সুশীলতার প্রতিচ্ছায়ায় অপরাধপ্রবণতা (Dis identification of self-crime)
বর্তমান উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থায় দিন দিন হু-হু করে বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতা। এর কারণ হতে পারে মূলতঃ দু’টি - সমাজে অপরাধীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়া অথবা সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের অবনতি হয়ে তাদের দ্বারা ছোট-বড় নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হওয়া।
বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে গেলে আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খ্লা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ ও ব্যক্তিবর্গের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা আগের তুলনায় আধুনিকীকরনের কারণে, বাহ্যতঃ চিহ্নিত অপরাধীর সংখ্যা গাণিতিক অথবা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার বা দমনের ক্ষেত্রে, তারা একেবারেই অসফল তা নির্দ্বিধায় বলতে পারার কোনো কারণ নেই। তাহলে কি প্রতিপাদ্য হয় যে, সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাধারণ মানুষ তথা সামাজিকভাবে সুনাগরিক হিসাবে চিহ্নিত মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া?
এক্ষেত্রে সমাজে নতুনভাবে যে অভিনব মাত্রাটি যুক্ত হয়েছে সেটি হচ্ছে, বর্তমান উপমহাদেশীয় সমাজে সাধারণ নাগরিক তথা বাহ্যিকভাবে সুনাগরিক হিসাবে চিহ্নিত মানুষ, তার নিজস্ব নৈ্তিক মূল্যবোধের সীমা লঙ্ঘন করে চেতন অথবা অবচেতনভাবে আকস্মিক অথবা পরিকল্পিত উপায়ে নানা ছোট-বড় অপরাধ সংঘটিত করে, যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে সামাজিকতার ফিল্টারের নেতিবাচক দিক থেকে ভালোমানুষের রূপ ধরে পরিস্রবনের মাধ্যমে ইতিবাচক অবস্থায় নিজের স্থান পরিবর্তন করে নিচ্ছে। যেন এটি একটি লেইন-বাইলেইন চেন্জ করতে পারা টু ওয়ে হাইওয়ের মতোন চলমান প্রক্রিয়া। অপরাধীর বদলে সুনাগরিকের মুখোশটি তারা বসিয়ে নিচ্ছে নিজের সামাজিক প্রতিচ্ছবির মুখায়বয়বে।আধুনিক সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে এটি একটি চমকপ্রদ সংযোজন হতে পারে। আর এক্ষেত্রে একজন সুনাগরিকের দিকে অপরাধী হিসাবে অঙ্গুলী নির্দেশ করা দুরুহ হয়ে দাঁড়ায় সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীগনের পক্ষে। ফলে তার কৃত অপরাধসমূহ বিচারের মুখ না দেখে বরং ধামাচাপা পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী দেখা দেয়।
এ বিষয়ের অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের আশেপাশেই। যেমন কোনো কোনো সুগৃহিনী-মাতা-ভগিনীই আধুনিককালে সকলের অগোচরে এসকর্ট বা দেহপসারিনীর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক কাঠামো ঠিক রেখেই। অথবা জড়িয়ে পড়ছে পরকীয়ার মতো অস্থিতিশীল অনৈতিক সম্পর্কে। ...বাহ্যত সৎ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিটিই হয়তো কোনো পদোন্নতি বা আর্থিক সুবিধা পেতে উৎকোচ বা অন্য কোনো উপঢৌকন দিচ্ছে তারই উর্ধ্বতন বস বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। কিংবা হয়তো ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের অধঃস্থনকে হেনস্থা করছে নানা উপায়ে বা নিজেই ঘুষ গ্রহণ করছে। আবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই মানুষটিই ধর্মভীরু সৎ মানুষ হিসাবে যা যা আচরণ করা প্রয়োজন, তা পালন করে যাচ্ছে নিয়মিতভাবে। সে হয়তো পারিবারিক আবহে বা বন্ধু পরিমন্ডলে অত্যন্ত রুচিশীল দায়িত্ববান মানুষ হিসাবেই পরিচিত। এর ফলে তার কৃত অপরাধ সহসাই ধরা পড়ছে না কারো চোখেই। এমনকি অনেক সময় নিজের অবচেতন মনে সে স্বয়ং নিজের অভ্যন্তরীণ সত্ত্বার কাছেই অস্বীকার করছে যে, এ ধরনের কোনো অন্যায় বা অপরাধ তার দ্বারা আদৌ সংঘটিত হতে পারে। কিংবা নিজের কৃত অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে বা অনুশোচনায় ভুগে, আরো বেশী করে সৎকর্মে বা ধর্মকর্মে নিয়োজিত করছে নিজেকে। এরকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি নিজেই যেখানে নিজেকে অপরাধী ভাবতে পারছে না, নিজেই নিজের চোখে ধুলো দিচ্ছে বা আই-ওয়াশ করে চলেছে, সেখানে পারিপার্শ্বিক মানুষজনের পক্ষে এই ব্যক্তিটির কোনো ধরনের নেতিবাচক কাজের সাথে জড়িত থাকার ক্ষীণতম সম্ভাবনার চিন্তাও কাজ করছে না। সামাজিক মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এই ধারণাটির নামকরণ করা যেতে পারে ‘Disidentification of self crime’.
কিন্তু কেন আজকাল মানুষ নিজের করা ছোট-বড় অপরাধগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না, সে বিষয়টিও বিবেচনায় এনে তার কারণসমূহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। এ ধরনের সমস্যার প্রতিকারের উপায়গুলো অনুসন্ধান করতে গেলেও আমাদেরকে এসবের ভিত্তিমূল হিসাবে কাজ করে যে কারণগুলো, তাদেরেকে চিহ্নিত করে তবেই এগোতে হবে প্রতিকারের লক্ষ্যে।
Disidentification of self crime এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে বর্তমান সমাজে উচ্চতর ডিগ্রীর সহজলভ্যতা। আজকাল নতুন নতুন সরকারী-বেসরকারী উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ার ফলে আগের চেয়ে অধিকসংখ্যক মানুষ উচ্চতর ডিগ্রীলাভের সুযোগপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভাব থেকে যাচ্ছে সুশিক্ষার। এর বিপরীতে একজন উচ্চ ডিগ্রীধারী ব্যক্তি হিসাবে নিজের স্থান উঁচুতে মনে করে, নিজের ইতিবাচক-নেতিবাচক সবধরনের কাজকেই ‘জায়েজ’ মনে করছেন একশ্রেণীর মানুষ। এক্ষেত্রে তাদের এমন মনোভাব কাজ করে যে, “আমার মতোন একজন সুশিক্ষিত মানুষ কি এধরনের ভুল কিছু করতে পারে?” আর এই মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাকে ঠেলে দেয় ন্যায়-অন্যায়ের নৈতিক সীমালঙ্ঘন অতিক্রম করার প্রবণতার দিকে।
সেইসাথে কারো মালিকানায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ থাকলে, সেও নিজেকে সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা ভেবে নিয়ে, অনেক সময় নিজের ও নিজের পরিবারের করা সব ধরনের কাজকেই ‘জায়েজ’ মনে করেন। নিজের অপরাধ ঢেকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো নাক সিঁটকিয়ে আঙ্গুল তু্লে থাকেন অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর দিকে। যেন অপরাধী হওয়ার পূর্বশর্তই হলো দরিদ্র হওয়া কিংবা বস্তির বাসিন্দা হওয়া। এক্ষেত্রে বাস্তবতা কিন্তু অন্য কথা বলে। আর বাস্তব সত্য হল, একজন অপরাধীর জন্ম পরিচয় হতে পারে সমাজের যে কোনো অর্থনৈতিক স্তরে। দরিদ্র হলেই কোনো মানুষ অপরাধী হবে, আর ধনবান হলেই কো্নো মানুষ অন্যায়ের ঊর্ধে অবস্থান করবে, সেটা নাও হতে পারে।
তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, প্রকৃত ধর্মভীরুতার চেয়ে বাহ্যিকভাবে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা চর্চার দিকে মানুষের মনোযোগ বেড়ে যাওয়া। ধর্মভীরুতা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সেই শ্রদ্ধাবোধ, যা মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে যে কোনো ধরনের অন্যায় আচরণ থেকে বিরত রাখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আর বাহ্যিক ধর্মচর্চা হচ্ছে ধর্মীয় রীতিনীতি আচার-নিয়ম-নিষ্ঠা পালনের সেই প্র্যাকটিস যা মানুষকে সকলের চোখে ধার্মিক হিসাবে চিহ্নিত করে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো একজন মানুষ আন্তরিকভাবে ধর্মচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলে ছোট-বড় কোনো ধরনের অপরাধ করাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো মানুষ যদি মেকী বা ভন্ডামী বা লোকদেখানো ধর্মচর্চায় সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে সুযোগ মতোন সময়ে নৈতিকতার সীমালঙ্ঘন করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। এ ধরনের ব্যক্তি আসলে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক অনুশাসনের ধার ধারে না। যে কোনো ধরনের অপরাধ করা শেষে সে নির্দ্বিধায় প্রত্যাবর্তন করে নিজের ধার্মিকতার লেবাসে। এই যে Disidentification বা নিজেকে চিহ্নিত হতে না দিয়ে নিজের কৃত অপরাধগুলো আড়াল করার প্রচেষ্টা , এটিই আমাদের আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়।
বহু হিজাবধারী মহিলা আজকাল নানা অতিআধুনিক বা অসামাজিক কাজ করে থাকে আড়ালে আবডালে। বাড়িতে অতিথি এলে যে সুগৃহিণী অত্যন্ত রুচিশীল আবহে আদর-আপ্যায়ন করেন, তিনিই বহুক্ষেত্রে অতিথি চলে গেলে রান্নাঘরে গিয়ে কাজে ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে অশালীন বাক্যপ্রয়োগ করেন গৃহপরিচারিকার দিকে। আবার যে গাড়িচালক মালিক এবং তার পরিবারের সামনে বিনয়ের অবতার সেজে গাড়ির দরজা মেলে ধরে বা তাদের ব্যাগ বহন করে, সেই চালকই আবার রাস্তায় অন্য ড্রাইভারকে অসতর্কতার অভিযোগে কুৎসিত ভাষায় গালি দিয়ে থাকে। হয়তো যে বালিকাটি বাবার কাছে অভিমান-আবদারে কে এফসি, পিজ্জাহাটে যাবার বায়না ধরছে ইনোসেন্ট ভাবে, সেইই আবার একাধিক বয়ফ্রেন্ডকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে দিনের পর দিন। যে শিক্ষক ক্লাসে নিয়মানুবর্তিতা ও সততার লেকচার দিয়ে ছাত্রদের মন্ত্রমুগ্ধ করছেন, তিনিই কোচিংএ মাসকাবারির টাকা থুথু দিয়ে গুনে পকেটে ভরছেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে। যে লেখক/শিল্পী গণমানুষের কাছে রূপ-গুণ-মেধা-রুচির জন্য নন্দিত হচ্ছেন, তিনিই হয়তো রাতবিরেতে অভিসারে বেরিয়ে যাচ্ছেন প্রযোজক, পরিচালক বা বিত্তবানদের সাথে। যে আয়া বা গৃহপরিচারিকা কোনো শিশুর অভিভাবকের সামনে তাকে সোনা-ময়না-টিয়াপাখি বলে তুলুতুলু আদর দেখাচ্ছে, বাবা-মা কাজে বেরিয়ে গেলে সেই আয়াই হয়তো বাচ্চাকে মারধর বা নানা অবহেলা করছে। মাদার্স ডে/ ফাদার্স ডে’র দিনে যারা বাবা/মাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমের মাঠ সরগরম করছেন, তাদের অনেকেই দিনের পর দিন বাড়ির এককোণায় অবহেলায় ফেলে রাখছেন বৃদ্ধ বাবা-মাকে, অথবা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হচ্ছেন। প্রতিবেশীর উন্নতিতে যে মানুষটি সামনে পিঠ চাপড়ে বাহবা দিচ্ছেন, আড়ালে সেই ব্যক্তিই হয়তো তার চরম নিন্দুকের ভূমিকা পালন করছেন। কোনো তরুণীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যে যুবক রুবাইয়াৎ বা শেরশায়েরী বা ভ্যালেন্টাইন সং আওড়াচ্ছে, সেইই আবার প্রত্যাখাত হয়ে চারিত্রিক অপবাদ দিতে ছাড়ছে না মেয়েটিকে। অফিস শেষে যে স্বামী ঘরের গৃহিণীর জন্য ফুলের তোড়া বা সোনার অলংকার হাতে ঘরে ঢুকছেন, সেইই হয়তো বিকেলে পার্সোনাল সেক্রেটারী বা সহকর্মী মহিলার সাথে প্রেমালাপ লীলা খেলে এসেছেন।
এই যে দ্রুত এক ভূমিকা থেকে আরেক ভূমিকায় নিজেকে প্রতিস্থাপন, এর জন্য যে দক্ষতা ও কূটবুদ্ধি প্রয়োজন, তা মানুষের মধ্যে বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। সেজন্য অবশ্য মূল দায়ী হিসাবে আকাশ সংষ্কৃতির দিকে আঙ্গুল তোলা যায়। সাথে যুক্ত করা যেতে পারে সুস্থ বিনোদন না থাকা কিংবা সততার অভাবের মতো কারণগুলোকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রোড এক্সিডেন্টে মৃতপ্রায় মানুষের মুখে একফোঁটা পানি দেয়া বা তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার চেয়ে, আশেপাশের মানুষ আজকাল অনেক সময় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে আহত/নিহত মানুষটির সাথে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিতে। এই দুষ্কর্মগুলো যারা করছে, তারাও কিন্তু নিজ পরিবার বা সন্তান-সন্ততির কাছে ভালোমানুষ হিসাবেই চিহ্নিত অথবা ভালোমানুষ সেজে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে নিঁখুতভাবে। কিংবা হয়তো তার পরিবারেরও ইন্ধন আছে এ কাজে, কিন্তু আশেপাশের মানুষের কাছে তারা সুশীল-ভদ্র-সভ্য-সজ্জন হিসাবেই পরিচিত।
আজকাল যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে, যেসব নিউক্লিয়ার পরিবার চালু হয়েছে, সেখানে বেড়ে ওঠা সন্তান-সন্ততি বঞ্চিত হচ্ছে মুরুব্বী শ্রেণীয় আত্মীয়দের কাছ থেকে শেখা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শেখার ও চর্চা করার সুযোগ থেকে। এর ফলে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মিডিয়া তার সমুখে যেসব চটুল চারিত্রিক গুণাবলী ও মূল্যবোধ তুলে ধরছে, সেগুলোকেই সে মডেল হিসাবে ধরে নিয়ে, সেগুলোর চর্চা করছে অতি উৎসাহে।
আজকাল আবার বহু পরিবারেই বাবা-মা উভয় অভিভাবকই কর্মজীবি। ফলে সন্তান-সন্ততির চারিত্রিক বিকাশে প্রয়োজনীয় গুণাবলী শিক্ষা দেয়ার জন্য যে সময় ও শ্রম দেয়া প্রয়োজন, তা ইচ্ছা-অনিচ্ছা যেভাবেই হোক বের করা তাদের জন্য সম্ভবপর হচ্ছে না। ফলে তাদের সন্তানেরা জীবনধারনেরর জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বা আধুনিক উপকরণসমূহ সহজেই হাতের কাছে পাচ্ছে, কিন্তু জীবনযাপনের সঠিক মূল্যবোধ শেখার ক্ষেত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় এখানে না উল্লেখ করলেই চলে না। তা হচ্ছে, আজকাল গ্লোবালাইজেশনের ফলে পুরো বিশ্বকে গণ্য করা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ হিসাবে। বেড়ে গেছে একদেশ থেকে আরেক দেশে, এক উপমহাদেশ থেকে আরেক উপমহাদেশে মাইগ্রেশন বা দেশান্তর/স্থানান্তরের হার। ফলে এসব পরিবারের সন্তান-সন্ততি দুই বা ততোধিক সাংষ্কৃতিক মুল্যবোধ বা different cultural values এর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। বাংলায় এরকম প্রবাদ আছে, “একদেশের বুলি, অন্যদেশের গালি”, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক্ষেত্রে। একটি বাড়ন্ত বয়সী শিশু বা কিশোর পরিবারের সাথে বিদেশে অবস্থানকালে বাড়িতে হয়তো একরকমের মূল্যবোধ শিখছে, আবার বাড়ির বাইরে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ থেকে গ্রহণ করছে বা এডাপ্ট করছে অন্যরকমের মূল্যবোধ বা cultural values. ফলে এসব মানবসন্তানের মধ্যে তৈরী হয় Conflict of values বা মূল্যবোধের দ্বান্দিক সংঘর্ষ। ফলে ন্যায়/অন্যায়, উচিত/অনুচিত বোধের ক্ষেত্রে তার মধ্যে ধোঁয়াশার মতো অস্পষ্ট ধা্রণা/মতামত বা vague ideas তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্যে বেড়ে ওঠা কোনো মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে, কোন্ রীতিনীতি বা আচরণপন্থা আসলে সঠিক অথবা কোন আচরণটি নৈতিকতার মানদন্ডে ভালো/মন্দ কোন্ স্তরে পড়বে?
কিন্তু অবচেতনে নিজের কৃত অপরাধসমূহকে অস্বীকার করেই হোক বা নিজের ছোট-বড় অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দিয়েই হোক, অপরাধ আসলে অপরাধই, আর যে ব্যক্তি অপরাধ সংঘটিত করে সে দোষী। একে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। কাজেই, দোষী ব্যক্তি বা অপরাধী যত দক্ষতার সাথেই নিজের দোষ ঢেকে বা লুকিয়ে চলুক বা অপ্রত্যক্ষ রাখুক তথা Disidentification করার চেষ্টা করুক না কেন, তাতে তার পাপ লঘু হয়ে যায় না বিধায়, যথোপযুক্ত শাস্তিও তার পাওনা হয়ে যায়। সে শাস্তি হতে পারে বিধাতার তুলাদন্ডে ন্যায় বিচারে বা মানুষের গড়া আদালতে অথবা Natural justice এর মাধ্যমে।
সবশেষে বলা যায়, অপরাধী ধনী/দরিদ্র, বাহ্যত সজ্জন/দুষ্কৃতিকারী, ধার্মিক/বকধার্মিক যাই হোক না কেন, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। “বিচারের বাণী যেথা নিভৃতে কাঁদে” একথা বলেই আমরা যেন আমাদের দায় না সারি। অপরাধীকে চিহ্নিত করে তার উপযুক্ত শাস্তি প্রদানে নিশ্চেষ্ট না থাকি। এ ব্যাপারে দৃঢ়চিত্তে আমাদের সকলের ভূমিকা স্মরণে রেখে সামাজিক দায়িত্ত্ব পালন করলে তা হবে মানবকল্যাণের পথে আরেক ধাপ অগ্রগতি।
“অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন, তৃণ সম দহে” - একথা মাথায় রেখে আমাদের প্রত্যেকেরই এব্যাপারে নিজ নিজ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একটি প্রকৃত সুশীল সমাজ গঠন করা।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী নিবন্ধ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ও নিরন্তর শুভকামনা।
মুছুন