কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

শুভলক্ষ্মী ঘোষ



রথযাত্রা উৎসব


যথাসময় নিমন্ত্রণপত্র আসিয়া উপস্থিত হইল। বার্ষিক রথযাত্রা উৎসব এবং আনুষঙ্গিক রথের মেলা, বিচিত্রানুষ্ঠান, সঙ্গীতসন্ধ্যা, ভোগ বিতরণ। আমন্ত্রণের কোনো ত্রুটি নাই। ব্যবস্থাপনাও সুষ্ঠু। সুতরাং নিমন্ত্রণ রক্ষা না  করিয়াই বা উপায় কী?
যথাকালে পত্রে বর্ণিত স্থানে পৌঁছাইয়া দেখিলাম বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়া সাড়ম্বরে রথ প্রস্তুত করা হইতেছে। সহস্রাদি মানুষ রথের দড়িটি  একটিবার স্পর্শ করিবার নিমিত্ত ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। চতুর্দিকে ‘জয় জগন্নাথ’ রব, উল্লাস-ধ্বনি আকাশ-বাতাস আমোদিত করিয়া  তুলিয়াছে। সমাজের সম্মানীয় অতিথি অভ্যাগতগণ রথের সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রফুল্লচিত্তে সাংবাদিকগণকে নিজেদের সাক্ষাৎকার দিতেছেন! আমি সন্তর্পণে  ভিড় ঠেলিয়া শতাধিক মানুষের কনুইয়ের গুঁতা এবং পদ-সঞ্চালন উপেক্ষা করিয়া এক পার্শে দাঁড়াইলাম। বাস্তবিকই এ এক মহাসমারোহ। তিন  তিনখানি রথ আপাদমস্তক মূল্যবান বস্ত্র ও পুষ্পরাজি দ্বারা সুসজ্জিত। জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার কাষ্ঠনির্মিত বিগ্রহ প্রসাধন এবং চন্দন চর্চিত হইয়া গুড়িঞ্চা মাসীর গৃহযাত্রা হেতু নির্দিস্ট রথে উপবিষ্ট হইয়া আছেন। সম্মুখে পুরহিতকুল, ভক্তকুলের দিকে ছুঁড়িয়া দিবার নিমিত্ত ফল-মিস্টান্নাদি পাত্রে গুছাইয়া রাখিতেছেন। রাজপথের দুই পার্শে অগুনতি বিপণন সামগ্রী--  নিমকি, গজা, নিখুতি, কটকটি, আচার, পাপড়, কাচ ও কাষ্ঠ নির্মিত খেলনা, কাগজের হাতপাখা প্রভৃতি নানাবিধ বস্তু এই মহাযজ্ঞের সাক্ষী হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে…
সহসা তীব্র কোলাহল শুনিয়া রাজপথের অপর প্রান্তে দৃষ্টি চলিয়া গেল। দেখিলাম শ্বেতহস্তির ন্যায় তিন তিনখানি সুবিশাল বহুমূল্যবান বাহন, একে অন্যের পশ্চাতে সশব্দে আসিয়া উপস্থিত। বাহনত্রয়ের চতুর্পার্শে আরোক্ষীগণ স্বস্ত-ব্যস্তে ঘোরাঘুরি করিতেছে, ঈশ্বর সম্মুখে সুরক্ষা হেতু উহাদিগের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র! অতঃপর, শ্বেতশুভ্র বস্ত্র এবং ত্রিবর্ণ উত্তরীয় সজ্জিত পাত্র-মিত্র-স্তাবক পরিবেষ্টিত এক রাজন গাড়ি হইতে রথ-সম্মুখে  আসিয়া দাঁড়াইলেন। বোধ হইল, ইনিই সেই সম্মানীয় মহামহিম, যাঁহার  হস্তে আজ রথের রশিতে প্রথম টান পড়িবে। সত্যই, ঈশ্বরের কী অসীম  সৌভাগ্য! রাজন দুই হস্ত জোড় করিলেন। কৌতুহল হইল ... বড় সাধ জাগিল, এই মহারথীর প্রার্থনা জানার। সবার অলক্ষ্যে ওনার নিকটে যাইলাম। শুনিলাম, অস্ফুট স্বরে কহিতেছেন, “হে ঈশ্বর, তোমার যাহা কিছু অভিপ্সা, যা‌হা কিছু সাধ, আহ্লাদ, তোমার নিমিত্ত মন্দির, গহনা, বিগ্রহ... যাহা কিছু প্রয়োজন... সব ... সব ইচ্ছা আমি পূরণ করিব”!
আমার বাকরুদ্ধ হইয়া গেল। এই ধৃষ্টতা, এই অহম, আমার মনকে ব্যথিত করিয়া তুলিল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। আমার সেই দীর্ঘশ্বাস আকাশে  বাতাসে বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার করিল... ধুলিঝড় ঢাকিয়া দিল চতুর্দিক।  আমি চক্ষু মুদিলাম। দু’ফোঁটা অশ্রু বর্ষার সহস্র বারিধারা হইয়া ধরিত্রীর বুকে ঝরিয়া পড়িল। আমি অদূরে দাঁড়াইয়া দেখিলাম, সেই ছত্রভঙ্গ জনশূন্য রাজপথে ভয়াবহ ঝড়-জল তুচ্ছ করিয়া তিনটি অর্ধনগ্ন শিশু পুঁতির মালা ও ছিন্নপত্র সজ্জিত একখানি কাঠের রথ এবং তাহাতে তিনখানি ক্ষুদ্র মলিন মাটির বিগ্রহ লইয়া উৎফুল্ল চিত্তে ছুটিয়া যাইতেছে! অবচেতন অন্তরে পাঠানো শিশুদিগের সেই বাহুল্যবর্জিত নিমন্ত্রণ আমি সাদরে গ্রহণ করিলাম। বার্ষিক রথযাত্রা উৎসবের শুভ সুচনা হইল...         

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন