আমার ইংরেজী বই পড়া
(২)
১৯৭০
সালে, স্কুলের পরীক্ষায় আমার মধ্যমেধাজনিত ফলাফল দেখে, বাবা-মা-দাদা মিলে আমায়
অন্য এক স্কুলে ভর্তি করলেন। আগের বিদ্যালয়ের মতো এটিও ইংরেজী-মাধ্যম ছিল বটে,
কিন্তু সেখানে প্রথম ভাষা ছিল বাংলা। এবার সে স্থান নিল ইংরেজী, আর এতদিনের
দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজীর জায়গায় গেল বাংলা। আর এবার শ্রেণীশিক্ষক, সহপাঠী, বাড়ির লোকজন, সবাই
একবাক্যে নিদান দিলেন যে ইংরেজী শিশু-সাহিত্যের অঙ্গন ছেড়ে বেরোতে হবেই, ইংরেজী শব্দভাণ্ডার ও
লেখন-ক্ষমতা বাড়াবার জন্য। শ্রেণীশিক্ষকের প্রিয় ‘অ্যাডভেঞ্চার’ কাহিনীর লেখক
ছিলেন Alistair MacLean, যাঁর উপন্যাসগুলির ওপর আধারিত একাধিক ছায়াছবি সাধারণ বাঙালী
দর্শকের কাছেও সমাদর পেয়েছিলঃ যেমন The
Guns of Navarone বা Where Eagles Dare। হুকুম অনুযায়ী পারিবারিকসূত্রে বন্ধু, পরে আত্মীয়, অবশেষে সহকর্মী অগ্রজ আনন্দ
লালের কাছ থেকে ধার করে পড়লাম লেখকের Night
without End। একেবারেই ভাল লাগল না! দাদা এবার বললেন, “বেশ, এবার আগাথা ক্রিস্টির একখানা
রহস্যোপন্যাস দিচ্ছি। এটা শেষ করার আগে যদি অপরাধী কে ধরতে পারিস, তাহ’লে তোকে
একটা এনিড ব্লাইটনের Famous Five কিনে দেব।” ক্রিস্টির উপন্যাসটি ছিল The Secret Adversary, এবং আমি শেষের আগেই ঠিক ধরেছিলাম মেঘের আড়ালে মেঘনাদ কে। দাদা কিন্তু পকেট
বাঁচাতে কপট পাশা খেললেন, “না, না ভুল ধরেছিস। আর কাউকে ভাব!” ভেবড়ে গিয়ে আরেকটা
নাম করলাম, এবং বাজী হারলাম! পরে ক্রিস্টির একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু ওই
সময়ে তা হয়নি।
এবার
একটু নেপথ্যকথন প্রয়োজন। আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন আমার মা’র এক খুড়তুতো
দিদি। সম্পর্কে মাসীমা হ’লেও তাঁকে ছোটবেলা থেকে মা জ্ঞানেই দেখে এসেছি। অত্যন্ত
রক্ষণশীল পরিবারে মানুষ হওয়ার জন্য স্কুলশিক্ষা খুব অল্পদিনই তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল।
কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল শেখবার অদম্য ইচ্ছা। অভিধান ব্যবহার ক’রে নিজেকে ইংরেজী
শিখিয়ে আমার পড়া সব ‘মেরি পপিন্স’ আর এনিড ব্লাইটনের যাবতীয় বই তিনি পড়ে
ফেলেছিলেন। এর চেয়ে কঠিন ইংরেজী পড়া তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। তাই মা, রাতে শোবার
সময়, বিভিন্ন ইংরেজী উপন্যাস তাঁকে অনুবাদ ক’রে শোনাতেন, ঠিক যেমন আমাকে বাবা-মা
পালা ক’রে শোবার সময় ইংরেজী গল্প এককালে শুনিয়েছিলেন!
এক
রাতে শুয়ে-শুয়ে শুনছি মা মাসীমাকে এক অদ্ভূত ইংরেজী বই থেকে গল্প বলছেন, যে কাহিনী
গতানুগতিক বাস্তব বা কল্পনাধর্মী গল্পের থেকে একেবারে আলাদা! তখন আমার বয়স ১৩/১৪,
বইটির নাম The Life Everlasting, লেখিকার নাম Marie
Corelli (যিনি বাংলায় আমাদের
উচ্চারণ-প্রমাদের জন্য ‘মেরি করোলি’তে বিকৃত হয়েছেন!) ইনি ১৯শ শতাব্দীর শেষে লেখা
শুরু ক’রে ১৮৯৫ সালে তাঁর উপন্যাস The Sorrows of
Satan-এর মাধ্যমে তৎকালীন সমস্ত পুরুষ ও নারী
ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তার নিরিখে কয়েক যোজন পেছনে ফেলে দেন! প্রথম মহাযুদ্ধের পর,
বলা হয় যে পাশ্চাত্যে তাঁর জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাঁটা পড়ে (যদিও এ ব্যাপারে আমার
সন্দেহ আছে)। কিন্তু ততদিনে ভারতবর্ষে তাঁর জনপ্রিয়তা মধ্যগগনে! বাঙালী
সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর পাঠকদের মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র ও বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুবাদ ছাড়াও কোরেলির অনেক বই তখনকার বোম্বাই শহরের Wilco Books কর্তৃক ১৯৫০
দশকের শেষ থেকে ষাটের দশকের প্রথমার্ধ পেরিয়েও পুনর্মুদ্রিত হ’তে থাকে। প্রসঙ্গত,
কিছুদিন আগে পার্ক স্ট্রীটে Oxford
Bookstore-এ দেখলাম যে Wilco Books-এর এই
পুনর্মুদ্রণগুলি আবার সহজলভ্য হয়েছে!
বেশ
কিছু অতি-নাটকীয় প্রেম-বিশ্বাসঘাতকতা-প্রতিহিংসা সংক্রান্ত উপন্যাস (Vendetta বা Wormwood) ছাড়া
ভদ্রমহিলা যা লিখেছেন, তাতে আধ্যাত্মিকতা তো আছেই, তার সঙ্গে অনেক উপন্যাসে মিশেছে
খৃস্টধর্মের আখ্যানসমূহের খুব উপভোগ্য পুনর্ব্যাখ্যা (যার জন্য ভারতে রোমান
ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে ১৯০৭ সালে কোরেলির তখন-অবধি প্রকাশিত বেশীর ভাগ বইকেই
ঐ চার্চের অনুগামীদের পাঠের অযোগ্য বলে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়!), এবং কল্পবিজ্ঞান।
মা’কে হঠাৎ বললাম, “Life Everlasting-টা দাও তো।” হতভম্ব মা’ প্রশ্ন করলেন, “তুই পড়বি মারি
কোরেলি!!!” সত্যিই তো, এনিড ব্লাইটন থেকে মারি কোরেলিতে যাওয়াকে ‘সুদীর্ঘ লম্ফ’
বলা যেতেই পারে! পড়লাম, দারুণ লাগল, আর পরপর মহিলার বই পড়তে শুরু করলামঃ A Romance of Two Worlds (তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস, যার প্রভাব নাকি বিভূতিভূষণের ‘দেবযান’ উপন্যাসে
দেখা যায়), Ardath, The Secret Power, এবং, কিছু পরে, অবশ্যই জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর সফলতম
উপন্যাস, The Sorrows of Satan। ১৯৭১ সালে
স্কুলের পত্রিকায় বেরোল আমার প্রথম সাহিত্য-সমালোচনামূলক লেখাঃ ‘Marie Corelli: the Neglected Author’। ১৯৭৩ সালে স্কুলের বাড়ির কাজে
বন্ধুকে চিঠি লিখে নিজের পড়া কোন ভাল বইয়ের কথা বলতে বলা হয়েছিল। আমার ক্লাসের
ঘনিষ্ট বন্ধু
সর্বজিৎকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম The Sorrows
of Satan-এর কথা, কারণ ইংরেজীতে সে
বাঘা-বাঘা সব বই সর্বসমক্ষে পড়ত, আর পরীক্ষায় আমার চেয়ে অনেক বেশী নম্বর পেত! মারি
কোরেলি আমার পেশাগত জীবনেও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিতা। ওঁর লেখার প্রতি
আমার আকর্ষণ দেখে দাদা বলেছিলেন, “ভবিষ্যতে ইংরেজী সাহিত্যে কোরেলির স্থান নিয়ে
গবেষণা করিস।” ২০০৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া আমার Ph. D-র বিষয়বস্তু
হ’লো ‘মারি কোরেলির উপন্যাস’, যা নিয়ে আলোচনা করার সময় তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতাসমূহ
নিয়েও লিখেছি। বিশেষ করে লিখেছি ভারতে, এবং স্পষ্টত বাংলায়,
তাঁর প্রভাব নিয়ে।
এরপর
আসি সেই লেখকের কথায়, যে লেখক তাঁর নির্মল, স্নিগ্ধ হাস্যরস দিয়ে আমার জীবন ভরিয়ে
দিয়েছেনঃ তিনি P. G. Wodehouse। বাবা-দাদা ওঁর বই সাগ্রহে পড়তেন, আমাকেও পড়াবার চেষ্টা
করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। অবশেষে, ১৯৭২ সালে পন্ডিচেরীর শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে কিছুদিন
থাকার সময় আত্মীয়দের বাড়িতে দেখি A Pelican at
Blandings বইটি। পড়ে হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরে
যায়। এরপর সবিস্ময়ে আশ্রমের গ্রন্থাগারে দেখি ঋষি অরবিন্দের ব্যক্তিগত সংগ্রহে
রয়েছে উডহাউসের একাধিক উপন্যাস! পরে বাবার কাছে শুনেছি যে তিনি নিজে শ্রী
অরবিন্দের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে সব গুরুগম্ভীর কারণে, তা ছাড়াও
ছিল সাধকের এই উডহাউস পাঠের প্রবণতা! স্নাতকস্তরের পরীক্ষায় যখনই সুযোগ পেয়েছি,
তখনই উডহাউসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি। পরে যাদবপুরে অনেকবার তাঁর লেখা পড়িয়েছি,
এমনকি কয়েক বছর আগে ওঁকে একটি ঐচ্ছিক পত্রের বিষয়ও করেছিলাম – যেমন করেছিলাম মারি
কোরেলিকে।
উডহাউসের
প্রভাব আমার সাহিত্যপাঠের ওপর এতটাই বিস্তৃত যে ওঁকে জানার পর যে তিনজন ঔপন্যাসিক/
ছোট গল্পের লেখককে ভালবেসে পড়েছি, তাঁদের প্রত্যেকের লেখায় উডহাউসের প্রভাব
অনস্বীকার্যঃ এঁরা হলেন ডাক্তার এবং ডাক্তারী পেশা নিয়ে যিনি নিজে ডাক্তার হওয়ার
সুবাদে লিখেছেন, সেই Richard Gordon (‘Doctor’
series), নিজে উকিল হওয়ার সুবাদে ইংরেজী
সাহিত্যে কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, এবং উডহাউসের পর এক নতুন চরিত্র সংযোজনকারী John Mortimer এবং তাঁর
সৃষ্ট উকিল Horace Rumpole, এবং সবশেষে Tom Sharpe, যাঁর লেখায় পরতে-পরতে আছে উডহাউসের কৌতুকের সঙ্গে গভীর ও
তিক্ত ব্যঙ্গরস। প্রথমজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার বৌদির সূত্রে, তিনি যখন ডাক্তারী
পড়ছেন, সেই সময়। মর্টিমারের সঙ্গে পরিচয় করান বিলেতে পড়াশোনা সূত্রে
বসবাসকালীন আমার বাবার মাস্টারমশায় রেভারেন্ড Lovejoy। টম শার্পকে আবিষ্কার করি ব্রিটিশ
টেলিভিশনে তাঁর, আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস, Porterhouse Blue-র ধারাবাহিক রূপ দেখে। এঁদের
সঙ্গে যোগ করব রহস্যোপন্যাস ও গল্পের সুনিপুণ রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির নাম।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন