মালী
কিরণ নামটা ছেলে
মেয়ে দুজনেরই হয়। ফলতঃ কিরণের কোনো যৌন সমস্যা ছিল না। নারী-পুরুষের বাইনারি খেলা,
কিম্বা খেলার ব্রেক-টাইমে হিজড়ের ভিক্ষে, এসব
কিছুই ছিল না তার। শুধু তিন কাঠা জমি যা সে জন্মসূত্রে পেয়েছিল, আর নিজের থেকেই
জোগাড় করা নানান ফুল গাছের বীজ – সেই জমিতে লাগানোর জন্য। ‘লাগানো’ শব্দটা লেখার পরই টের পেলাম, শব্দটার বাউন্ডুলে
মেজাজ ছটফটে গতি, এই গল্পটার থেকে ছুটে যেতে চাইছে অন্য কোনো গল্পে। হয়তো যৌনগন্ধী, কিম্বা
নিতান্তই ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো, বা ধরো একটু দর্শন টর্শন ঘেঁষা
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, বা লাগা চুনরি মে দাগ। না হে, আমাদের গল্পে শব্দটি বড়ই
একঘেয়ে, ফ্যাকাশে। এখানে ‘লাগানো’ মানে শুধুই
ফুলগাছের বীজ লাগানো, দিনের পর দিন... বছরের পর বছর।
সেই কোন্ ছোটবেলা থেকে, যবে থেকে
হুঁশ, এই নেশা তৈরি হয়েছে তার। তার সাথেই বেড়েছে। খুপরি
দিয়ে মাটি খুঁড়ে, আঙুলের ডগায় নাড়াচাড়া... নরম ক’রে
তোলা, তারপর জল, দানা... অপেক্ষা। ছোট্ট ছোট্ট শ্বাসমুখগুলো যখন সেই মাটি ফুঁড়ে
প্রথম দেখা দিত, সে কী উত্তেজনা!
যেন একটা জিতে যাওয়া, অন্ধকারে প্রথম একটা স্টেপ।
তারপর কঞ্চি কেটে
বেড়া, রোজ জল। একটু বড় হলে সার। ডাল ছাঁটা। আরও কত কাজ! কী না করেছে সে ওই ফুলগাছগুলোর জন্য। সেবার পাড়ায় যখন কারখানা বসলো, কী বাজে আওয়াজ আর ধোঁয়া, সকাল বিকেল... টেকা দায়। কিরণ প্রথম প্রতিবাদ করে লোকাল থানায় গিয়ে। কেউ ভাবতেও পারেনি এরকম একটা
কাজ সে একা করতে পারবে, কিরণ নিজেও জানতো না। কিন্তু পারলো। কারণ ওই ধোঁয়ার দূষণ
থেকে গাছগুলো বাঁচানোর আর কোনো উপায় ছিল না তার। ধীরে ধীরে এলো পাড়ার আরও লোকজন।
রেসিডেন্সিয়াল অঞ্চলে কারখানা চালু করার প্রতিবাদে একজোট হলো তারা।
ওই প্রথম বাইরের
লোকেরা টের পায় কিরণকে, তার বাহাদুরিকে। প্রশংসা করতে চায় তারা। কিন্তু কোথায় কে?
কাজ শেষে, কিরণ তো আবার ফিরে এসেছে, তার ফুলগাছের দুনিয়ায়, আবার সেই খুরপি, জল,
সার।
– মরল
কীভাবে?
– ঠিক
জানি না রে! শুনলাম শেষের দিকে নাকি খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ ক’রে দিয়েছিল। উদাস হয়ে ব’সে থাকত সারাদিন।
– ফুলগাছ
লাগাতো না? যত্ন করত না?
– না। ওর
গোটা জমিটাই বাগান হয়ে গেছিল। গাছে গাছে ভ’রে গিয়েছিল সবটা।
সমস্ত গাছের সে কী ডাগর চেহারা! সব ডালে সে কী ফুল, কী বাহার! কিরণের আর কোনো কাজ ছিল না। সারাদিন শুধু খুরপি আর জলের ঝাঁঝরির পাশে ব’সে থাকত। গাছগুলো নিজের মতোই বাড়ত, ফুল দিত, পাখি আসত।
– আর সেসব
দেখে খুশি হওয়ার বদলে, সে উদাস হয়ে পড়ল? কেন?
– কে
জানে?
– আচ্ছা,
কিরণের কোনো বন্ধু ছিল না?
– শুনেছি একজন ছিল। কাজল। সে নাকি গাছ থেকে হরলিক্সের বয়ামে
শুঁয়োপোকা ধ’রে দেখাতো কিরণকে। ওই গুটি থেকে প্রজাপতি আর-কি! যেহেতু কাজল নামটাও ছেলে মেয়ে দুজনেরই হয়, তাই
কিরণের সাথে কাজলের বন্ধুত্ব অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন