সমকালীন ছোটগল্প |
পৌরুষ
এই সময়টাকে কী নাম দেওয়া যায়? বসন্ত আসেনি, শীতের শেষ। শিরশিরে হাওয়া, ধূসর প্রকৃতি, অথচ রঙের হাতছানি দিচ্ছে তরুণ পৃথিবী। অপেক্ষার কিছু সময় এনজয় করতে করতে ভাবছিল আকাশনীল।
তার প্রেমিকারা হলো, শ্রাবণী, ঈশিতা এবং নবাঙ্কুরা।
আকাশনীল আজ নবাঙ্কুরার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে। তিনদিন হলো পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। কলেজের লাস্ট সেমিস্টার। এখন বিচ্ছেদের পালা। কে কোন লাইনে পড়বে। আকাশনীলের বাবা চাইছে সে এম বি এ করুক, তারপর তার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করবে। কোনো চাপ নেই। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। আকাশনীলও বাধ্য ছেলে। বাবার ইচ্ছেমতোই চলবে সে, সবাই তাই ভাবে ।
খুব ভালো লাগত তখন আকাশনীলের ওর সঙ্গে গল্প করতে। মাখনের মত যেন
গলে গলে যায়। সবকিছুতেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। ভালোবাসাটা তখন খুব উপভোগ করছিল আকাশ।
মিঠে মিঠে বিরহ, খুনসুটি আবার ভাব। হালকা চুমু। মাঝে মাঝে পরীক্ষা শুরু হলে কম কম
দেখা হওয়া। তারপর আবার হামলে পড়ে অজস্র গল্প। এরই নাম তাহলে প্রেম। সবসময় মনে পুজো
পুজো ভাব। খুব সচেতন হয়ে উঠেছিল তখন আকাশনীল নিজের প্রতি।
সবসময় ওয়েল ড্রেসড, ক্লিনসেভড। কিন্তু এই ফুরফুরে ভাব সত্ত্বেও তার লাইফে নতুন মেয়ের এন্ট্রি হলো। সে হলো ঈশিতা।
ওপাশ থেকে একটি ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর এলো,
দুইবছর ধরে চলছে এই ভার্চুয়াল প্রেম। বেশ ঘনঘন আলুর দম টাইপের।
তাই মনে হয় আকাশের। রাতদিন খোঁজ খবর নেওয়া, কথা বলা।
তিনদিন আবার দেখাও করেছে ওরা। ঈশিতা বেশ বড়লোক। নিজেদের গাড়ি করে এসেছিল। আকাশনীলদেরও দুটো গাড়ি আছে, অফিস এবং ব্যক্তিগত কাজের জন্য। যদিও সে গিয়েছিল বাইকে করে। ঈশিতা কথাবার্তায় খুব সাবলীল ও বুদ্ধিদ্বীপ্ত। হো হো করে হাসে। লজ্জাটজ্জার কোনো বালাই নেই। দারুণ মজা করতে পারে। দুর্দান্ত সেন্স ওব হিউমার, যা বাঙালি মেয়েদের মধ্যে খুবই কম দেখা যায়। চায়ের ওপর পড়ে থাকা সরের মতো মেয়েদের মধ্যে যে অনিবার্য ন্যাকামি থাকে সেটা একদম নেই। সাজগোজও কম, অথচ
তাতে আকাশনীল একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে। যাক ওর ওপর তাহলে নির্ভর
করে না ঈশিতা। আকাশনীল যদি কখনো ছেড়ে চলে যায়, ঈশিতা তাহলে বেশি কষ্ট পাবে না। ভেবে
ভেবে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে আকাশ। সে তো আসলে ভালো ছেলে। কাউকেই ঠকাতে চায় না। খুব ভালোবাসতে চায়। কিন্তু একসঙ্গে
তিনজনকে তো রাখা যাবে না।
শ্রাবণী হলো ছোটবেলার বন্ধু। পাশের বাড়ির মেয়ে। ওরা বড়লোক নয়। শ্রাবণীর মা বাবা গানের টিচার। দুজনে মিলে একটি গানের স্কুল চালায়। শ্রাবণীও দারুণ গান গায়। ছোটবেলা থেকে দুজনে হেসেখেলে বড় হয়েছে।
কিন্তু ওর সম্পর্কে তেমন কোন কৌতূহল আকাশের মধ্যে জন্মায় না।
হাত বাড়ালেই শ্রাবণী এসে হাজির। আগে সবকিছু শেয়ার হতো। এখন আকাশ স্বাভাবিক ভাবেই অনেককিছু
এড়িয়ে যায়। মেয়েটা এমনই তরল যে, কোন অভিযোগও করে না। তাই শ্রাবণীকে নিয়ে খুব চিন্তা
আকাশনীলের। একসময়ের একান্ত বাল্যপ্রেম হলো
শ্রাবণী, যদিও কোনোদিন তেমন করে সে বলেনি ওকে। তবে কখনো কখনো শ্রাবণীর মধুর শাসনে
মনে হয় ও ধরেই নিয়েছে আকাশনীল তাকে বিয়ে করবে বড় হয়ে। আকাশদের বাড়িতে শ্রাবণীর অবাধ
যাতায়াত। আকাশনীলের মা বাবা আবার শ্রাবণীকে
নিয়ে কিছু ভাবেন না, মানে তাকে বউ করার কথা। ধনী গরিবের ফারাক রয়েছে বিস্তর, স্যোশাল
স্ট্যাটাস।
এজন্য আকাশনীল খুব দ্বিধাগ্রস্থ। শ্রাবণীকেই কষ্ট পেতে হবে আখেরে। ওকে বউ করতে তেমন কোন আগ্রহও আর নেই আকাশের। কিন্তু শ্রাবণী যদি ভেবে থাকে মনে, সেটা কী আকাশের দোষ। আজকাল তো ওকে একটু দূরেই সরিয়ে রাখে সে। তবুও কথা হয়ে যায় আবোলতাবোল অনেককিছু।
তাছাড়া তার কাছে বিয়ে একটি অসম্ভব জিনিস। কারণ তারপর তো সে আর
ইচ্ছেমত প্রেম করতে পারবে না। বউ অশান্তি করবে।
এখন কেন জানি মনে হচ্ছে সে সব সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এতো ভালো কেন তিনটি মেয়ে? প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসে। কেউ তো একটু প্রতারণা করলে পারে। তাহলে আকাশ একটু গ্লানিমুক্ত হয়। মাসখানেক এইসব অস্থিরতায় কাটাতে কাটাতে, প্রায় ঘুমহীন হয়ে যাচ্ছে। গভীররাতে ছাদে পায়চারি করছিল আকাশ, কাল থেকে দৃঢ়ভাবে একে একে তিনজনকে সে 'না' করবে। সবখানেই নিজেকে অপরাধী রাখবে। বলবে তারা যেন তাকে ভুলে যায়, ক্ষমা করে দেয় ইত্যাদি।
এম বি এ পড়বে না আকাশ, ভালো লাগছে না একটুও আর। কোনো দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে
গিয়ে সাধারণ বিষয় নিয়ে এম এ করবে। কিছুদিন বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হবে। তার ভেতরে যেন
একটি নিঃসঙ্গ ঈগল হঠাৎই বাসা বেঁধেছে। ডানা ঝটপট করে শুধু বলছে মুক্ত হও আকাশনীল।
খুব সকালবেলা বাজল মোবাইল, কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত হলো আকাশ। ওপাশে শ্রাবণীর উচ্ছসিত সুর।
বিকেলবেলা মুখোমুখি বসে আছে নবাঙ্কুরা আর আকাশ। আকাশ ভাবছে কখন বলবে সে। নবাঙ্কুরার ঢলঢল মুখখানি দেখে কিছু বলতেও পারছে না। আহা যদি কেঁদে ফেলে।
আকাশ স্তব্ধ হয়ে শুনল।
আর বাকি রইল, ঈশিতা। আকাশনীল নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে আছে। হাহাকার করছে ভেতরটা। এই দুজনের একজনও তাকে ভালোবাসেনি আসলে। সবকিছু কী তবে তারই মিথ্যে কল্পনা। ভয়ে ভয়ে ঈশিতার ভার্চুয়াল কক্ষে উঁকি দিল, তিন চারটে মেসেজ পড়ে আছে। এখনো ছেড়ে যায়নি তাহলে। কিছু একটা টাইপ করতে গিয়ে আকাশনীল ভাবল একটি প্রত্যাখ্যান হোক তার তরফ থেকেও।
বি কুল মাই ফ্রেন্ড!
এই প্রথম আকাশনীলের ভীষণ রাগ হলো। এগুলো কী ইয়ার্কি হচ্ছে! খুব অপমানিত বোধ করতে লাগল সে। তিনটে নরম নরম মেয়ে তাকে ফুস মন্তর দেখিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আর সে ভ্যাবলার মতো শুধু দেখছে।
দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সাধারণ বিষয় নিয়ে এম এ পড়ার চিন্তাও
মাথা থেকে চলে গেলো। এম বি এ পড়বে বাবার কথা
মতই । কিন্তু তার রাগ হচ্ছে কেন? সে তো তিনজনকে বিদায় দেবো বলেই ভেবেছিল। তাকে তো
একরকম মুক্তই করে গেলো তারা। কেউ কোন শর্ত রেখে যায়নি। বেঁধে বেঁধে থাকার প্রতিশ্রুতি
চায়নি, তবে?
মাস দুই কেটে গেলো। আকাশ এখন গম্ভীর, আসলে ভেতরে ঝড় আছে, বাইরে যেন থমথমে মেঘ।
অসাধারণ একটি লেখা। খুব বাস্তব।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ, শুভেচ্ছা আমার
উত্তরমুছুন