একজন
'ফান্টুস' পাঠক ও ফিকশনের
ফাঁদ
যখন বলি দুইদশক কোনও নতুন বাংলা ফিকশন পড়িনি, তখন কথাটা হয়তো অনেকটাই ঠিক, অথচ ভুলও বটে। কিন্তু কেন এই জাতীয় আঁতলেমি? একজন ইতর পাঠক হিসেবে এতদিনের পণ্ডশ্রম থেকে যা বুঝেছি সেটা লিখে দেওয়াই শ্রেয়।
এই
জীবন আমাদের সঙ্গে নানারকম রঙ্গ করে। যত বয়স বাড়ে তত ঐ রঙ্গের ফর্মুলাটি ধীরে ধীরে ধরাছোঁয়ার মধ্যে এসে যায়। মায়াবী রহস্যের ঘেরাটোপটুকু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার রূঢ় স্পর্শে ছিন্ন হয়ে যায়। বড় লেখকরা ফর্মটা নেন ইল্যুশনের,
কিন্তু লক্ষ্য থাকে দূরে। তাঁদের কম বয়সের লেখাতেও তিন-চার দশক পরে তাঁরা
"জীবন লইয়া কী করিবেন" তার আভাসটা আগেই লেখার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়। যাঁরা অল্পশক্তির কথাকার, তাঁরা এই মুহূর্তের ইল্যুশনটুকু নিয়েই মোহগ্রস্ত হয়ে যা'ন। তাঁরা জানেন তিন-চার দশক পরে তাঁদের লেখা কেউ পড়বে না। তাই তেলেভাজার শিল্প চাষ করেই দশতলা তুলতে চান। তাঁদের লেখা পড়তে শুরু করি। কিন্তু একটু এগিয়েই আগ্রহ হারিয়ে যায়। আসল হেমন্ত যখন হাতের নাগালে আছেন,
তখন 'হেমন্তকণ্ঠী'দের নিয়ে কী করবো!
যাঁরা 'বড়' লেখক,
তাঁদের থেকে প্রথম শিখি তাঁদের বাক্যগঠন,
অর্থাৎ ক্রিয়াপদটি কীভাবে ব্যবহার করছেন। যেমন বলা হয় না, নতুন অভিনেতাদের সব থেকে বড় সমস্যা হাতদুটো নিয়ে কী করবেন? লেখার ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদকে নিয়ে খুব সমস্যা হয়। কারণ গদ্য নির্জীব হয়ে যায় ক্রিয়াপদের রিপিটেশনে,
অপটু ব্যবহারে। লেখা শুরু করার আগে বাক্যগঠনের এই দিকটা নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। যেমন গান গাইতে গেলে তানকারির বৈচিত্র্যটি ধরতে শিখতে হবেই,
তেমনি গদ্যে কর্তা,
কর্ম, ক্রিয়ার সঠিক প্লেসমেন্টা সবার আগে শিখতে হয়। সেটা আয়ত্ব না করে লিনিয়ার ন্যারেটিভকে গালাগাল দেওয়া বা লিখতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই কমলকুমার বা সন্দীপন হতে চাওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতাটি অধুনা খুব চোখে পড়ে। তারপর আসে বিশ্বাসযোগ্য, অথচ নতুন গদ্যভাষার সংলাপ লিখতে পারার প্রসঙ্গটি। গত বছর দশেক বা আরো কিছুদিন আগে থেকে দেখি কলেজ হস্টেলে বা একান্ত আড্ডায় ব্যবহৃত ডিকশনগুলিকেই 'আধুনিক'
যুগের ছেলেমেয়েদের মুখের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ প্রয়াস। সিরিয়ালের সংলাপ আর সাহিত্যের সংলাপ এক জিনিস নয়। একটার আয়ু কয়েক মিনিট, অন্যটা কয়েক দশক। গদ্যলেখায় আগ্রহীজনের জন্য অত্যন্ত জরুরি সঠিক শব্দগুলিকে
চিহ্নিত করার প্রয়াস করা। অনেক রথীমহারথীরা যা বলেছেন, সেটারই পুনরাবৃত্তি করি। সামগ্রিকভাবে গদ্য লেখার জন্য ধীশক্তির
চেয়ে শ্রমশক্তির প্রয়োজন বেশি।। প্রতিটা চরিত্র পাঠকের কাছে আসে বা দূরে চলে যায় শুধু সঠিকবেঠিক শব্দ ব্যবহারের তারতম্যে। এসব ব্যাপার আরো অনেক বিষয়ের মতো লেখার ক্র্যাফটের অঙ্গ।
বাঙালি পাঠকদের সম্বন্ধে এক লেখক বলেছিলেন,
তাঁদের দুটি ভাগ। বর্ণপরিচয়ের গোপাল আর রাখালের মতো।
'গোপাল' মানে তাঁরা যাহা পা'ন তাহাই পড়েন।
'রাখাল'রা কিছুই পড়েন না। সংখ্যাগুরু পাঠকের কাছে বই পড়াটাই একালে ভার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যাঁরা বই পড়াটাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে মনে করেন, তাঁদের জন্য অনেক নতুন বিকল্প সৃষ্টি হয়েছে কৃৎকৌশলের অগ্রগতির সঙ্গে। এই পাঠকগোষ্ঠীকে ধরে রাখার আকুল প্রচেষ্টা হিসেবে বহু লেখকই 'ইজি রিডিং' পদ্ধতির আশ্রয় নেন। এই পদ্ধতিটি চিরকালই ছিলো। আমাদের ছোটবেলায় দেবসাহিত্যকুটিরের
'প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপন্যাস' বা নবকল্লোল জাতীয় পত্রিকায়
'ইজি রিডিং' শর্তটি সম্পাদকীয় প্রাথমিকতা পেতো। এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে
'সুখপাঠ্য' শব্দটি কাছাকাছি যায়। লেখাকে
'সুখপাঠ্য' করার তাড়নায় অনেক
'প্রতিষ্ঠিত' লেখকও সেকালে আপোস করেছেন শিল্পের শর্তের সঙ্গে। তাঁরা ব্যক্তিগত আত্মগ্লানিকে সান্ত্বনা দিতেন অর্থকরী কারণ দেখিয়ে। কারণটি নিঃসন্দেহে অস্বীকার করা যায় না। কমোডিটি রাইটিং সর্বদেশে সর্বকালে আছে। কিন্তু দশক তিনেক আগে দেখা যেতো একই লেখক একসঙ্গে সিরিয়স লেখালেখির প্রয়াসটাও চালিয়ে গেছেন। এঁদের মধ্যে সমরেশ বা সুনীল জাতীয় মুখ্য লেখকরাও ছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সুখপাঠ্য ও সিরিয়স ফিকশনের ভার্টিক্যালগুলি আড়াআড়ি ভাবে ভাগ হয়ে গেছে। সুখপাঠ্য ফিকশনের সমস্যা হলো,
সাহিত্য জীবনের যেসব ব্যথা, বেদনা, আনন্দ,
সংকট, বিকৃতি, বীভৎসতার জটিল জগৎকে বিশ্বস্তভাবে ধরতে চায়, তার জায়গা এই ধারায় নেই। সংবাদপত্রের রিপোর্তাজ বা টিভি-সিরিয়লের চিত্রনাট্যকে অভীষ্ট ভেবে দিস্তা দিস্তা ফিকশন বাজারজাত হচ্ছে এবং গোপালদের বোধ হয় তারা উদ্দিষ্ট তৃপ্তিও দিচ্ছে। হতাশ লাগে, একটু বিস্ময়ও। এঁদের মধ্যে বেশ কিছু লেখক কিন্তু আপোস না করলে বাংলা ফিকশন উপকৃত হতো।
সৃজনশীল সাহিত্যের আসল জাদুটা দেখা যায় যখন এই মুহূর্তের লেখক চার দশক পরের পাঠকের মানসিক গতিবিধিটা পড়তে পারেন। সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করার শ্রম ও ঝুঁকিও নিতে দ্বিধা করেন না। এই প্রশ্নে আপোস করলে খুব 'দ্রুত'
প্রাক্তন হয়ে যেতে হয়। যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি জাগানো কথাকারেরা তিন-চারটি বই লিখেই নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করেন। ফুরিয়ে যান, হারিয়ে যান। শুধু একদামুগ্ধ পাঠকের স্মৃতিতে টুকরো টুকরো বরফের মতো ভাসতে থাকেন। এই পরিণতিটি সবারই দুর্ভাগ্য। একা লেখক বা পাঠকের নয়।
'প্রতিষ্ঠিত' লেখক বা
'নবীন' লেখকযশোপ্রার্থী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল থাকেন না। এটা চিরকালই আছে। যাঁরা ব্যতিক্রম,
সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁদের গল্প উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে থাকে। এখন তো বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের সঙ্গে আন্তর্জাল লেখালেখির একটা দ্বান্দ্বিক প্রতিযোগিতা ক্রমশ সামনে আসছে। অনেক শক্তিমান লেখকই 'প্রতিষ্ঠিত'
হতে পারেননি। কিন্তু বহু অল্পপ্রাণ লেখক যুদ্ধ করে তেলেভাজা শিল্পপতি হয়ে উঠতে পেরেছেন। তাঁদের আমি সম্মান করি। কিন্তু তাঁদের পাঠক হতে পারি না। সময় বড্ড কম। এত কিছু পড়ার বাকি আছে, বিশেষত নন-ফিকশন, গায়ের ও মাথার জোর বাকি থাকতে থাকতে যতটা শেষ করে ফেলা যায়, তত'ই মঙ্গল। তারপর যখন মাথা আর নেবে না, মেহনত করার শক্তি ফুরিয়ে যাবে, তখন আরাম করে বাংলা ফিকশন পড়া যাবে। তখনও অবশ্য কয়েকজন গোনাগাঁথা লেখকই লিস্টিতে থাকবেন, যাঁরা আমাদের সেরিব্রাল সম্ভাবনাগুলিকে অধিকার করে রেখেছেন দীর্ঘকাল ধরে। অবশ্যই তাঁদের অধিকাংশ গত বিশ বছরে নতুন কোনও ফিকশন লেখেননি।
তবু পাওনাদার পাঠকরা নিরাশ হ'ন না। তাঁদের 'পুরনো' লেখাও আরো পড়তে চা'ন। কিন্তু বাংলা ফিকশনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য
তা যথেষ্ট নয়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন