আসলামের বৌ
নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম সোফার কভার কিনতে। দামে বনলো
না। রেয়াজুদ্দিন বাজারে একই কোয়ালিটির কাপড়ে মিটার প্রতি প্রায় কুড়ি টাকা সস্তা। সেইলসম্যানকে
একথা জানাতেই কাপড়ের রোলটা গুটিয়ে উত্তর দিলো, এটা একদরের দোকান।
আমার পাশে বসা দুই মহিলা একের পর এক গাঁট নামিয়েই
যাচ্ছেন। ওরা পর্দার কাপড় কিনবেন। ড্রইংরুমের বাকি সজ্জার
সঙ্গে কী রঙ মিলবে সেটা নিশ্চিত হতে পারছেন না দুজনের কেউই। ওদের কাণ্ড দেখে
ভাবছিলাম, আমার সাধ্যে কুলাচ্ছে না আর
ওদের সাধ্য অসীম বলেই সিদ্ধান্ত দুলছে। অল্পবয়েসী জনের মাথায় লেবু রঙের ওড়না।
দোকানের ফকফকা আলোয় ওর হাত ভরতি সোনালি চুড়ি ঝিকমিকিয়ে চমকাচ্ছে।
নিউমার্কেটে দাম চড়া জানি তবে এতটা ফারাক ভাবিনি।
রিয়াজুদ্দিন বাজারের পরিচিত দোকানটাতে পছন্দসই রঙ পেলাম না। পাড়ার দর্জি বলেছে
রোজার দশ বারোদিন আগে না দিলে ঈদের সময় ডেলিভারী দিতে পারবে না। সোফার কভার এবার
না পাল্টালেই নয়।
সোহেলের পোস্টিং এখন ঢাকায়। দুইদিকে
খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। তার উপরে আম্মার ওষুধের খরচ, ফিজিওথেরাপি। আজ
ছুটাবুয়াকেও বলে রেখেছিলাম থাকতে। বেকার সময় নষ্ট হ’ল। বিষণ্ণতা গ্রাস করে আমাকে।
ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই পাশ থেকে কেউ ডাকে, আরে
রেহনুমা? ওড়না মাথার পাশের জন। ওর নাকের
বিশাল ঝকমকে সাদা পাথরে চোখ আটকে থাকে আমার। আসলামের আম্মা! আমাকে চিনলেন কীভাবে?
ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরেন।
মসৃণ ম্যানিকিউর করা হাত! আমার ভিম বারে বাসনমাজা আঙুলগুলো শাড়ির আড়াল খোঁজে। উনি খলবল করে বলেন,
‘আল্লাহ্ কত দিন পরে দেখলাম তোমাকে! তোমার আম্মা-আব্বা কেমন আছেন?’
লেবু ওড়নাও পেছন ফেরে। মোমের পুতুল যেন! উনি পরিচয়
করিয়ে দেন, ‘ও সোমা। আসলামের বৌ’। সোমা হাত
উঠিয়ে সালাম দেয়। ওর সোনার চুড়ি ঝিকমিকিয়ে হাসে। আমি সহজ হওয়ার চেষ্টা
করি, ‘আব্বা নাই। আম্মার প্যারালাইসিস’। ঠিক তখনই
ফোনটা বাজে। রেশমি। হড়বড় করে কথা বলছে। ওর কোচিঙে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।
স্কুল থেকে ফিরেছে সেই কবে! আম্মা আবার বিছানা ভিজিয়েছেন। বুয়া আমার দেরি দেখে চলে
গেছে। হঠাৎ কী যেন হয়। ফোন কানে চেপে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। টের পাই অবাক দুই জোড়া চোখ
হাঁটছে আমার পেছনে।
ফোনের ওপারে রেশমি কী বলছে তার কিছুই কানে যায় না।
চোখে ভাসে অনেককাল আগের সেই চেহারা। আসলাম। মোড়ের ফোন ফ্যাক্সের দোকান ওদের।
কলেজের গণ্ডি পেরোয়নি। সারাদিন বাপের দোকানে বসে পাড়ার মেয়েদের যাওয়া আসার হিসেব
কষে।
আমার অনার্স ফাইন্যাল ইয়ার। খালাম্মা
গাজরের হালুয়া নিয়ে এলেন এক বিকালে; সাথে বিয়ের প্রস্তাবও। আম্মা হতভম্ব। আব্বা
সামলে উঠে ছেলের লেখাপড়ার ব্যাপারটা তুললেন। উনি বললেন, লোকে পাশ দেয় টাকা
রোজগারের জন্যে। তার ছেলের সেটা আছে।
ভদ্রমহিলা চলে গেলে আম্মা গাজরের হালুয়া রান্নাঘরের
নোংরার বালতিতে ঢেলেছিলেন।
রিকশায় উঠতেই হ্যান্ডেলের বাহারি
আয়নায়, শেষ বিকেলের রোদ ঠিকরে চোখে লাগে; মনে হয় যেন
আসলামের বৌয়ের চুড়িভরা হাত চমকাচ্ছে আয়নায়।
তাহলে কি রেহনুমার আফশোস হচ্ছে? মা বাবার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল মনে হচ্ছে?
উত্তরমুছুনWhat a beautiful presentation! A daily life unfolds over a few minutes of narrative urging one with a lot of unanswered questions. Ranjana helps us with the only way to avoid it, though, the essence of it continues with its challenge. Did Soma, the eternal woman, do the right thing? Do we ever do the right thing?
উত্তরমুছুনThanks a lot.
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনচমৎকার! মনে হল গল্পের সোনাঝুরি ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ল! গল্প তো নয় যেন হীরের ঝিলিক! শুভেচ্ছা রঞ্জনাকে।
উত্তরমুছুনসাধ আর সাধ্যের ফারাকটুকু না থাকলে জীবন যে তার সব আগ্রহ হারাতো ।
উত্তরমুছুনগল্পটা পড়ে ভালো লাগলো। জীবনের হিসেব বেহিসেব মানুষের পক্ষে মেলানো অসম্ভব।
উত্তরমুছুন