কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪

১৮) অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়



অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়             

               
বিশ্রবণ

বিভূতিভূষণের একটা পাড়াগেঁয়ে গল্প  
ঘরের ভিতরে তার নিত্য যন্ত্রণার কথা একটা
বাঁশের খুঁটিকেই, একান্তে জানাতো বৌটি।    
সংসারের কষ্ট তার হয়তো কমে ছিল।  
সেই কথা রটে গিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে কিশোরী, যুবতী, এমনকি ভারিক্কি বধূরা  
মেয়েলি দুঃখের কথা খুঁটিটাকে নিরন্তর শুনিয়েছে, আর
সেসব দুঃখের কথা শুনতে শুনতেই একদিন
দেবতা হয়েছে খুঁটিগাছ; 
দেবতার জন্ম ঠিক যে পদ্ধতিতে চিরকাল হয়েই এসেছে     
‘খুঁটিদেবতা’ কিন্তু সাক্ষীগোপাল নয়; তার কাজ ছিল শুধু শোনা  
আর বহুদিন ধরে এই শোনার লোকের সংখ্যা ভয়ংকর ভাবে কমে যাচ্ছে।  
চেকভের সেই গল্পটাতে
ছ্যাকরা ঘোড়ার গাড়ি, মালিকের মেয়েটা যে কাল মারা গেছে, সেই কথা
সারাদিন ধরে কোনো যাত্রীকে শোনাতে না পেরে তাকে মাঝরাতে আস্তাবলে
কাঁদতে কাঁদতে, নিজের ঘোড়ার গলা জড়িয়ে শোনাতে হলো;
ঘোড়াটা দেবত্ব পেল।
কেননা শোনার আর মানুষ ছিল না 

সমস্যাটা কমেনি, বেড়েছে।
শব্দদূষণের ফলে মহানগরীতে, এমনকি জেলা আর মহকুমা, থানা শহরেও    
ক্ষুধার্ত বাচ্চার মৃদু ডাক মা শালিখ শুনতেই পায় না।
তার সঙ্গে ব্যস্ততা দূষণ। ব্লুটুথের মোবাইলে কানফোনে, রিয়ালিটি শো-তে, সিরিয়ালে,
সবাই সর্বদা স্রেফ নির্বাচিত বাজে শব্দ শুনছে আর তার ফলে কেউ আর ‘বহুশ্রুত’ নয় 
আর নিরন্তর শ্রবণ কমছে।  

রজনী কোঠারি তাঁর শেষ দিকের অপণ্ডিতি বইয়ে শোনালেন—
উনিশশো চুরাশি সাল, দিল্লি শহরে তিন হাজার শিখ, আর অন্যত্রও ন হাজার,
মোট চারদিনে মরলো, তার কথা ব্যক্তি, রাষ্ট্র, কেউ শুনলো না 
গোধরায়, আমেদাবাদেও ঠিক কত? 
কিম্বা এই সংখ্যা ঠিক কত জন মুজফফর নগরে?
কোনোটা রায়ট নয়! সবকটা ‘পোগ্রম’  
আক্রান্তের কথাও আর শোনাও হবে না 

                          
জলছবি

একপাশে কোঠাঘর, অন্যপাশটা মেটে। 
উঠোনটায় জল থইথই। নিমপুকুরের থেকে হঠাৎ কেন যে মা 
বাসন খানা মেজে ডিঙি মেরে হেঁটে আসছে, খাড়া হচ্ছে না!     
সন্ধে নেমে গেছে, তাই বড়দিদি ‘আ চৈ চৈ’, পাড়েতে দাঁড়িয়ে   
গলা চিরে ফেলছে তবু বোকা একটা হাঁসা আর হাঁসি  
কিছুতেই প্যাঁক প্যাঁক করে সাড়া দিচ্ছে না।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে মার কস্তাপেড়ে শাড়ি, 
ভিতরে জানি না কটা জোঁক ঢুকে আছে! 
মা খুবই বিরক্ত হচ্ছে চিৎকারে, আর দিদিটাকে বলছে আনাড়ি,   
আর আব্রু রেখে শাড়ির ভিতরে ডান হাতটা ঢুকিয়ে দাঁত চেপে  
নুন দিয়ে জোঁকগুলো ছাড়াবার চেষ্টা করছে।
কেউই দেখছে না ওই উঠোনেও আরো কটা নিরাশ্রয় জোঁক,
অনেকটা মারই মতো পিঠ তুলে, ডিঙি মেরে মেরে
এগোচ্ছে আরো কারো মাংসে আটকাতে। আমি সকালে দেখেছি 
নিমপুকুরের জলে বৃষ্টির মোটামোটা টপটপ ফোঁটা পড়ে’
তৈরি করে চলেছেই অজস্র ক্ষণিকপ্রাণ জলজ সিরিঞ্জ
চিতিয়ে ছুঁড়েছি, তবু খোলামকুচিটা আর তাদের কাচের ভার পেরোতে পারেনি      
জোঁকগুলোর চেহারাও অনেকটা তাদেরি মতো   
অপ্রাকৃত রজস্বলা মার অবস্থা দেখেই আমার    
অসম্ভব রাগ আর গা-গোলানি; তবুও কখন যেন তলিয়েছি ঘুমের ভিতরে
বৃষ্টি পড়ছেই আর টিনের চালটায় বাজছে তবলার লহরা।
সিঁটকে উঠছি; কেননা, কীভাবে আমিও একটা ঠিক জোঁক হয়ে গেছি!         
আর ডিঙি মেরে মেরে কার যেন রক্ত ঝরাতে যাচ্ছি।    
ঘুমোনোর ঠিক আগে হ্যারিকেনটা শিস উঠে, দপদপ করে, নিভেই গেছিল, তবু      
ঘুমের গভীরে বাজছে আমার নিঃশব্দ আর আর্ত চিৎকার, নিজের কানেই বাজছে—
লণ্ঠনটা জ্বালাচ্ছো না কেন কেউ জোঁকভর্তি স্বপ্নের গভীরে?

      
                


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন