকেদের ডাকছিল
কী দামে দিচ্ছো এই টমেটো?” কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ল একটি গ্রাহক
আটআনা কিলো” আবা উদাস স্বরে বলল
ঠিক করে বল!” গ্রাহকটি টমেটোগুলিকে উলোট পালোট করে প্রশ্ন করল
ঠিক! ঠিক মানে কী?”
বলার জন্য আটআনা, কিন্তু আসল দাম কত, বল দেখিনি বাপু?”

আবা’র মাথায় এবার টনক নড়ল চেহারাটা এক্কেবারে লাল হয়ে উঠলো। রাগে ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগলো বড় মুশকিলে নিজেকে সংযত করে রাগ গিলে আবা প্রশ্ন করলো, “কত নেবে ভাই?”
দরদাম ও মাপে ঠিক থাকলে এক পোওয়া নিয়ে নেবসঠিক দাম মনে হয় চারআনা হবে, কী বল?” সে বলল
কী?” আবা রেগে হয়রান “যাও দূর হয়ে যাও, যেদিকে যাচ্ছিলেন মশায় ওদিকেই যান ... টমেটো কিনতে এসেছেন, না কচু? শয়তান কোথাকার!
গ্রাহকটি ভয়ে উঠে দাঁড়ালো বিড়বিড় করতে করতে একদিকে সরে গেল।
আবা’ র চেহারা রাগে থমথম করছিলতচোখ দুটো লাল, যেন চোখে লাল লাল টমেটো ঢুকে পড়েছে
চারআনা কিলো? এই টমেটোর ক্ষেতে আমি জলের জায়গায় নিজের রক্ত দিয়েছি সে কি না বলে চারআনা কিলো? চারআনা কেন, কুড়ি পয়সা দিয়ে নিয়ে যা ... দশ পয়সা দিয়ে ... পাঁচ পয়সা দিয়ে ... আরে পয়সা দেবার কী দরকার, মুফতে নিয়ে যাও ... পয়সা দেবে কেন ... শয়তানেরা? তোমরা এমনি নিয়ে যাও, বিনামূল্যে!
আবা’র রাগ বেড়েই চলেছে সে দু’ঝুড়ি টমেটো রাগে মাটিতে ঢেলে দিল লাল লাল টমেটো'র যেন পাহাড়! হঠাৎ আবা’কে যেন কোনো পাগলামিতে পেল। একটা ঘোরের মধ্যে নিজের মুখেই ঘুঁষি মারতে মারতে চেঁচাতে লাগলো, আর  টমেটো'র পাহাড়ে চড়ে টমেটোগুলোকে দু’পা দিয়ে মাড়িয়ে থেঁথলাতে লাগলো
টমেটো'র পাহাড় লাল কাদায় পরিবর্তিত হয়ে গেলআবা পাগলের মত সেই লাল কাদায় নাচতে লাগলো


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন