কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প

হিরো

ঢিঢি পড়ে গেছে শহরছোঁয়া এই ছোট্ট গ্রামটাতে। নান্টু তরফদার মানে ঐ মাতাল নান্টু ঝাড়খন্ডের মাটিতে পা রেখেছিল সেই কবে! না, ঝাড়খন্ডের প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে নয়, ক্ষুধার তাড়না বাধ্য করেছিল নান্টুকে পুরুলিয়ার গাঁ ছেড়ে টাটানগর শহরের বুকে ঠাঁই খুঁজে নিতে। ইস্পাত কারখানার এক ঠিকাদারকে ধরেপড়ে কুলির কাজও জুটিয়ে নিয়েছিল একটা। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর দু’বোতল চড়ানোর অভ্যেসও পেয়ে বসলো তাকে। সাথেই কাজ করত আদিবাসী রেজা অঞ্জরা। চটকদার মেয়ে। কাজের মাঝে কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা চলত দু’জনের মধ্যে। এই অঞ্জরাকেই ঝোঁকে পড়ে একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললো নান্টু। অঞ্জরার সমাজে কথা উঠলো, কিন্তু মেয়ের গোঁ নান্টুকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না সে। একঘরে হতে হল অঞ্জরা আর তার মাকে। বাপহারা অঞ্জরা মাকে নিয়ে এসে উঠলো নান্টুর ঘরে। এই নান্টু অঞ্জরার মেয়েই হল গে সরস্বতী। ওই সরস্বতীকেই দেখা গেছে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। সঙ্গে ছিল নগেন পাত্রর ওই নচ্ছার  ছেলেটা। হ্যাঁ, সরস্বতীর বাবা নান্টুও ছিল অবশ্য, তবে তার থাকা না থাকায় এমন কিছু ফারাক পড়ে না। মোদ্দা কথাটি হল, কুমারী সরস্বতীর পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে যাওয়া।

যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন আঠারো বছরে সাবালকত্বের আইন পাশ হয়নি। হলেও বা কে তোয়াক্কা করে! সরস্বতীর বয়সের মেয়েরা এতদিন বাপের ঘরে থাকে নাকি? কবে তারা বৌ থেকে মায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়! সরস্বতী তার মায়ের মতই গঠনটি পেয়েছে। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না, কিন্তু বিয়েটা হয়নি তার। হবে  কী করে? সরস্বতীর বাপ নান্টুর খুঁটে টাকা কোথায়? তাছাড়া লিভারের রোগে বিছানায় পড়ে থাকে মাসের অর্ধেক দিন। যেটুকু কামাই সেটুকু তো বোতলই কেড়ে নেয়। তবে যে সরস্বতী স্কুলে যায়! আহা, সেকি  আর বাপের ইচ্ছেয় নাকি। আরে নগেনের ঐ নচ্ছার ছেলেটাই না ওর মাকে বুঝিয়ে পড়িয়ে রাজী করিয়েছে সরস্বতীকে স্কুলে পাঠাতে! হ্যাঁ, হতে পারে ক্লাসের তুলনায় বয়সটা একটু বেশীই, তাতে কি এমন এলো গেলো! পড়ছে, সেটাই তো বড় কথা। আর একটা কথা, সরস্বতী কিন্তু ক্লাসে র‍্যাংকও পায়। ওর  মা আর রেজাগিরি করে না এখন। পরের ঘরে বাসন মেজে, ঘর উঠোন ঝাড়ু করে যেকটা টাকা পায় তা দিয়ে শাকভাতের জোগাড় হয়ে যায় কোনক্রমে। মেয়ের ট্যুইশন পড়ানোর টাকা জোটে কোথা থেকে? কেন, ঐ নচ্ছার পল্টু! সে-ই তো ভার নিয়েছে সরস্বতীকে ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে দেবার। ও তো নেশাভাং করা ছেলে, বাপের পকেট মেরে যে টাকা ওর পকেটে আসে সে তো---! আরে না না, ওসব ছেড়ে এখন ও পরোপকারে মন  দিয়েছে। সরস্বতীকে ও নিজেই পড়ায়। সেটা অবশ্য হতেই পারে। ও যে ম্যাট্রিকে চারটে লেটার পেয়েছিল সে তো মিছে কথা নয়! সব ঠিক আছে কিন্তু ওর কি ঠেকা পড়েছে সরস্বতীকে ম্যাট্রিক পাশ করাবার? জানতে হবে তো  গুহ্য খবরখানা কী!

ধরে নেওয়া যাক সরস্বতীকে নিয়ে যে কথোপকথন সে গাঁয়ের দুই মাতব্বরের মধ্যে যারা কিনা নগেন পাত্র’র ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী। নগেন পাত্র গ্রামের প্রধান। পয়সা যার ক্ষমতা তার, এই প্রবাদ বাক্যটি শিরোধার্য করে জীবন শুরু করেছিল নগেন পাত্র সুদের ব্যবসা অবলম্বন করে। আজ সে রাতভর পয়সা গোনে। মাতব্বরদের বিচারে নগেন পাত্র’র ছেলে ওই পল্টুই হল গে নচ্ছার ছেলে। তা সে ছেলের খবর রাখার সময় কোথায় নগেন পাত্র’র! কেউ ছেলের কর্মকান্ডের কথা কানে তুললে সোজা বলে দেয়, ‘বিয়ে করেছি, বৌয়ের কোল ভরতে হবে, দিলাম একটা বাচ্চার জম্ম দিয়ে। এখন সে ধম্মের ষাঁড় কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে সে খবর রাখতে গেলে তো আমার ব্যবসাটাই লাটে উঠবে’!

সরস্বতী পরিবার কল্যাণে কেন, সারাটা গ্রাম ওই একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দিশাহারা। ওদিকে সরস্বতীর মুখ দিয়ে একটা কথা বের করতে পারছে না কেউ। সবার সন্দেহ ঐ পল্টু ছেলেটার উপর। ওই গড়বড় করেছে কিছু। পল্টু কিন্তু বেফিকির। চাঁচাছোলা কথা বলে তাই ঘাঁটাতে সাহস হয় না কারো। বলে, হক কথা বল, আমি আছি, ধানাইপানাই করবে তো পল্টুর থেকে খারাপ ছেলে কেউ হবে না, সে তুমি যেই হও না কেন!

এরমধ্যেই ঘটনা ঘটে যায় একটা। গাঁয়ের ভিতর দিয়ে বাস চলার রাস্তা কাঁচা থেকে পাকা হচ্ছে। মালমশলার গুণাগুণ নিয়ে সন্দেহ জাগে পল্টুর মনে। আর যায় কোথায়, গাঁয়ের ছেলেদের জড়ো করে কাজ বন্ধ করে দিল পল্টু। মাথায় হাত গাঁয়ের সকলের। কাদা প্যাচপেচে রাস্তার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার তবু একট ব্যবস্থা হচ্ছিল, ওই নচ্ছার ছেলেটার জন্য সে আশাতেও ছাই পড়ল। মাতব্বর ব্যক্তিরা দরবার করতে গেল নগেনের কাছে। বললো খুলে তার নন্দনের কীর্তি কাহিনি। দরবার চলতে চলতেই খবর এল, রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে আবার। কে? কে করলো এই অসম্ভবকে সম্ভব? কে আবার! ভেঙ্গেছে যে গড়েছেও সে। মানে পল্টু? সে ছাড়া এ গাঁয়ে কার আছে এমন বুকের পাটা যে সরকারী আমলার সঙ্গে লড়ে? বলেছি না, ও তোয়াক্কা করে না কাউকে। নগেনের মুখে যেন যুদ্ধজয়ের হাসি। ছেলের গর্বে গদগদ নগেন মাথাহেঁট মাতব্বরদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিল কয়েকটি কথা মনের ঝাল মিটিয়ে, ‘আমার ছেলের নামে বদনাম দেবার আগে দু’বার ভাববে বুঝলে। সারা গাঁয়ে পল্টুর মত একটা ছেলে খুঁজে পাবে কিনা ভেবে দেখো একবার। এই যে কান্ডটা ঘটালো পল্টু এতে লাভটা কার হল, পল্টু, পল্টুর বাবা, না সারা গাঁয়ের’? সুড়সুড় করে কেটে পড়লো মাতব্বর দু’জন। যেতে যেতে যেমন হয় আর কি, সমস্বরে নগেনের শ্রাদ্ধ করে ছাড়ল। ‘উঁ, বলে কিনা পল্টুর মত ছেলে হয় না, অন্য সময় তো ধম্মের ষাঁড় বলে গাল পাড়ো। দেখবো কতদিন এ গুমর থাকে’।

শহর হলে হয় তো দু’দিনেই ব্যাপারটা মানুষের মন থেকে উবে যেত, কিন্তু এ যে  গ্রাম। এখানে মানুষ এমন  রসালো ব্যাপার অত সহজে মনছাড়া করে না। শহরের ছোঁয়া লেগে গ্রামেরও চরিত্রদোষ ঘটছে, তাই সারল্য হারাচ্ছে দিনে দিনে। নরম জায়গায় আঘাত করাটা মানুষের জন্মগত স্বভাব, তাই এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। ঘরে ঘরে সরস্বতীকে নিয়ে আলোচনা। প্রায় সকলেরই ধারণা কোন অবৈধ কিছু ঘটেছে সরস্বতীকে নিয়ে আর তা থেকে মুক্তি পেতেই তাকে যেতে হয়েছিল পরিবার কল্যাণে। কে এই দুষ্কর্মের জন্য দায়ী, এ প্রশ্নটার জবাব সরস্বতী ছাড়া তো আর কারো কাছে নেই! সরস্বতী সেই যে মুখে লাগাম এঁটেছে, একটি  কথাও তার মুখ দিয়ে বার করতে পারেনি কেউ। বেশী ঘাঁটালে যদি এমন কিছু করে বসে যার দায় সামলাতে পুরো গ্রামকেই মাশুল গুণতে হয়, তখন! সরস্বতী স্কুলে যাচ্ছে যথারীতি। তাকে দেখলেই কানাঘুষো শুরু হয়ে যায় কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস আর হয় না কারও। পল্টুও যেমন পড়াতে আসত তেমনই আসছে। মাতব্বর দু’জনও পাত্তা পাচ্ছে না আর। গ্রামের যেখানেই কোন অঘটন অসুবিধা সেখানেই পল্টু। নিজের ভাল পাগলেও বোঝে, এমনই তো কথা আছে একটা। এখানে কেউ একজন নয়, পুরো গ্রামটাই পল্টুকে উদ্ধারকর্তা বলে মেনে নিয়েছে। ভিতরে ভিতরে  যা-ই থাকুক নগেন পাত্রর শত্রুদের মুখেও পল্টুর প্রশংসা। হতে পারে সময়ের অপেক্ষায় আছে তারা। সে  থাকুক না, পল্টুর তাতে এসে যায় না কিছু। গ্রামে পর পর দুটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেছে। যদিও বয়স  এবং রোগজনিত মৃত্যু, তবুও রটিয়ে দেওয়া হল সরস্বতীর ব্যাভিচারই এই মৃত্যুর কারণ। সরস্বতীর ব্যাপারে পল্টুর নীরবতা নিয়েও কথা উঠছে ঘরে ঘরে।

কে কী বলছে পল্টুর তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তা সে পল্টুর মথাব্যথা না-ই থাকতে পারে, তা বলে গ্রামের সমাজ তো আর বসে থাকতে পারে না। তলে তলে কয়েকজন পরিবার কল্যাণে যাওয়া আসা শুরু করেছে।  ভাবসাব এমন, যেন সরস্বতীর রহস্য উন্মোচন না করা পর্যন্ত তাদের নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত ত্যাগ দিতে হবে। কল্যাণ কেন্দ্রের নার্সটিকে টাকা খাইয়ে শেষ পর্যন্ত একটি খবর হাসিল করে ফেলল তারা। সরস্বতী গর্ভবতী ছিল এবং এই কেন্দ্রেই তার গর্ভমোচন করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশী জানা সম্ভব হয়নি। রেকর্ডে তো গর্ভসঞ্চারকের নাম লেখা ছিল না! সকলের সন্দেহের কেন্দ্রে সেই একজন এবং সে হল গাঁয়ের মানুষের সকল সমস্যার উদ্ধারক পল্টু। কার সাধ্য পল্টুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোন প্রশ্ন করে। কারো কারো মনে একটা বিপরীত প্রশ্নও লতিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে, পল্টু যদি করেই থাকে এমন অপকর্ম তবে তার চোখমুখে অপরাধের চিহ্নমাত্র নেই কেন? দুই পান্ডা কিন্তু সহজে দমে যাবার পাত্র নয়। তারা উঠেপড়ে লেগে গেল পঞ্চায়েত ডেকে একটা হেস্তনেস্ত করে নিতে। পঞ্চায়েতের মাথা যখন নগেন পাত্র এবার তাকে শূলে চড়াবার মোক্ষম সুযোগ এসেছে একটা। বদনামের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পঞ্চায়েত প্রধানের পদটি ছেড়ে মুখ লুকোতে হবে ঘরের অন্ধকারে। ছেলে তাকে কি করে বাঁচায় তখন দেখা যাবে, বিশেষ করে ছেলেই যেখানে অপরাধীর কাঠগড়ায়।

গ্রামের ছোটবড় সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনা দানা বেঁধে আছে। একট বিশেষ দিন দেখে পঞ্চায়েতসভা ডাকা হয়েছে। সরস্বতী আর তার বাবা মা তিনজনকেই বলা হয়েছে সভায় উপস্থিত থাকতে। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব সরস্বতীর। তার বাবামায়ের চোখেমুখে অবশ্য একটা ভয় ভয় ভাব ফুটে উঠছে যতই দিন এগোচ্ছে পঞ্চায়েত সভার দিকে।

নির্ধারিত দিনে পুরোগ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়ল বুড়োবটের তলায়। গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেওয়া হয়েছে গাছের চারদিক বসার জন্য। নগেন পাত্র পঞ্চায়েত প্রধান। তার জন্য একটি চেয়ার এসেছে তারই  ঘর থেকে। দুই মাতব্বর বসেছেন দুটি মাচিয়া নিয়ে। একপাশে বসেছে সরস্বতী তার বাবা মায়ের সাথে। নান্টু অঞ্জরা মাথা নীচু করে বসে আছে। সরস্বতীর ভয়ডর কিছু নেই নাকি! এখানে ওখানে দুচারজন দল বেঁধে কি আলোচনা করছে কে জানে! তাদের নজর কিন্তু সরস্বতীর দিকে। বোধহয় অবাক হয়ে  ভাবছে তারা, যাকে নিয়ে এত কান্ড তার কোন হেলদোল নেই কেন। হ্যাঁ, আর একটা লক্ষ্য করার বিষয়, গাঁয়ের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় পল্টু কেন গরহাজির?

শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। নান্টু অঞ্জরার কাছে জানতে চাওয়া হল সরস্বতীকে নিয়ে নান্টু পরিবার কল্যানে কেন গিয়েছিল। দুজনেরই এক জবাব, স্ত্রীরোগজনিত কোন সমস্যার জন্য সরস্বতীকে নিয়ে যেতে হয়েছিল পরিবার কল্যানে। সোরগোল শুরু হয়ে গেল সভায়। মাতব্বরদের  কথায়, মিথ্যে বলছে নান্টু অঞ্জরা। নগেন পাত্রের জিজ্ঞাসা, তবে সত্যটা কি। বলটা এসে গেল মাতব্বরদের হাতে।

তারা তাদের বক্তব্য পেশ করল সবিস্তারে। এবার সরস্বতীর পালা জবাব দেবার। সরস্বতী নির্বিকার। তার সেই একই জবাব, কিছুতেই বলবে না কোন সে ব্যক্তি যে তার কুমারীত্ব নষ্ট করেছে। এ অবস্থায় নগেন পাত্র  আর কি করতে পারে! সভার সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুযায়ী সে নান্টুর পরিবারকে একঘরে ঘোষণা করল। পরে আবার সিদ্ধান্ত হল সরস্বতী যদি ছেলেটার নামটা বলে দেয় তবে যেখানেই থাকুক সে তাকে ধরে এনে সরস্বতীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, আর একঘরে হবার শাস্তিও মুকুব হয়ে যাবে। এমন কঠোর এক শাস্তি  ঘোষণার পর সাধারণত শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছুটে গিয়ে শাস্তিদানকারীর পা জড়িয়ে ধরে অনুনয় বিনয় করে মুক্তির জন্য। নান্টু অঞ্জরা বা সরস্বতী এই তিনজনের কেউ কিন্তু সে ব্যগ্রতা দেখালো না। হৈহৈ হট্টগোলের মধ্যেই জনাতিনেক পল্টুর বয়সী ছেলে কোথায় যে চলে গিয়েছিল কে জানে! সভা ভাঙার মুখেই তারা হাজির হয়ে গেল পল্টুকে সঙ্গে নিয়ে। পল্টুর বাবা নয়, পল্টুই যেন পঞ্চায়েত প্রধান, কোমরে হাত রেখে তার দাঁড়ানোর ভঙ্গী দেখে এমনই মনে হয়। দুই মাতব্বরের দিকে তারপর তার বাবার দিকে তাকিয়ে নির্ভিকভাবে বলে উঠল সে, ‘আমি জানি কি উদ্দেশ্যে নান্টু কাকুর পরিবারকে একঘরে করা হয়েছে। এখানে ওদের তিনজনের কেউ দোষী নয়। অন্যায় যদি কেউ করে থাকে সে আমি। আমি সভার দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলছি, আমি সরস্বতীকে বিয়ে করতে চাই। মাতব্বর দু’জন বলে  উঠল, ‘বাঃ! এই তো মরদের মত কথা, নিন নগেনবাবু, ছেলে-বৌকে বিয়ে দিয়ে ঘরে তুলুন’। নগেন পাত্র বলে উঠল, ‘অসম্ভব, হাভাতে ঘরের  মেয়েকে আমি কিছুতেই ছেলের বৌ বলে মানতে পারবো না’। আবার সেই নির্ভিক পল্টু, ‘আমি জানতাম বাবা, আমি তো চিনি তোমাকে। শুনেছি, কবে নাকি আমাদের গ্রামেই এমন একটি ঘটনায় এই রায়টিই দিয়েছিলে তোমরা। সরস্বতীকে খুব ভালবাসি যে আমি! ওকে পাবার জন্য তাই জেদের বশেই জেনে বুঝে  ওই অন্যায়টি করেছিলাম। কলঙ্কের  ভাগী হয়েছে সরস্বতী, শাস্তিও পেয়েছে তার পরিবার। এখন আমাদেরই উচিৎ নয় কি ওদের এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দেওয়া? সভায় গুঞ্জন উঠল, একদম ঠিক বলেছে পল্টু। নগেন পাত্র দেখলেন, নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেছেন তিনি। ঢেঁকি গেলার মত মেনে নিলেন তিনি সভার  সিদ্ধান্ত। পল্টুর অনুগামী কোন একজন আওয়াজ তুলল, ‘পল্টু হিরো, পল্টু হিরো - কিশোর  তরুণ যুবক সকলে সমবেত স্বরে অনুসরণ করলো তাকে। বেশ কিছুক্ষণ চলল এই স্লোগান। দেখা গেল মাতব্বর দু’জন মান বাঁচাতে কেটে পড়েছে গুটি গুটি।

নগেন পাত্র’র ঐ নচ্ছার ছেলেটা আজ সত্যি সত্যি হিরো হয়ে গেল!

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন