পদাবলি ৭
(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে
পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে
লিখতে। যদি যুগান্তকারী
কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম
করে।
পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব
নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস
সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া
পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ
প্রশ্ন করে থাকি।
মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায়
খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না
শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী
বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)
লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজোর মাঝে কিছুদিন
অন্তত নিশ্চিন্তে নর্ম্যাল লাইফ কাটানো যাবে। বেশ কিছুদিন এফবি খোলাই হয়নি। তাই আজ বেশ কিছুটা সময় নিউজ ফিড স্ক্রল করছি। মনে হচ্ছে যেন অন্য কোন আইডিতে এসেছি। কাউকেই চিনতে পারছি না। এরা কারা? আমার বন্ধু? আমি কে?
কে জানে!
হ্যাঁ রে পদা, তুই তো ফেসবুক করিস খুব।
কত কী জানিস এই বিষয়ে। আর আমি বেকুবের মত দেখি, কারা
কারা যেন ফ্রেন্ড থেকে ফো মানে আনফ্রেন্ড হয়ে গেল। কারা কারা যেন অদৃশ্য মানে ব্লক
হয়ে গেল। কারা আবার বিখ্যাত হয়ে গেল, কুখ্যাতও। কাদের কাদের
লাইক হুহু,
কাদের যেন টিমটিম, কাদের মাথায় হাত পড়ল, কারা যেন কাদের খান হয়ে উঠল। কাদের মাথার 'পরে আর
হাত রইলো নাকো। কাদের মাথায় আবার বিশেষ কারুর হাত পড়ে মাথার পিছনে একটা বলয় জেগে
উঠল... হ্যাঁরে এইসবের মানে কী?
পদা কোত্থেকে যেন এক ঠোঙা চিনেবাদাম জোগাড় করেছে। পটাশ পটাশ করে ফাটাচ্ছে সমানে। আমার কথা বোধহয় কানেই যায়নি। তবুও ওই পটাশ পটাশের মধ্যে একবার সে বলে উঠল, 'মনে আছে, রান্না করতে করতে ফেসবুক করতে গিয়ে কতবার পুড়িয়েছিলিস? অতএব মাল্টিটাস্কার হোস না। হয় এস্পার নয় ওস্পার।' 'মানে?' খুব বিরক্ত হয়ে পদা বলল, 'মানেবই লিখছি একটা ফেসবুকের। ডোন্ট ডিস্টাপ!'
পদা কোত্থেকে যেন এক ঠোঙা চিনেবাদাম জোগাড় করেছে। পটাশ পটাশ করে ফাটাচ্ছে সমানে। আমার কথা বোধহয় কানেই যায়নি। তবুও ওই পটাশ পটাশের মধ্যে একবার সে বলে উঠল, 'মনে আছে, রান্না করতে করতে ফেসবুক করতে গিয়ে কতবার পুড়িয়েছিলিস? অতএব মাল্টিটাস্কার হোস না। হয় এস্পার নয় ওস্পার।' 'মানে?' খুব বিরক্ত হয়ে পদা বলল, 'মানেবই লিখছি একটা ফেসবুকের। ডোন্ট ডিস্টাপ!'
পুনশ্চঃ
ও হ্যাঁ, ভাল কথা! পদাকে এবারে মাস কাবারে বইয়ের সঙ্গে পাবেন। মানে মাসিক। ধারাবাহিক। (মন ছোট করবেন না। মাদাম তুভোঁ আগেই বলে গেছেন, হিংসা স্রাব ভালা না।) তো পদা এবার থেকে নিয়মিত ফেসবুকে মাসকাবারে হাজিরা দিচ্ছে তার সমস্ত কিছু নিয়ে। কয়েকগাছা পাতি দর্শক মানে ফলোয়ারও জুটেছে তার। ক্ষী দিনকাল পড়ল মাইরি! পদারও আবার ফলোয়ার। মানে পুঁই শাকের ক্যাশমেমো! সে যাই হোক, ‘এদ্দিন সিনেমার ভাষায় শুনতাম জিরো ফিগার। এখন নাকি সিনেমার ভাষা শুধুই জিরো’। পদা নাকি সিনেমাও দেখছে আজকাল আর এইরকম মন্তব্য করছে। যা বুঝছি, ও শূন্যতা অতিক্রম করবে খুব শিগগিরই।
এদিকে রোজ
পোস্ট দেওয়া পদার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমি তো ওর পোস্ট দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত। একদিন
আর না পেরে বলেই ফেললা, ‘হ্যাঁ রে, দেই
আর নেই-এর বদলে দিই আর নিই লেখা যায় না? অন্তত
লেখার ক্ষেত্রে? না লিখলেই বা কী! আমার আর কী! শুধু দেই দেখলেই
আমার ধেই ধেই করে নেত্য করতে ইচ্ছে হয়। এই আর কী!’ এরপর কাজ হল সত্যি সত্যিই। ওই
জন্যেই বলে। যে রোগের যা ওষুধ। ঠিকঠাক ডোজ-এর ওষুধ নিয়ম মেনে দীর্ঘদিন প্রয়োগে
অনেক জটিল অসুখও সেরে যায়। চাই একটু ধৈর্য।
দিন যায় না জল যায়! দেখতে দেখতে
কালীপুজো এসেই গেল। তিনদিন ধরে চলল শেলের উৎপাত। রাতে পদার পোস্ট—হ্যাঁ গা! তোদের ১২শট,
১৫ শটের স্টক কখন শেষ হবে? আর
যে পারা যাচ্ছে না! মাকালীর হেঁচকি উঠছে, কাটা
মুণ্ডুগুলো, এমনকি শেয়ালটাও পালিয়েছে। আমি কোথায় যাই বল দেখি
তারা! তারা ফুটছে চক্ষে!
তবে কিনা কালীপুজোর পরেই পাবলিক
শোভন হয়ে যাবে, এমনটা আমি কেন, পদাও ভাবেনি। যেদিকে তাকাই, শোভন আর শোভন। নিউজ
চ্যানেলগুলোকে, কাগজগুলোকে এবার খিস্তি করা শুরু হল শোভনের জ্বালায়। পদা তখন বলল, আচ্ছা
শোভনের কী দোষ বল? এই যে তোমরা খিল্লি করছ, নিউজ
ছ্যানেলগুলোকে গালি দিচ্ছ.. কিন্তু একবারও ভেবে দেখলে না যে,
কোন যুগে উনি লিখে গেছিলেন "আমার চোখে তো সকলি শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল.…"
ভালবাসা কারে কয় বুঝেছ তো এবার সখা/সখীরা?
আর খিল্লি করে না। আজ তায় আবার রাস পুন্যিমে। মাধব,
মাধব। আর প্রেম কাকে বলে বোঝ তোমরা? প্রেম হল একটা ঘূর্ণীর মতো।
রোস বাপু! আমি সবিস্তারে পোস্টাচ্ছি। পড়-
পরিমাণ মত প্রেম নিয়ে একটা চ্যাটালো
পাত্রে ভালো করে ফেটান। ডিম ফেটালে যেমন ঘূর্ণী ওঠে, এক্ষেত্রেও
তাই হবে। এক মিনিয়েচার টর্নেডোকে আপনার পাত্রে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে দেখবেন। এরপর
ফেটানো বন্ধ করলে দেখবেন আপনার প্রেম কেমন ফুলে ফেপে উঠেছে। এবার কিছুটা টক দই আর
নুন ও সামান্য চিনি দিয়ে প্রেমকে ম্যারিনেট করে ফ্রিজে রেখে দিন। কতদিন রাখবেন,
সেটাও আপনাকে আন্দাজ করতে হবে। ঝাল পছন্দ করেন?
নাকি মিষ্টি মিষ্টি? কিছুটা টক
স্বাদ চাইলে, চিনি দেবেন না। আর মিষ্টি চাইলে চিনির পরিমাণ বেশি হবে। ও আচ্ছা, আপনি
ঝালের লোক। তাহলে ইচ্ছে মত যত খুশি লঙ্কা মেশান। লাল লাল শুকনো লঙ্কা, রঙও
হবে, ঝালও। আর কয়েকটা কাঁচালঙ্কা চিরে নামানোর আগে ছড়িয়ে দিতে পারেন।
আর একটু গোলমরিচের গুঁড়ো অবশ্যই দেবেন। তবে যাই বলুন আর তাই বলুন, প্রেম
রান্না শেখানো খুব টাফ। নিতান্তই হাতেকলমে দুচার বছরের অভিজ্ঞতা না থাকলে আপনি
প্রেমটাকে ঠিক মত ম্যানেজ করতে পারবেন না। হয় অতিরিক্ত আবেগে ভ্যাদভেদে হয়ে যাবে, কিম্বা
প্রচন্ড চাহিদায় গলা দিয়ে নামবে না। তবুও বলি, চেষ্টা
করতে দোষ নেই। ওভাবেই হয়ে যাবে একদিন।
ইতিমধ্যে এই প্রেমের ফাঁদ পাতা
ভুবনের মধ্যিখান হইতে মাদাম তুভোঁর আবির্ভাব হইল। পদার ক্রমশ ফেমাজে গ্রহণযোগ্যতা
বর্ধমান দেখিয়া মাদামের ভ্রূযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত হইয়া আছে। মনে সাধ জাগিতেছে, আঁকশি
দিয়া ওই ভ্রূযুগলকে সপাট আর নিভাঁজ করিয়া দেই, থুড়ি, দিই। তাহা হইবার আর উপায় নাই
দেখিয়া, আমি মাদামের ঘনিষ্ট হইবার বাসনায় কিঞ্চিত আদিখ্যেতা মূলক কন্ঠে তাঁহাকে
ডাক দিলাম, ‘মাদাম, মাদাম, আপনি কি দেখেছেন আজকাল পদাকে? কেমন যেন এফবির খোঁয়াড়ে
ভাসছে আর হাসছে! সেই পদাকে আর যেন চেনাই যায় না!’ মাদাম যে আমার প্রতি স্নেহ
দেখাইবেন এইরূপ দূরাশা কেন যে আমার মস্তিষ্কে আসিল! হায়! তপ্ত তৈলকটাহের উষ্ণ তৈলে
যেন এক ছিলিম জল পড়িল! আহা সে কী চিড়বিড়ানি মাদামের! একবার আমাকে শাসান তো আরেকবার
পদাকে। শেষে ক্ষণিক প্রশমিত হইয়া বাণী ছাড়িলেন। ‘সত্য কালের নিরিখে মিথ্যে
প্রমাণিত হলেও হতে পারে। কিন্তু মিথ্যে কোনদিনও সত্যি হয় না, জেনে রেখ। এই যে
তোমাদের বাস্তব থেকে দূরে চলে গিয়ে অবাস্তব জগতে বিচরণ, এর ফল একদিন তোমরাই
হাতেনাতে পাবে। যেদিন মুখ থুবরে মাটিতে পড়ে হাত, পা ভেঙে লেটে যাবে, সেদিন কোন
ভার্চুয়াল দোস্তের দেখা পাবে না। সেই তোমাদের দুজনকে দুজনার দেখভাল করতে হবে। আর আমার কথা নাহয় থাক! আজ আছি, কাল
নেই। একদিন তোমাদের নিস্তার দিয়ে চলে যাব। শান্তিতে থেক বাছারা।‘ এই বলিয়া ধীরে
ধীরে মাদাম কক্ষ হইতে নিষ্ক্রমণ করিলেন। আজ ঘরের বাতাস ভারী ও ভেজা হইয়া রহিল।
তবে যাই বলুন আর তাই বলুন, প্রেম রান্না শেখানো খুব টাফ।
উত্তরমুছুনহ্যাঁ তো
মুছুন