রুমিকে
মৌলানা জালালুদ্দীন রুমি
ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন পারসি কবি, মুসলমান দরবেশ ও সুফি সাধক। রোজকার জীবনযাত্রার
মধ্যেই তিনি আধ্যাত্মিক পৃথিবীকে খুঁজেছেন। ১২০৭সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ
করেছিলেন এই কবি, আর তারপর থেকে তাঁর কবিতা আফগানিস্থান, ইরান, তাজিকিস্থানের
বাইরেও সারা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত সমাদর পেয়ে এসেছে। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর
অসংখ্য কবিতা। এখনকার আফগানিস্থানের বাল্খ শহরে তাঁর জন্ম। পিতা বাহাউদ্দীন
ওয়ালাদ ধর্মশাস্ত্রের একজন পন্ডিত ছিলেন। ১২১৫ থেকে ১২২০ সালের মধ্যে যখন মোঙ্গলরা
মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে, রুমি তাঁর পরিবার ও কিছু অনুগামীর সঙ্গে বাল্খ ত্যাগ
করেন। অনেক মুসলমান অধ্যুষিত দেশের ওপর দিয়ে ভ্রমণ করেছেন তখন তাঁরা। মক্কার তীর্থ
সেরে শেষ পর্যন্ত কন্যা শহরে, যা এখনকার পশ্চিম তুর্কে অবস্থিত, তাঁরা থেকে যান।
রুমি তাঁর পিতার শিষ্য সৈয়দ বুরহান উদ্দীন মুহাক্কিক
তারমাজির কাছে সুফির গূঢ় সাধনতত্ব্ব শিখতে থাকেন। ১২৩১ সালে রুমির পিতা প্রয়াত হন,
ফলে বংশানুক্রমিক ভাবে সেই ধর্মগুরুর স্থানে তিনি প্রতিষ্ঠা পান। কন্যার মসজিদে
তিনি শাস্ত্র শিক্ষা দিতেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই ধর্মশাস্ত্রের জ্ঞানী হিসেবে রুমি
প্রসিদ্ধি লাভ করে ফেলেন।
১২৪৪ সালে তাবরিজ-এর একজন দরবেশ, শামসুদ্দীনের সঙ্গে রুমির
আলাপ হয়। আর সেই আলাপ ক্রমশ গভীর
বন্ধুত্বে পরিণত হয়। শামসুদ্দীন যখন দামাস্কাসে চলে যান, সেখানে রুমিরই একজন
শিষ্যর হাতে তিনি খুন হয়ে যান। খুনের কারণ আর কিছু না, শুধুমাত্র হিংসা। আর এই ঘটনা বা আঘাত
রুমিকে বদলে দেয়। এই দুর্ঘটনাটি না ঘটলে
বোধহয় আমরা কবি রুমিকে পেতাম না, তিনি একজন ধর্মগুরু হিসেবেই থেকে যেতেন। বন্ধুকে
উৎসর্গ করে এরপর একের পর এক কবিতা, গান ও নাচ তিনি সৃষ্টি করতে থাকেন।
এর দশ বছর বাদে রুমি গজল লিখতে থাকেন যার নাম হয় দিওয়ানি
কবির বা দিওয়ানি শামস-ই তাব্রিজ-ই। এরপর রুমির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এক
স্বর্ণকারের, যার নাম ছিল সালাউদ্দীনই জারকুব (জ্যাকব)। সালাউদ্দীন মারা গেলে রুমি
তাঁরই শিষ্য হুসামুদ্দীন চালাবিনকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচিত করেন। শেষ জীবনের বেশির
ভাগ দিন রুমি আনাতোলিয়ায় কাটান, যেখানে রুমি তাঁর জীবনের সেরা কাজ, মাসনাভি-র ছটি
পর্ব লিখেছিলেন।
দিওয়ানি শামস-ই তাব্রিজি
বা দিওয়ানি কবির রুমির বিখ্যাত গজলের সমগ্র, যা সেই সময়ের ‘দারি’ উপভাষায় লেখা
হয়েছিল। পারস্যের সাহিত্যে এই সমগ্রটি আজও অমূল্য। মাসনাভি হলো ছটি পর্বের কবিতা
সমগ্র। এই সমগ্রটি পুরোটাই নীতিশিক্ষামূলক।
সেই সময়ের হুসামুদ্দীন চালাবিনের পরামর্শে এই কবিতাগুলি লেখা হয়েছিল। মাসনাভির
কবিতাগুলিতে আধ্যাত্মিক জীবনের বিভিন্ন পর্বগুলিকে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাঁর
গদ্যগুলির মধ্যে বিখ্যাত ‘ফিহি মা ফিহি’ সাধারণ মধ্যবিত্ত নারী পুরুষদের নিয়ে
লেখা, যার মধ্যে সফিস্টিকিশন নেই বিন্দুমাত্র। আর ‘মজলিশ-ই-সাবা’য় সাতটি পারসী
নীতিমূলক উপদেশ রয়েছে, যা কোরান হাদিশের অনুগামী। ‘মাকাতিব’-এ রয়েছে রুমির ভক্ত,
অনুগামী ও পরিবারের মানুষদের লেখা চিঠি।
ইরান, আফগানিস্থান, তাজিকিস্থানের বাইরে রুমির জনপ্রিয়তা সারা
পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তুর্কী সাহিত্যে তাঁর প্রভাব ছিল বহু যুগ ধরে। ইরানের
মহম্মদ রেজা শাজারিয়ান, শাহরাম নাজেরি, দাবুদ আজাদ ছাড়া আফগান কবি উস্তাদ মহম্মদ
হাসেম বিন চিস্তির লেখায় রুমির প্রভাব পড়েছিল। সারা পৃথিবীতে ইংরেজি ছাড়া বিভিন্ন
ভাষায় রুমির কাজগুলি অনূদিত হয়েছে, তার মধ্যে রাশিয়ান, জার্মান, উর্দু, তুর্কী, আরবী, ফরাসী, ইতালীয় ও স্প্যানিশ
ভাষাও রয়েছে।
১২৭৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বর কন্যাতেই রুমি মারা যান। তাঁর
পিতার কবরের পাশে তাঁর স্থান হয়। তাঁর স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়েছে কন্যাতে। এখনো সেখানে
সাধারণ মানুষ আসেন শ্রদ্ধা জানাতে।
আমি বিক্ষিপ্ত ভাবে রুমি পড়ছি, তাঁর অধ্যাত্মবাদ যতটা টানছে, ততটাই টানছে তাঁর প্রেমের
কবিতা। রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন প্রেম পর্যায়ের গানগুলির সঙ্গে পূজা পর্যায়ের গানগুলি
একাত্ম হয়ে যায়, তেমনি রুমির প্রবল প্রেমের কবিতায় প্যাশন যেমন এসেছে, তেমনি পূজাও।
আর সব থেকে যা টেনেছে আমায়, তাঁর সহজিয়া সুর। এ যেন বাউল গানের মতো, গভীর এবং গোপন
কিছু অর্থ আছে। যা কিনা সুফি সম্প্রদায়ের গূঢ় তত্ত্ব, ধোঁয়াশা রেখে যাচ্ছে অথচ এক
খোলা হাওয়া প্রাণে এসে লাগছে। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো, তাঁর লেখা অনুধাবন করলে এই
পৃথিবী থেকে হতাশা শব্দটি মুছে যাবে। এত
প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কবিতায়, হতাশা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট আমার কাছে। মিলন
ও বিচ্ছেদকে তিনি বলছেন পৃথিবীর এ পিঠ আর ও পিঠ। আলো অন্ধকার দুইই যেন খুব
স্বাভাবিক, আসবে যাবে। আবার মৃত্যুকে, মৃত্যুভয়কে হেলায় তুচ্ছ করেছেন, মৃত্যুকে
চাপা দিয়েছেন কবরের নীচে। এই জীবনই একমাত্র সুন্দর, চারপাশে যা আছে, ভালো, মন্দ -
একটিকে বেছে নেওয়া ভুল পন্থা, তিনি বলছেন। তার চেয়ে ভালো ও মন্দকে সরবতে নুন ও
চিনির মতো গুলে খেয়ে নেওয়াই উচিত। তাঁর লেখা কবিতার একটি অনুবাদ তুলে দিলাম এখানে।
নতুন নিয়ম / জালালুদ্দীন রুমি
মাতালরা একে অন্যের গায়ে টলে পড়বে, ঝগড়া করবে,
মারামারি করবে, হাসির খোরাক
হবে, এটাই নিয়ম।
প্রেমিকরা মাতালদের থেকেও জঘন্য,
ভালবাসা কী আমি তোমাকে বলিঃ
ভালবাসা মানে সোনার খনিতে প্রবেশ।
আর ওই সোনা কী বস্তু?
প্রেমিকরা রাজার রাজা
মৃত্যুকে ভয় করে না, হেলায় সোনার মুকুট ছুঁড়ে ফেলে।
দরবেশের তালি মারা জোব্বার নীচে লুকনো আছে মুক্তো,
সে কেন দরজায় দরজায় ভিক্ষে করবে?
গত রাতে চাঁদ এসেছিল আমার সাথে
মাতাল অবস্থায় সে রাস্তায় নগ্ন হলো
আমি হৃদয়কে বললাম, “ওঠো, ওর আত্মাকে এক গ্লাস সুরা দাও
বাগানের পাপিয়া পাখিটির সাথে মিলনের মুহূর্ত এসে গেছে
অন্তর-তোতার
চিনির স্বাদ গ্রহণের সময় এসে গেছে”।
হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে আমি পড়ে গেছি–
তোমার পথ ছাড়া কোথায়ই বা পড়ব? আর আমি
তোমার বাসন ভেঙে দিয়েছি, অথচ তুমি মাতাল,
এতটাই মাতাল যে আমার কোনো ক্ষতি করতে পার নি
আমার হাত ধরেছ শুধু।
এ এক নতুন নিয়ম, এক নতুন নিয়মের জন্ম হলো-
সমস্ত কাচ ভেঙে দাও আর
কাচের গুঁড়ো উড়িয়ে দেওয়া বাতাসের দিকে ঝুঁকে পড়।
আরও একটি কবিতার অংশও তুলে দিলাম তাঁর আত্মসচেতনতা বোঝানোর জন্য।
আমরাই বাঁশি, আমাদের সুরেই সে বাজে
আমরাই পাহাড় প্রতিধ্বনি হয়ে উঠি আমাদের।
দাবার ছক হয়ে নিজেদের বাজি রেখে হারি বা জিতি
এই হারজিতই আমাদের তৈরি করেছে
আমরা কে?
আত্মার ভেতরে আত্মা হয়ে থাকি
আমাদের পাশে আমরা থাকি।
আমরাই পাহাড় প্রতিধ্বনি হয়ে উঠি আমাদের।
দাবার ছক হয়ে নিজেদের বাজি রেখে হারি বা জিতি
এই হারজিতই আমাদের তৈরি করেছে
আমরা কে?
আত্মার ভেতরে আত্মা হয়ে থাকি
আমাদের পাশে আমরা থাকি।
সব শেষে রয়ে যায় আমার জিজ্ঞাসা, যা কিনা রুমিকেই আমি করেছি। আর উত্তরও দিয়েছেন
তিনি।
রুমিকে জিজ্ঞাসা করি, যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যেতে হবে-
ইশ্বরের আমাদের প্রয়োজন নেই
তবুও কেন তিনি এই দুই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন?
তুমি উত্তর দিয়েছিলে-
ঈশ্বরের দুই গোপন সম্পদের নাম করুণা ও মহত্ত্ব
ওই সম্পদ আমার চাই
তাই আমি এক আয়না বানিয়েছি
যেদিকে তাকালে আমি মুখ আর বুক দেখতে পাই
আর তারই উল্টোদিকে রয়েছে গাঢ় অন্ধকার পৃথিবী।
যদি তুমি কখনও মুখ না দেখ, পিঠ দেখেই আনন্দ পাবে।
সেই থেকে রুমিকে আমি আয়না নামে ডাকি।
চমৎকার
উত্তরমুছুনভালবাসা
মুছুনbah
উত্তরমুছুনভালবাসা
উত্তরমুছুন