লায়লা মজনু
রেবেকা বলল, চল্
না! অনেকদিন লেকের ধারে যাওয়া হয়নি, জলের পাশে বসা হয়নি। যাবি? চল্ না!
অনেকদিন যাওয়া
হয়নি বা বসা হয়নি, সেজন্য যেতে হবে, এটা খুব একটা জোরালো যুক্তি নয়। প্রেম করার জন্য তো আরও অনেক যাবার
জায়গা আছে, তা সে সোনারী বাস স্টপেজ, কালিদার চায়ের গুমটি, সাকচির মাছের আড়ত,
ভোম্বলদার মদের ঠেক অথবা এই যে এখন আমরা দুজনে এক দঙ্গল উচ্চিংড়ের সঙ্গে রিগ্যল
গ্রাউন্ডে সানসেট ক্লাবের লেফট্ উইঙ্গার মনাদার জন্য চিৎকার করে ফুটবল মাঠ
কাঁপিয়ে দিচ্ছি, আমরা কিন্তু দুজনে দুজনের ল্যাজ ধরেই আছি, একবারের জন্যও মুঠো
আলগা করিনি।
পটাই বলল,
মনাদাটা আজ ডোবাবে মাইরি! একটাও ড্রিবলিং পারফেক্ট হচ্ছে না। পাশিংটাও কেমন
এলোমেলো। কোথায় মালফাল খেয়ে মাঠে নামবে, তা নয়, মিনারেল ওয়াটার খেয়ে... এই দেখলি
তো বিট্টু, শটটা কেমন আলতো করে তুলে দিল গোলকীপারের হাতে!
মনাদাকে নিয়ে
আমাদের সবার সত্যিই বড় আশা এবং আমাশা। মনাদা যেদিন তেড়েফুঁড়ে খেলতে নামে,
সেদিন সানসেট ক্লাবের সূর্যোদয় হয় বিকেলে; আর যেদিন ম্যাদামারা হয়ে খেলতে নামে,
সেদিন যথারীতি সানসেট ক্লাবের নামকরণের সার্থকতা নিয়ে নিবন্ধ লেখা যায় আট পাতা।
আসলে মনাদার এই
যে মাঠে নেমে ক্যালানো বা না-ক্যালানো, এর পেছনে কিন্তু আছে অন্য এক রহস্য। তবে সেই
রহস্যের খোঁজ অবশ্য এই উচ্চিংড়েগুলো যেমন রাখে, তেমনি আমি ও রেবেকাও রাখি। কিন্তু
মনাদা সেকথা মানতেই চায় না। রেবেকা মনাদার সহোদরা, রেবেকা কত বোঝায়, তুই মাঠে নেমে
কারও কথা ভাববি না, শান্তাদির কথাও নয়। শুধু বল আর গোলের কথা ভাববি। কিন্তু ষাঁড়
না শোনে কোনো ধর্মের কথা! বলে, তুই কী
বুঝিস্ রে ফুটবলের! আসল রহস্য হচ্ছে খেলার ফর্ম ও টেকনিক। কোন্দিন ফর্ম থাকবে আর কোন্দিন থাকবে না, সেটা কেউই বলতে
পারে না। আর ফর্ম না থাকলে টেকনিকের লবডঙ্কা। বুঝলি, এটা হচ্ছে গভীর রহস্যের
ব্যাপার। তুই একটা ফচকে মেয়ে, তুই কী বুঝিস রে! আর তোর ওই যে জিগরি দোস্ত, যার
সঙ্গে খুব পিরিত করছিস আজকাল, ওকেও বলে দিবি, আগে ফুটবলটা পা দিয়ে যেন মারতে শেখে,
তারপর লেকচার মারবে!
না, মনাদাকে আমি
এজন্য দোষারোপ করি না। আর আমার ওপর মনাদার রাগ করাটাও না-জায়জ নয়। হতে পারে শান্তা আমার নিজের
দিদি, তা বলে দিদি শুধু শুধু সানসেট ক্লাবের সানসেট নিয়েই খুশি থাকবে, তা তো মেনে
নেওয়া যায় না! কথাটা আমি একদিন রেবেকাকেও বলেছিলাম। দিদি কিন্তু এটা ঠিক করছে না।
একেবারেই ঠিক করছে না। দেখ্ সানসেট ক্লাব কিন্তু আমাদের পাড়ার ক্লাব। আমাদের বাপ
ঠাকুরদা শ্বশুর শ্বশুরের বাবা সবাই ক্লাবের সাপোর্টার। আর আমরাও ক্লাবের মেম্বার।
সেই ক্লাবের এই দুর্দশা! মনাদার কী দোষ বল্? সব দোষ তো আমার দিদি শান্তার। একটা,
কী যেন বলে, একটা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ বাচ্চা ফুটবলারের মুন্ডু এভাবে কেউ চিবিয়ে খায়!
রেবেকা আমার কথা
শুনে সেদিন সত্যিই খুব বিষণ্ন হয়েছিল। আনমনে আমার ডান বগল ওর বাঁ হাতের লম্বা
লম্বা নখ দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলেছিল, না রে, ওভাবে বলিস্ না রে! আমার খুব কষ্ট
হয়। তুই তো জানিস আমার ছোড়দা শান্তাদিকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর শান্তাদিও
ছোড়দাকে ভালোবাসে উন্মাদের মতো। আর তুই তো এটাও জানিস, ওরা দুজনে দুজনের জন্য জান
দিতে পারে!
রেবেকা কিছু ভুল
কথা বলেনি। দিদি আমাকে মাঝে মাঝেই বলে, ওর আসল নাম না কি লায়লা। মা-বাবা ভুল করে
শান্তা নাম রেখেছে। রেবেকার দাদা অবশ্য নিজের নাম মজনু ভাবে কিনা জানি না, তবে
রেবেকার মা-বাবা তেমন কোনো ভুল করেননি। মজনুর বদলে নাম রেখেছেন মনা।
রেবেকাকে আর কষ্ট
দিতে আমারও মন চাইছিল না। যতদূর বুঝতে পারি, ও আমাকেও অনেকটা ঐ উন্মাদের মতোই
ভালোবাসে। তবে আমি যেহেতু এখনও ঠিক পাগলের
মতো হতে পারিনি, তাই রেবেকাকে বলেছিলাম, তোর ছোড়দাকে আমার দিদির জন্য জান দিতে
বারণ করিস না; শুধু বোঝাতে চেষ্টা করিস, মাঠে নেমে জান দেবার বদলে যেন গোল দেয়।
রেবেকা আবার বলল,
চল্ না, যাবি, লেকের ধারে? অনেকদিন লেকের ধারে যাওয়া হয়নি, জলের পাশে বসা
ফুটবল মাঠ থেকে
পালিয়ে লেকের ধারে! আমার মোটা মাথায় রেবেকার এই আকুলতা সত্যিই কেমন যেন বেখাপ্পা
লাগল। হ্যাঁ একথা ঠিক যে, অনেকদিন হলো লেকের ধারে যাওয়া হয়নি, জলের পাশে বসা হয়নি। এবং একথাও ঠিক
যে, আজ মনাদা মাঠে নেমে ঘটিয়া ফুটবল খেলছে। আর একটু পরেই খেলা শেষের বাঁশি বাজবে। বিপক্ষ দল ইতিমধ্যে এক গোলে এগিয়ে আছে।
অন্তত একটা গোল পরিশোধ না করলে ক্লাবের সানসেট অবধারিত।
আর ঠিক তখনই খেলা
শেষের বাঁশি বাজল। আবার অস্ত গেল সানসেট ক্লাব। আর উচ্চিংড়ে পটাই রেগে বোম্ হয়ে খিস্তি
ঝাড়ল আমাকে। শালা ...! তোর দিদিকে বলে দিবি, পিরিতের মুখে...। যেদিন খেলা থাকবে,
সেদিন যেন শান্তাদি মনাদাকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য কোনো মজনুর সঙ্গে লাইন মারে।
আর এক উচ্চিংড়ে
মধুশ্রী যেন সান্ত্বনা দিতে চাইল, বুঝতেই তো পারছিস বিট্টু, লায়লার কাছে ঝাড় না খেলে মজনুর খেলা কখনও খোলে
না!
রেবেকা আমাকে
শেষপর্যন্ত হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়েই গেল লেকের ধারে, জলের পাশে। আমার কানের
লতিতে আল্পনা আঁকতে আঁকতে বলল, তুই খুব ভালো ক্যারাম খেলতে পারিস বিট্টু। খুব ভালো। তুই
শুধু ক্যারামই খেলিস।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন