ধারাবাহিক উপন্যাস
(১১)
তারপর বলেছিল, কিন্তু আমাদের এই দ্বীপগুলোয় একটা ফুলের বাগান
খুবই দরকার। রঙের জন্য, গন্ধের জন্য সৌন্দর্যের জন্য। নয়তো আম, আমাদের চোখ, আমাদের
রুচি, আমাদের আত্মা খুবই কষ্ট পাচ্ছে...
সাঁঝ একটু ভেবে বলেছিল, হ্যাঁ খুবই দরকার। কিন্তু সুন্দর মন
ছাড়া কি কোনো সুন্দর কাজ হয়? ফুলের বাগানের সৌন্দর্য কি ঈর্ষার জ্বালা দিয়ে সৃষ্টি
করা সম্ভব? কোনও কিছু সৃষ্টি করার সময়ে মনে রাখতে হয় তাতে যেন কোনো অসঙ্গতি না থাকে।
এর ফল কখনোই ভালো হয় না। এক্ষেত্রেও হয়নি। জোর বা আপোশ করে কোনো ভালো কাজ হয় না। ওসব না করলে কাজের দেরি হয় ঠিকই, কিন্তু কাজটা ভালোভাবে
হয় এবং সেটা দীর্ঘস্থায়ীও হয়।
আগ্নেয় আসা একপ্রকার বন্ধই করে দিয়েছিল। হৃদয়ের ফুলের বাগান নিয়ে ওর আর কোনো আগ্রহই ছিল না। একদিন হৃদয় একটা কাফেতে খেতে ঢুকেছিল। সঙ্গে ছিল বিশ্রুত আর শ্রমণ। দূরে একটা টেবিলে একা আগ্নেয় বসে ছিল। ও কিন্তু একবারও উঠে এলো না। ওদের সঙ্গে কথাও বলল না। হৃদয়ের বৃত্ত থেকে খুব সচেতনভাবেই ও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। ওর এখন একটা নিজের বৃত্ত হয়েছে। সেখানে ওর ভূমিকা ও প্রভাব অনেক বেশী। হৃদয়ের বৃত্তে ঢুকে নিজেকে ছোটো করার কথা এখন আর ও ভাবতেই পারে না।
কয়েকদিন পর হৃদয় ওর এই মানসিকতার প্রমাণও পেল। রাস্তায় আগ্নেয়র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সঙ্গে ছিল শ্রমণ। সরলভাবেই কথা বলছিল শ্রমণ। হঠাৎ হৃদয় কিছু বলতে যেতেই ওকে থামিয়ে আগ্নেয় কঠিন গলায় বলে উঠল, আমি কিন্তু তোর মত জানতে চাই নি। শ্রমণকেই বলতে দে।
হৃদয় আর শ্রমণ দুজনেই হকচকিয়ে গিয়েছিল। পরে আগ্নেয় চলে যাওয়ার
পর শ্রমণ বলেছিল, ও তোকে ঈর্ষা করে হৃদয়। প্রচণ্ড ঈর্ষা...
তবু আগ্নেয় মাঝে মাঝে হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ফোনও করত দু-একটা।
একদিন হৃদয় ফোন করল আগ্নেয়কে। তারপর বলল, আমাদের ফুলের বাগানে চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে একটা
প্রদর্শণী করছি। তুই কয়েকটা কার্টুন এঁকে দিবি?
পরে সাঁঝ বলেছিল, এটাই তোর সমস্যা। তুই হঠাৎ আগ্নেয়কে এই প্রস্তাবটা
দিতে গেলি কেন?
কারণ ও-ই এটা পারে।
শুধু পারাটাই যথেষ্ট নয়। সাঁঝ রেগে গেছিল। তারপর বলেছিল, কবে
বুঝবি তুই এটা?
আগ্নেয় হৃদয়ের প্রস্তাব শুনে একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমি
মাধবীলতা নিয়ে কয়েকটা কার্টুন এঁকেছি।
হৃদয় একটু অবাক হয়ে বলেছিল, আমাদের প্রদর্শনীটা চন্দ্রমল্লিকা
নিয়ে...
তাহলে আমাকে বাদ দে।
আমি কিন্তু তোর সুনামের কথা ভেবেই...
কথা শেষ হলো না। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল আগ্নেয়, চোপ, একদম চোপ। একটা কথাও আর নয়। আর যদি বলিস, এরপর
তোকে যেখানে পাবো, সেখানেই ধরে পেটাবো।
সাঁঝ বলেছিল, তোর শাসন ও আর নিতে পারছিল না।
এটা কি শাসন ছিল? আমি তো ওর ভালোর জন্যই...
তোর ভালোবাসা শাসনের চেয়েও বেশি অত্যাচারী, বড়ো বেশি দাবী তাতে,
বড়ো বেশি অধিকারবোধ, আর খুব বেশি আবেগ। এত মিষ্টি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। খাদ থাকলে
তবেই সম্পর্ক জমে। নিখাদ সম্পর্ক খুব একপেশে হয়, তাতে কোনো রহস্য বা কৌতুক থাকে না,
লোকে নিজের মতো করে ভাবার স্পেস না পেয়ে একদম হাঁসফাঁস করে। প্রতিটা সম্পর্কের কাছ
থেকে তুই এত বেশি বেশি আশা করিস কেন? কেন নিজের থেকে এত বেশি উদ্যোগী হয়ে উঠিস? এত
সহজে কখনোই নিজেকে বিলিয়ে দিতে নেই। উদ্যোগের কাছে, আশার কাছে, কল্পনার কাছে। তোর শ্রম,
তোর মেধা, তোর প্রেরণা, তোর সঙ্গ, তোর যত্ন, তোর ভালোবাসা, তোর উদ্যম, তোর ত্যাগ, তোর
স্বপ্ন, এসব কি এতই সস্তা? ওসব পাওয়ার জন্য মানুষকে একটু ঘাম ঝরাতে দে। উদ্যোগী হয়ে
মানুষ যাকে অর্জন করে একমাত্র তাকেই সে গুরুত্ব দেয়। আর তুই তো অন্যের ভাবনা নিজেই
ভেবে নিস। আরে, তাকে তার মতো করে ভাবতে দে। এগোতে বা পিছোতে দে। তবেই না তোর জীবনে
তার জায়গাটা স্পষ্ট হবে। কিন্তু তুই যা করিস, মানে এত বেশি করতে থাকিস, এত বাড়াবাড়ি
রকমের আবেগ দেখাতে থাকিস, তাতে তো তোর নিজেরই কোথাও আর কোনও গুরুত্ব থাকে না, লোকে
তোকে ভিখারি বা হ্যাংলা ভাবতে থাকে, আর নিজেকে মহামূল্যবান, তোর স্বীকৃতি কোন গভীর
প্রজ্ঞা ও ঔদার্য থেকে আসছে, সেটাই তো ধরতে পারে না...
সাঁঝ হাসছিল। হৃদয় চুপ করে গেছিল একদম। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সাঁঝ বলেছিল, কে তোকে ওর অত ভালো চাইতে বলেছিল? তোর এত ভালো ও কোনোদিন চেয়েছে? তোর কাছে এসে বলেছে, আমি ভালো নেই, আমার আরো একটু ভালো করে দিয়ে যা? তাহলে কেন তুই ভালোবাসা আর ভালো করার দাবি নিয়ে অমন হ্যাংলামো করিস আর বারবার আঘাত পাস? লোকের ভালো করতে চাওয়াটা তোর একটা অসুখে পরিণত হয়েছে। এর ওষুধ তোকে নিজেকেই বের করতে হবে। লোকের ভালো করতে গিয়ে তোর নিজের যদি বারবার খারাপ হয়, সেটা কখনই কাম্য হতে পারে না। তুই নিজের কথা একদমই ভাবিস না। তোর নিজের ক্ষতির পর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, আর তুই শুধু লোকের ভালোর কথা চিন্তা করে যাচ্ছিস...
হৃদয় কোনো জবাব দিতে পারে নি। আগ্নেয়র সঙ্গে ওর সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছিল।
সাঁঝ বলেছিল, মানুষকে পাওয়ার জন্য, তাকে জয় করার জন্য তুই যেমন
মরিয়া হয়ে উঠিস, তেমনি তাকে হারানোর পর পুরো ভুলেও যাস, তোর কাছে তার আর কোনো মূল্যই
থাকে না। তোর যতো হ্যাংলামো পাওয়া নিয়ে, হারানো নিয়ে তোর মধ্যে কোনো কাতরতা নেই। তখন
তুই বড়ো শান্ত। যেন সে ছিল না কখনো। তার অস্তিত্বই মুছে যায় তখন। তোর ঔদাসিন্য বড়ো
নির্মম। আসলে তুই নিজেও খুব নিষ্ঠুর...
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন