কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪

০২) নীতা বিশ্বাস



নীতা বিশ্বাস
  
শব্দে দৃশ্যে রহস্যে, অনুসন্ধানে...  

পূর্বসুরী কবিদের কবিতা পড়ে, আত্মস্থ করে বুকের নিভৃত কোণে ভালোবাসার  কুঠরিতে রেখেও নতুন প্রগাঢ় বোধ নিগুঢ় শব্দভাষায় প্রকাশ-আকাঙ্ক্ষা কবিতাসাগরের তুমুল নব জোয়ারে ঝাঁপ দিতে পারেন যে কবি, তিনিই বন্ধন- ছিন্ন ধারা-বদলের কারিগর। এই অন্য এক নির্মাণের কবি স্বদেশ সেন। এই প্রসঙ্গে এক বিদেশী সাহিত্যিকের কথা মনে পড়ছে, যিনি বলেছিলেন লিখতে হলে এমন করে লিখব যা আমার আগে কেউ লেখেনি। দেখতে হলেও হয়তো তিনি এমন ভাবেই  দেখবেন যেমন করে আগে কেউ দেখেনি। লেখা-দেখার এই আনকোরা নতুনত্বের মধ্যেই একজন কবি an exclusive one হয়ে ওঠেন। এইখানেই শৃংখলমুক্তির ঝন্‌ ঝন্‌ কবি ও পাঠক উভয়েই শুনতে পেয়ে যান। শুনতে পেয়েছি স্বদেশ সেনের কবিতায়। তিনি বহমান এবং সমূহ স্রোত। কবিতা ও বিজ্ঞান যেখানে এক হয়ে যায়, সেখানে  কবি স্বদেশ সেন। বিজ্ঞানের যোগসূত্রের কথায় পরে আসছি। আগে বলি, তাঁর নির্মাণ  গবেষণার ধারাবাহিকতায় বাহিত। এই গবেষণা নতুনের জন্য। নতুন শব্দ, নতুন বীক্ষণ, নতুনতর ভাবে উপস্থাপন(presentation)সেই জন্যই তিনি বলতে পারেন, ‘কোনোরকম তাগাদায় আমি লিখতে পারি না। তাৎক্ষণিক কবিতা আমার দ্বারা হয় না। যে কবিতাটা আমি লিখতে চাই, তার জন্য আমি অপেক্ষা করি। সমস্ত হোমটাস্ক  সেরে আমি লিখতে বসি, যখন ইচ্ছে হয়। কবিতার জন্য ভালোবাসা থাকে আমার ভেতরের দিকে’ (‘কালিমাটি’ পত্রিকায় মলয় রায়চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকার)। বুঝতে পারি, যতক্ষণ না কবিতাটি খাতার পাতায় নামছে ততক্ষণ এক তীব্র জারণপ্রক্রিয়া, এক উচ্চ গবেষণা প্রাণময়, তাঁর মধ্যে। কবিতার প্রতি দুরাচার ভ্রষ্টাচার  তাঁর সহ্য হয় না। যেখানে যে শব্দটি চাই, সেখানে সেই বিশেষ শব্দটিই নির্মিত হতে  থাকে তাঁর মধ্যে। হ্যাঁ, নির্মাণ। নির্মাণ বহুমুখীনতার। একটি কথা বা শব্দকে দিয়ে অনেক কথা বলিয়ে নেওয়া। বলেছেন, ‘একটি কথা যখন অনেক  কথা বলে, তখনই কবিতার রহস্য তলা থেকে ওপরে ভেসে ওঠে’। ‘কথা’ ‘শব্দ’ ‘দৃশ্য’ ‘রহস্য’ ‘অনুসন্ধান’ এবং কবিতাকে ভালোবাসা – সব মিলিয়ে স্বদেশ সেনের কবিতা। এই ভালোবাসা কিন্তু আবেগ-সর্বস্ব নয়, যখন তিনি তাঁর কবিতায় (অনুসন্ধানে) ‘প্রচল থেকে কিছু অন্য’তে যাবার তাড়না অনুভব করেনবহুদিন ধরে রবীন্দ্রনাথে এবং তৎ-পরবর্তী জীবনানন্দীয় ‘মিথ’এ থেকেছেন কবিসম্প্রদায়। মধ্যবর্তী কিছু সময়ে কবিতা নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে পাঠক মাত্রই                                  জানেন। এই আন্দোলনগুলির ফলাফলের কথাও তাঁদের অবগত। এইভাবে দীর্ঘ সময় গত হয়েছে শুধু প্রচল ছকের শব্দাক্ষরে এবং যা যথেষ্ট বাণিজ্য-শাসিতবাণিজ্য শাসিত এই মূল স্রোতের বিপরীতে হঠা এক চকিত পরিবর্তনের পংক্তি পেয়ে চমকে উঠি—
‘কোথায় এক পরিবর্ত
প্রচল থেকে কোথায় আছে অন্য
অরুণা যায় থেকে অরুণা আসে
এই সামান্য মুদ্রায়
দিনরাত ও শরৎ হেমন্ত সব যায়’...(রাখা হয়েছে কমলালেবু : কোথায় এক পরিবর্ত)

এই দিনরাত অভ্যস্থ ধারাপাত থেকে বেরিয়ে কবি স্বদেশ সেন বলছেন

‘জন্মপংক্তি থেকে একটা লাইন পড়ো
পড়ো এমন করে, এমন অসাধারণ ভাবে পড়ো
যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়’...( ঐ)

কত দিন পরে যেন কবিতাকে নতুন উচ্চারণে পেলাম। মনে হলো এইসব পংক্তি  যেন  এক ধারা-বদলের ডাক, ধারামুক্তির কবিতাভাষা। এক নতুন ডিকসন, বন্ধনমুক্তির এক দূর্বার আমাদের অন্য কোথায় নিয়ে যাচ্ছেপ্রচলিত সাংগঠনিক মিথ ভেঙে অন্য শব্দে, অন্য ভাষায়, কবিতার এক অন্য ভূবন নির্মাণে পেয়েছি কবি স্বদেশ সেনকে। বলছেন, ‘ডিম খুলে দেখো তার ডানার মতো কিসের ডানা বেরোচ্ছে / যদ্যপি এই মন যেখানে সেখানে তার ডানা বেরোচ্ছে’—(ডানা)।
কবিতায় এ এক নতুন প্রেজেন্টেশন, নতুন বীক্ষণ, নতুন ভাষা। অচেনা কিন্তু নেশা জাগানো-- ‘নতুন কোথায় থাকে, / নতুনের কোনো দুঃখ নেই’ এই নতুন স্বদেশ কবির প্রিয় অনুসন্ধান।

স্বদেশ সেনের কবিতার শব্দে আসি, শব্দে বসি কিছুক্ষণ। দেখেছি তাঁর কবিতা অযথা ভারি ভারি শব্দে ভারাক্রান্ত নয়। নিতান্ত সাধারণ শব্দকে অ-সাধারণের মাহাত্মে ও উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া তাঁর কবিতার বিশেষতা। কী অসাধারণ শব্দ-ভাষায় বলছেন- -‘সমূহ আনন্দ করে যাও / নির্দিষ্ট আনন্দ কি আর / একটা তিল তুলে দিলে গালে / আরেব্বাস গালের বাহার’। এই কবিতার শেষ স্তবকে বলছেন, ‘কে ফুটেছে? তিনটে শালিখ? / ফুটেছে তো স্থানীয় পলাশ / রচিত নিয়ম ভেঙে যেন / এলো শারদীয়া চৈত্র মাস’—(সমূহ আনন্দ)। সামান্য সাধারণ শব্দ দিয়ে বুনেছেন অসামাণ্য অসাধারণ মুহূর্তগুলো। অসামান্যে পৌছানোর এক অভিনব যাত্রাপথ এই শব্দ-ব্রহ্ম তাঁরই। শব্দের  সাথে ভাবনা-ঘরের দোর খুলি—

“খোঁজা যেতে পারে একজন জুতো জামা পরা আলাদা লোক
হেসে আলাদা হওয়া লোককে মাঠের শেষের দিকে খোঁজে
দিন শেষের সামাজিকতা ভেবেই একবার খোঁজা যেতে পারে
মাটির পর মাটির আড়ালেও তাকে ছেড়ে দিতে পারো



...শব্দঠগ আর গল্পঠগ যারা ব’সে থাকে আলগোছে হাওয়ায়
সোনার ভূতের হাত ধরে খায় ভালো, খেলেও তো ভালো
যারা দেখেও বোঝে না মেঘ আর রোদ, মেঘ আর ছায়া
তারাই বাগান তোলে, আর এক বাগানে নামে, বিভিন্ন আশায়।

আকাশের বিশাল মেশিনে সেই স্ক্রুটাইট জামাপরা মানুষ
তিন সন্ধ্যা বসে আছে শূন্যের ওদিকে তাকে খুঁজে দেখা যেত”

‘শব্দঠগ গল্পঠগ’ সেই ‘স্ক্রুটাইট জামা পরা মানুষ’ কী অসামান্য এই মেদহীন আবেগহীন শব্দগঠন ভঙ্গীমা! আর সামান্য শব্দ দিয়ে শুরু সেই জুতো জামা পরা  আলাদা লোক কি এখানে আলাদা লোক না আলাদা আলোক! শুন্য থেকে সমগ্রে,  আকার থেকে নিরাকারে যাবার অনন্য লেখনপ্রতিভা।

এইভাবে প্রত্যেকদিনের কবিতার মধ্যে নতুন ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টির ফলিত রূপ। নতুন জন্ম-আনন্দ-ক্রন্দন স্বদেশ সেনের কবিতায়। বলতে পারি, নতুন কবিতার প্রথম স্বদেশ  সেন থেকেই শুরু এবং ক্রমে ক্রমে আরো...বাঁধা ছকের লোহার জুতোতে তাঁর পা গলাতে অনীহা। ঘর-গেরস্থালির সমস্ত সামলেই তাঁর কবিতা-উড়ান, অথবা এসবের  মধ্যে বসবাস করতে করতেও তাঁর উড়ান-অনুসন্ধান আপনিই আপন মনে বেজে ওঠার এক অনায়াস।

এই প্রসঙ্গে বলি, বাতাস আকাশ পাখি ডানা ওড়া -- এই ‘মুক্ত’ শব্দাবলি প্রায়শঃই  তাঁর কবিতায়...। শব্দ-যাদু কোথায় যে নিয়ে যায় এই ‘বাতাস’ ‘হাওয়া’ ‘ডানা’ ‘ওড়া’ মুক্তপক্ষতাকে—

“তবু কোথাও ছেলেমানুষী, লোভে লোভানো আর গুণে দ্বিগুণ
সেও কম কথা নয়
নিজের ওজনের ওপর ভেসে যাওয়া পাখির কাজ কি
ওরাঁও মেয়েদের চেয়ে কম কিছু
যে হাওয়ায়  চরাচরের ধুলো আর পট্টবাস উড়ে যায়
সে হাওয়ায় কি কোথাও কিছু কম?”

আবার তাঁর অপ্রকাশিত একটি কবিতায় তাঁকে পাই এভাবে—

“বাইরে বাইরে ছিল যে বাতাস
আমার ভেতরে কব্জা হয়ে খেলো”। (অয়স্কান্ত ঘন্টা)

কব্জা করার উল্লাসকে স্বদেশ কবি খেলো হয়ে যাওয়া মনে করেন, কার এতে   মুক্তচিন্তা ব্যহত হয়। কী গভীরে তিনি চলে যেতে পারেন এই তথাকথিত সামান্য শব্দ কথার মধ্যে দিয়ে! এরকম আরও কবিতা মুক্ত মনের জিজ্ঞাসা হয়ে মুক্তো-দানার মতো জ্বলে তাঁর কবিতায়—

“না উড়ে থেমেছ পাখি, সমস্তটা ওড়ো
কিভাবে উড়ছো না তুমি, কিরকম বন্ধ হয়ে আছ
এভাবে পালকে ওড়ো
নানান আকারে একবার


বল্লী বাঁকা, ভরা খোল
গরম রোদের ওই দিকে
মেরু চুম্বকের কোন টানে উঠে পড়ো
হাওয়া খোলা, ওপরে সমস্ত ডানা আনো।

একবার ভালোবাসা ভালোবেসেছিলে
সমস্ত সময় থেকে খুলে পড়েছিলে
সঠিক ডাকের তুমি পাখি,
ফিরে ওড়ো হাজারের দিকে।”(হাজার দুয়ার)

কোন গভীরের পাখি তিনি, আকাশ বাতাস বিশ্বচরাচরে ব্যাপ্ত হওয়ার কথা শোনান। রূপকথা নয়, এ তাঁর বিশ্বাসের খনি থেকে পাওয়া -- “ফিরে ওড়ো হাজারের দিকে।” এভাবে শব্দের পাড়ায় তাঁর আনাগোনা। শব্দ নিয়ে টুইস্ট নয়, পান্‌ নয়, শব্দকে তার যথার্থ গভীরতা থেকেও আরো অনেক বহুমুখীনতায় নিয়ে যাওয়া। পেরেছেন স্বদেশ কবি। সম্পূর্ণ স্বদেশী ঘরানার এই শব্দগুলি থেকে বিচ্ছুরিত এক অন্য দ্যুতি, অন্য  এক রহস্যশব্দরহস্যবলেছেন,রহস্যই শিল্পের প্রাণ। ধ্বনি যখন  তার স্বাভাবিকতা থেকে বেরিয়ে অন্য কোনো নিয়মে ধ্বনিজাল রচনা করে তখন রহস্য সৃষ্টি হয়

সাধারণ দিয়ে অসাধারণ রহস্যজাল বুনেছেন তাঁর ‘কথা হয়েছিল’ কবিতায়, যেখানে ‘হিম’ ও ‘কথা’ এই দুটি শব্দ দিয়ে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে স্নেহে–ভালোবাসায়-আদরে বাঁচিয়ে রাখার অপূর্ব প্রয়াস অবিস্মরণীয় হয়ে উঠেছে। আমরা অভিভূত ও শিহরিত, মনে হয়েছে, এভাবেও ভাবা যায়!—

“এভাবে যে হিম দেখা দিলো
কে বলবে অতঃপর সেই হিমের কী হ’ল
কেননা হিমেরও একটা কথা ছিলো।

যাকে বাঁচানো যেত তাকে আর কে কবে বাঁচালো
কে আর মান্যতা দিলো যেতে যেতে
এগিয়ে গিয়ে দেখলো সারি-হরিতের কাজ?
অর্দ্ধ সবুজ জুড়ে পাখি নামার খবর এদিকে
লম্বা, ক্ষীণ, ইতস্তত আমাদের পাখি।

মোচা আর বোঁটাগুলো সেভাবে বাঁচলো না
বাঁচলো না পাতার আল আর ডগার আঁকড়ি
অথচ দেখো সেভাবেই কত কথা ছিলো
চতুর্দিকে কথা থাকে তাই বারে বারে কথা হয়
কমলালেবুরও একটা কথা হয়, কথা হয়েছিলো।”


মানুষের সম্পর্কের মধ্যে যে দূরত্ব ও শীতলতা, ‘হিম’ শব্দটি কী চমৎকার ভাবে তার  প্রতিনিধিত্ব করছে এখানে ‘হিমেরও একটা কথা ছিলো’ -- কী কথা থাকতে পারে হিমের! নিবিড় পাঠে বোঝা যায়, মানুষে মানুষে শীতল সম্পর্ককে কথাতাপে নিকটত্বের  উষ্ণতায় আনা যায়। সারা বিশ্বে মানুষে মানুষে যে ভয়াবহ জটিল ও দূরত্বের দমবন্ধ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আজ, একমাত্র কথা’র মধ্যস্থতাতেই সে সম্পর্ক সুন্দর মধুর হয়ে উঠতে পারে। হিম শব্দটি কী আশ্চর্য মাত্রা পেয়েছে, ততোধিক মাত্রা পেয়েছে ‘কথা’  শব্দটি। কী অসীম দক্ষতায়  এই শব্দ দুটির পার্সোনিফিকেশন তাঁর কলমে, কবিতায়। প্রকৃতি কথা বলে বৃক্ষ লতা পাতা ফুল পাখি বাতাসের মধ্যে দিয়ে। এইসব সুস্থ কথা ও বার্তা দিয়ে অসুস্থ বিশ্বের মানুষকে মানসিক সুস্থতায় উজ্জীবিত করা যায়। আন্তরিকতা অনেক ক্ষতকে সারিয়ে তুলতে পারেএকজন মানুষের কাজের সঠিক           মান্যতা  তার কাজের প্রেরণা হয়ে ওঠে। সমস্ত কবিতাটি কী অসীম রহস্যময় ভাষায়  ব্যক্ত। শব্দই বাক্যের উৎস এবং রহস্যই কবিতার প্রাণ, এ কবি স্বদেশ সেনের নিজস্ব বিশ্বাস। কী অসাধারণ প্রেজেন্টেসন! একাকী নিভৃতে কবি বিশ্বের মানুষের সুস্থতার  দায় বয়ে বেড়ান। এই দায় দেখেছি তাঁর ‘মাটিতে দুধের কাপ’এর শুশ্রূষায়, ‘রাখা  হয়েছে কমলালেবু’র আতিথেয়তায়, ছায়ায় আসিও’র স্নিগ্ধ আপ্যায়নে। একটা পজিটিভ  স্পন্দন তাঁর কবিতায় আসন বিছিয়ে রাখে।

দেখতে পাই গেরস্থালির সাংসারিক অবস্থান সেরেও কবি স্বদেশ সেন কবিতায়  বাঁচেনএর মধ্যে থেকেই কবিতার বাঁক বদলের, ধারা বদলের, নতুন উপস্থাপনার ডাকচিঠি বিতরণের ডাক শুনতে পাই। ট্র্যাডিশনাল কবিতা থেকে সরে এসে, বহু ব্যাবহৃত শব্দসামগ্রীর থেকে বেরিয়ে এসে, তাত্বিকতার বোঝা ও আবেগ-সর্বস্বতা থেকে স্বভাবগুণে বেরিয়ে এসে, কবিতাকে নতুন ধারায় বইয়ে দেওয়া নতুন কবিতার জন্ম দেওয়ার প্রসবানন্দ-যন্ত্রণা তিনি বহন করেছেন। নতুন প্রজন্মের জন্য এই বহন জরুরী ছিল। সস্তা জনপ্রিয়তা, জাগতিক ধান্দাবাজি, প্রতিষ্ঠানের পদলেহনের ধুলো তাঁর গায়ে  লাগেনি। এজন্য স্বদেশ সেনের পাঠকসংখ্যাও কম। তাতে সৃষ্টিশীল লেখকের কিছু যায়- আসে না। তিনি লেখেন নিজের আনন্দে, (‘আমি শুয়ে বসে লিখি’ – স্বদেশ সেন, মলয় রায়চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন)। প্রকৃত পাঠক নিজেই তাঁকে খুঁজে নিয়ে পড়েছেন। তিনি লেখেন নীরবে নিভৃতে। হৈ হল্লার বাজার-চলতি বিজ্ঞাপনে নয়।

এবার আসি তাঁর স্বলব্ধ অসামান্য উপলব্ধিতে। বলছেন, বাক্যের বা শব্দের স্বাভাবিক  গঠনকে ভেঙে চুরে তার যে বিকৃত চেহারা, তাকে বলে কবিতা। তার মানে ‘বিকৃতি’ই তাঁর মতে  মূহ রহস্যের প্রসূতি। ‘এই বিকৃতির স্বরূপ জানতে না পারলে  শিল্পের রহস্যের নাগাল পাওয়া যায় না। শিল্প তখন দূর্বোধ্য ও অগ্রহণীয়।’ বিকৃতি  কাকে বলছেন, তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলছে্‌ দুটি অণুর মধ্যে মুখোমুখি  সংঘর্ষে তৈরি হয় তীব্র শক্তি বা এনার্জি ঠিক সেই রকমই প্রতিষ্ঠিত শব্দকে, প্রতিষ্ঠিত চিন্তাকে যদি অন্য শব্দ ও অন্য চিন্তামাত্রা দিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে ভাঙা হয়, তখন তার থেকেই সৃষ্টি হয় নতুন শব্দ, নতুন চিন্তা, নতুন শিল্প, নব নির্মিতিশিল্প সব সময় চেষ্টা করে প্রচলকে আঘাত করার, যে কোনো ফিক্সেসন সে আঘাত করতে চায়। এই আঘাতে যে অভিঘাত সৃষ্টি হয়, তা এক নতুন শক্তির, নতুন শব্দের, নতুন চিন্তার, নতুনতর প্রকাশভঙ্গীর জন্ম দেয়। এই অভিঘাত-পরিণামকেই কবি স্বদেশ সেন বলেছেন ‘বিকৃতি’। স্বাভাবিক থেকে অন্য রকম, প্রচলিত ব্যাকরণকে ভেঙে, ছক ভেঙে নতুনের দিকে, বে-ছকের দিকে অন্তহীন যাত্রা স্বদেশ কবির। ছাঁচ ভেঙে, বাঁধন ভেঙে বিস্তৃত পরিধিতে উত্তরণএই বিস্তৃতিই তিনি চেয়েছেন শিল্পে, সাহিত্যে। ছাঁচে ঢেলে তৈরির ক্লিশে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নতুনের জন্ম হয় না। শব্দবন্ধের এই গভীরতায় যাবার ঝুঁকি যিনি অনায়াসে নিতে পারেন, শব্দের বিকৃতি = নতুনতর শব্দ, একথা যিনি বলতে পারেন--
“লোহায় মাখানো কিছু টিন
খনিতে খনন বেজে উঠলো
একটা ব্যবহার হয়ে উঠলো ভালো।”

এবং শেষ অনবদ্য পংক্তি
     
“অনুকে ডেকে গেল অনুপম।”

একথা যিনি বলতে পারেন, লিখতে পারেন, গভীরেই তাঁর অবস্থিতি। এবং কোনোরকম পিঠ-চাপড়ানি পুরস্কারের কথা ভাববার মতো সময় বা রুচিবোধ তার থাকে না। কে নেয় এই ঝুঁকি! মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন কবি শিল্পী সাহিত্যিক ছাড়া! এখানেই কবি স্বদেশ সেনের একাকীত্বের মধ্যেও সন্তুষ্টি, এখানেই কবি স্বদেশ সেনের  দায়বদ্ধতা শিল্পের প্রতি, কবিতার প্রতি, শিক্ষিত পাঠকের প্রতিতাঁর কবিতা তাই নতুন শব্দে, দৃশ্যে, রহস্যে, অনুসন্ধানে -- নতুন কবিতার বীজ।










0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন