ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(দ্বিতীয় অধ্যায়)
(৪)
আল সুলতান আল আজম্ ওয়াল খাকান
আল মুকারম জাম–ই –সুলতানত্-ই –হাকিকী ওয়াহ্ মজাজই সইয়দ-আল-সালতিন আবুল মুজফ্ফর
নাসিরউদ্দিন মহম্মদ হুমায়ুন পাদশাহ ঘাজী জিলুল্ – লাহ্... হা-জী-র!
অপূর্ব এক দার্ঢ়্যময় ভঙ্গীতে হুমায়ুন
এসে বসলেন মসনদে। তাঁর পরনে আজ
নিমচা জামাহ্। সম্রাটের জন্য তৈরী যুদ্ধের বিশেষ পোষাক এটি। দু’পাশে যতদূর চোখ যায় মোগল আমীর ওমরাহরা সারিবদ্ধ
দন্ডায়মান। শিবিরের বাইরে কিছুটা দূরে ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট দৃশ্যমান প্রায় লক্ষাধিক
মোগল সৈন্য। বলা বাহুল্য এ সৈন্য হুমায়ুনের নয়। তবু এই নিয়ম এই কেতা দুরস্ত হওয়া
ছাড়া অন্য উপায় নেই।
শের শাহর পুত্র খাওয়াস খাঁএর
দূতটি বয়সে অত্যন্ত তরুণ, সুপুরুষ। গালিচা পর্যন্ত ঝুঁকে সম্রাটকে কুর্ণিশ করল।
হুমায়ুন চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। শূন্যে সামসির খঞ্জরের ধাতব শব্দ। পাকানো লাল রেশমের কাপড়ের টুকরোটি খুলে দূত
ততক্ষণে কীসব পড়তে শুরু করে দিয়েছে। অতি দুর্বোধ্য আফগানী বুলি। সভায় উপস্থিত কেউই
তার এক বর্ণ বুঝতে পারছে না। হুমায়ুনের চক্ষু দুইটি শুকনো, কোটরাগত। বিবর্ণ ওষ্ঠ।
ঘরে বাইরে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। কী
করবেন তিনি? আফিম খেয়ে এমনই নেশাগ্রস্ত যে বসা অবস্থা থেকেই মসনদের ওপরেই ঢলে
পড়লেন। উপস্থিত জনতা নির্বাক নিশ্চুপ। খাওয়াস খাঁএর দূত মাথা চুলকোতে চুলকোতে ফিরে
চলল। ভালই হল- যেতে যেতে ভাবল সে। আজ হোক কী কাল,যুদ্ধ তো হবেই!
নিজের শিবিরে বসে দিলদার বেগমের
মাথায় হাত। হুমায়ুন তাঁর গর্ভ প্রসূত নয় বটে কিন্তু সে তো তামাম হিন্দুস্থানের
বাদশা। শাহী বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান যাবতীয় নাম ও নিশানের উত্তরসুরী। তার এমন পরিণতি
অসহ্য। সুতরাং যে করেই হোক হুমায়ুনকে আবার হিন্দুস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।
ইনসা আল্লাহ্! আ-মী-ন্! সত্যি বলতে কি এই মুহূর্তে জননী দিলদার বেগম ছাড়া হুমায়ুনের পাশে আর কেউ নেই। সম্রাটের তিন তিনজন
পত্নী আয়েষা বেগম, বেগা বেগম, কোকা বেগম সকলেই মৃত। শের শাহর সৈন্যরা কবেই তাদের গঙ্গায় ডুবিয়ে মেরে
ফেলেছে। এমন কী ছয় বৎসরের শিশু আকিকা বেগমও
বাদ যায়নি। জায়গাটা ছিল বাংলার সরহদের কাছাকাছি। কারুর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শাহী বজরায় শত্রুরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। আগুন গ্রাস করেছিল সব।
দিলদার বেগম চোখ বন্ধ করে খোদার
কাছে আকুল প্রার্থনা শুরু করলেন। জল বেরিয়ে এল চোখ দিয়ে কিন্তু আর কত কাঁদবেন?
কাঁদলেও এই অন্তর্জ্বালা যে জুড়োয় না!
দিলদার বেগমের নিজস্ব সত্তর জন
নৃত্যবালা, জরুরী তলব গেল তাদের নিকটে। সন্ধ্যায় আজ জমাটি নাচ গানের আসর বসাতে
হবে। তখন সুরাহী ভর্তি থাকবে তুরস্ক দেশীয় পানীয় দিয়ে। সোনার থালায় থরে থরে সাজানো
থাকবে শাহরুখি। খুশী হলে ইনাম দেবেন সম্রাট। স্বয়ং দিলদার বেগমের পক্ষ থেকে সম্রাটকে
আজ দেওয়া হবে সদফি আশরফি ভরা চল্লিশটি খাঞ্ছা (ঝুড়ি)। তক্ষুনি কাসেদ মারফৎ হুমায়ুকে পত্র পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ
পাঠালেন দিলদার বেগম। তিনি জানেন, যতই বিভ্রম থাক জননীর ডাক উপেক্ষা করবার মানুষ নন হুমায়ুন। এজন্য প্রজারা
সম্রাটের নামই দিয়েছেন, ইনসান-ই-কামিল।
কিন্তু আজ হুমায়ুন নর্তকীদের
দিকে মুহূর্তের জন্যও দৃকপাত করলেন না।
যেন এ পৃথিবীতে তিনি সম্পূর্ণ একক,
এমনই তাঁর মুখভঙ্গি। যদিও ঋজু দীর্ঘ শরীরখানি শামসিরের মতই ঝকঝকে, কিন্তু দুই চোখে
ক্লান্তি আর যন্ত্রণার তীব্রতা। ঝাড়বাতির আলোয়
বাদামী বর্ণের শশ্রুগুম্ফ সমন্বিত পেলব মুখখানি বড় করুণ দেখালো। কাতর কন্ঠে বললেন,
মা কাউকে পাঠিয়ে একবার হামিদাকে ডাকা যায় না?
আ-মি-ন!
মা সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়ে
দিলেন। ডান হাতের আঙ্গুলের হীরক আংটিটির উপর বৃদ্ধঙ্গুষ্ঠ চেপে ধরে অধীর আগ্রহে
অপেক্ষা করতে লাগলেন হুমায়ুন। সময় যেন আর কাটে না। শিবিরের বাইরে মৃদু্মন্দ বাতাস
বইছে। কোন তিথি আজ কে জানে!
নূপুরের ঝঙ্কার তুলে নৃত্যবালারা কক্ষের দূর কোণে ত্রিভুজাকৃতি দাঁড়িয়ে। মেঝেয়
পারস্য দেশীয় গালিচায় লাল গোলাপি বর্ণের সূক্ষ্ম কারুকার্য... সেখানে নাগরা পরা
দুটি পা এসে কুর্ণিশ করল বলে...
একলাই ফিরে এল কাসেদ। হামিদা
আসেনি। উপরন্তু বলে পাঠিয়েছে,
যদি বাদশাকে সালাম করার প্রথা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তো সেই প্রথা আমি প্রথমেই
পালন করেছি। এখন আবার কিসের জন্য যেতে হবে?
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল দিলদার
বেগমের। বত্-তমিজ্ আউরাত! মাত্র সাধারণ একজন ওমরাহর কন্যার এতটা আস্পদ্দা! তক্ষুনি
গরম চক্ষে কাসেদকে হুকুম দিলেন, ‘এক্ষুনি
খবর পাঠাও মীর বাবা দোস্তকে।’ দিলদার বেগম এবার নিজেই যাবেন হামিদার ওয়ালিদের
কাছে। এই জেনানাকে এক্ষুনি এটাই বোঝানো দরকার যে স্বয়ং হিন্দুস্থানের বাদশা
হামিদাকে কাছে পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এতে তার গর্বিত বোধ করা উচিত। নেহাৎ
কন্যার পিতা নিজেদের আত্মীয়, নয়ত...
ওদিকে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে তখনও
হুমায়ুন একদৃষ্টে নিজ আঙ্গুলের হীরক আংটিটির দিকেই চেয়ে রয়েছেন। এসব কথপোকথন তাঁর
কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে কি না বোঝা দুষ্কর। বাদশাহর মনের মধ্যে কবি শুধু কানে কানে
বলে চলেছেন, ‘অ্যায় খুল বতুখুর সনদম্ তু
বু আয়ে ক্যায়সে দারী...’
‘ওগো ফুল এখনো আমি তোমার প্রতি মুগ্ধ, তোমাতে ও
কিসের সৌরভ?’
প্রায় চল্লিশ দিন ধরে হামিদা
বানু আর হুমায়ুন জননীর বাগ বিতন্ডা চলেছিল। অত সহজে হুমায়ুনকে নিকাহ্ করতে রাজী হয়
নি দ্বাদশ বর্ষীয়া হামিদা। দিলদার বেগম বলেছিলেন, তুমি এখনও অনুঢ়া। কিন্তু একদিন
না একদিন তোমাকে তো কোনও পুরুষকে শাদী করতেই হবে। তাহলে বাদশার প্রস্তাবে রাজী হচ্ছ না কেন? এমন সৌভাগ্য খুব কম
মেয়েরই হয়।
মেধাবী এবং প্রখর স্মৃতি
সম্পন্না হামিদা তখনই জবাব দিল, হ্যাঁ কোনও পুরুষকেই আমাকে বিয়ে করতে হবে, কিন্তু
বাদশাকে বিয়ে করলে তাঁর দর্শন লাভের জন্য আমাকে ধৈর্য্য ধরে দিনরাত সাধনা করতে হবে।
তবে কেন আমি তাঁকে বিয়ে করব?
ছিঃ! অমন কথা বলতে নেই। বাদশা
খোদার প্রতিবিম্ব। শাহী মহলে তো আরও কত মহিলা রয়েছে, কিন্তু বাদশা শুধু তোমাকেই কামনা করেছেন। তোমার যাওয়া উচিত।
জড়ি চুমকি বসানো রক্তবর্ণের
রেশমী কুর্তা পরা হামিদা তুরন্ত জবাব দিল,রেওয়াজ অনুযায়ী বাদশাহকে একবার চোখে দেখা যায়। দ্বিতীয়বার দেখা হওয়াটা না-জায়েজ।
অর্থাৎ অবৈধ। কারণ তিনি পরপুরুষ।’
কথাটা কানে গেল হুমায়ুনের।
সারেঙ্গী নূপুর নিক্কনের মাঝেও শুনে স্মিত হাসি ফুটল মুখে, এই প্রথম।
কেয়া বাত্! এখন আমি পরপুরুষ!
কিন্তু কাল তো আপন হতেও পারি!
তারপর প্রবল বাদ্যধ্বনি জয়ডঙ্কা
আলো রোশনাই ও ঠুংরির মিষ্টি সুরের মধ্য দিয়ে এক নিশিভোরে বাদশা ঘাজী হুমায়ুনের সঙ্গে নিকাহ সম্পন্ন হল হামিদা বানুর। সময়টা ৯৪৮ হিজরী
জমদিয়াল আউয়াল মাস,মঙ্গলবার। কাজীর ভূমিকা পালন করলেন মীর আবুল বকা। দক্ষিণা
স্বরূপ তাঁকে উপস্থিত দুই লক্ষ টাকা প্রদান করা হল। বিবাহবাসর অনুষ্ঠিত হল
মূলতানে। জায়গাটি ছিল সাতটি নদীর সঙ্গমস্থল। নিকাহত্তোর খানাপিনা ছিল বাদশাহী
ঘরানার। পাঁচশো খাসীর মাংস, শরবৎ তন্দুরি রুটি বিভিন্ন ফল এবং ভোজন অন্তে হাত মোছা হল রুমালী রোটী দিয়ে।
মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নেচে চলল নর্তকীরা। সুরা ও শরবতের ফোয়ারার মাঝে আমীর ওমরাহের
দল চিন্তান্বিত, হিন্দুস্থানে বাদশা কি আর ফিরে
যেতে পারবেন কখনও? এখনও যেন পুরোপুরি ঠিক হয় নি হিন্দুস্থান নামক ভূ-খন্ডটি কাদের?
সন ১১৯২ পর্যন্ত হিন্দুরা মনে করত দেশটা শুধু তাদেরই। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ সন
১১৯৩এ পৃথ্বিরাজ চৌহান গো-হারান
হেরে গেল। এল মুসলমানেরা। এই সমুদ্র মেখলা পর্বত মুকুট পরিহিত পূণ্যভূমিটিকে সৌগরবে দখল করল। মুসলমানরা যদিও পাঠান
আফগান মোগল ইত্যাদি নানান আভ্যন্তরীণ
ভাগে বিভক্ত, তবু এই দেশেই এক এক করে তাদের পুত্র কন্যারা জন্মালো। ধর্মে কৃষ্টিতে
সংস্কৃতিতে তারা মিশে গেল হিন্দুস্থানের মাটির সঙ্গে। প্রকৃতির সঙ্গে। তবু হিন্দুদের সঙ্গে রয়ে গেল তাদের প্রবল পার্থক্য।
ঘনালো হিন্দু মুসলমানের
বিদ্বেষ। হিন্দুস্থান তবে কার?
নেশার ঘোরে এক ওমরাহ চেঁচিয়ে
বলেই ফেলল, জাঁহাপনা আপ ডরিয়ে মত্! আপকো হামলোগ ফিন সারে হিন্দুস্থানকে বাদশা বনা
দেঙ্গে!’’
ওদিকে কম্পিত বক্ষ সম্রাট
দ্বিধান্বিত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সাদাতখানার অন্দরে। কক্ষটি জুড়ে জায় নামাজ
বিছানো। মধ্যিখানে জারদৌজ গদি ও পিশতোকে মোড়ানো উঁচু পালঙ্ক। পালঙ্কে ওঠার
প্রত্যেকটি ধাপে নেহালচি, তাতে চন্দনকাঠের আতরদান। স্বর্ণপাত্রে সদফি শাহরুখি,
রৌপ্য পাত্রে পীচ চেরী খোবানি ভর্তি। সমস্ত পালঙ্কখানি রেশমের কালিন দ্বারা
আচ্ছাদিত। মাথার ওপরে আজ দুইশত মোমের ঝাড়। ঠিক তারই নীচে বেগম হামিদা বানু বসে।
অঙ্গে লাচক কাসাবা। বিবাহিত মোগল নারীদের গলাবন্ধ পোষাক এটি। পালঙ্কে ওঠার প্রথম
ধাপটিতে পা রাখলেন হুমায়ুন। অনুমতি সাপেক্ষে পালঙ্কের চারধারে যে হৌজ, সঙ্গে সঙ্গে
তাতে সুগন্ধি জল ছেড়ে দেওয়া হল। বাদশা বেগম আজ প্রথম একান্তে মিলিত হচ্ছেন।
হামিদার পোষাকটিতে পরপর লাল
ইয়াকুত জামরুদ পান্না মুক্তো বসানো। সেই পোষাকটি স্বহস্তে উন্মুক্ত করলেন বাদশা। মাথা ঝিমঝিম করে
উঠল তাঁর। আয়েষা
বেগম, বেগা বেগমরা প্রচুর সাজসজ্জা
করে মিলিত হতেন স্বামীর সঙ্গে। প্রত্যেকেই তাঁরা হুমায়ুনের অত্যন্ত বাধ্য ছিলেন।
রতিক্রিয়া জনিত আনন্দ বা যন্ত্রণা
কোনওটারই অভিব্যক্তি তাদের মুখে ফুটে বেরত না। সম্রাটের নিজস্ব নৃত্যবালারা আবার
অত্যন্ত নির্লজ্জ। তারা চৌষট্টি কাম কলায় পারদর্শী। নাঃ, এরা কেউই হুমায়ুনের অন্তর্নিহিত আবেগের মূল্য দিতে পারেনি।
হামিদার মুখখানি অপূর্ব
দেখাচ্ছে। হুমায়ুন নিজের ওষ্ঠ দিয়ে তার ওষ্ঠটি স্পর্শ করলেন। কিন্তু চুম্বন করলেন
না। তারপর তিনি হামিদার দাঁত চুল নাভী কোমর একে একে ছুঁয়ে দেখলেন। হীরক বসানো দশ
আঙ্গুল বেগমের স্তনের ওপরে স্হাপন করলেন, কিন্তু তাকে আন্দোলিত করলেন না। হামিদা শান্ত হয়ে শুয়ে। তার দুই চোখের
দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে উচ্চারণ
করলেন হুমায়ুন, ‘শাদী মুবারক হো বেগম! আমরা
দুজনেই হিন্দুস্থানে ফিরে যাব!’
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন