ধারাবাহিক উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(২৩)
প্রথম প্রথম অভিমন্যু সবার কথা মতো এই বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিল
বেশির ভাগ সময়টাই আর ক্লাস নেবার জন্য দিগন্তসেনার কলেজে যেতে শুরু করেছিল। কিন্তু
একটা সময় তার মনে হয় যে সে এ বাড়িতে থাকতে রাজি হয়ে সে বেজায় ভুল কাজ করেছে যেটা তার
করাটা ঠিক হয়নি। তাই সে যুদ্ধের দিনগুলোতে বেশির ভাগ সময়ই গোটা দেশ বা দিগন্তসেনায়
যুদ্ধের প্রয়োজন কেন হচ্ছে সেটা বোঝানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। মূল ভূখন্ডেও সে
এই একই কাজ চালিয়ে যায়। সে তৈরী করে একটা নতুন কমিটি, ছেলেদের জন্য আর মেয়েদের জন্য
স্কুল তো অনেক আগে থেকেই ছিল। তার ওপর খুলে ফেলে একটা কলেজ, করে ফেলে বয়স্ক শিক্ষার
জন্য একটা বিশেষ স্কুল। বদলে দেয় ছেলেদের আর মেয়েদের শিক্ষাব্যাবস্থার ধারাটা। নতুন
করে একটা শিশুদের জন্য প্লে স্কুল তৈরী করে। চালু করে শিক্ষকদের ট্রেনিং দেবার জন্য
একটা বিশেষ স্কুল। এসব কাজে সে তাদের পরিবার ও পারিবারিক সম্পত্তি যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার
করার সুযোগ পায়। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাবার পর পরই সে যখন একদিন গ্রাম থেকে দিগন্তসেনায়
ফেরবার পথ ধরে ভোরবেলা হাঁটতে থাকে, তখন তার মনে হয় এবার সে তার প্রেম নিবেদনের ফলাফলটা
জেনে সেই জায়গাটা থেকে প্রয়োজনে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। তাই সে দিগন্তসেনায় ফিরেই
গোছগাছ করে ফেলে তার সমস্ত জিনিসপত্তর। শুরু করে দেয় তার বইপত্তরগুলো ঝেড়ে পরিস্কার
করতে। ঠিক সেই সময়ই দরজায় একটা অপরিচিত মৃদু করাঘাত শুনতে পায়।
দরজায় গিয়ে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কর্নেল শ্যামাঙ্গী। তার
দিকে তাকাতেই শ্যামাঙ্গী অনুমতি চায় ঘরে আসার জন্য। অভিমন্যু তাকে সসম্মানে, সাদরে
ঘরে এসে বসার অভ্যর্থনা জানাতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। একটা সোফায় বসার পর কর্নেল
শ্যামাঙ্গী বলে যুদ্ধের দিনগুলোতে সে খুব ব্যস্ত ছিল। উত্তরে অভিমন্যু জানায় যে সে
তা জানে এবং সেটা খুবই একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কর্নেল তখন সরাসরি আসল প্রসঙ্গে চলে যায়।
সে জানায় যে সে অভিমন্যুর প্রস্তাবে রাজি।
কথাটা শোনামাত্র অভিমন্যুর সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। সে
কী করবে তা ঠিক করতে পারে না। কঠোর গাম্ভীর্য রক্ষা করে সে বলে ফেলে, ‘সেটা অবশ্যই
আমার সৌভাগ্য’। উত্তরে কর্নেল জানতে চায় যে সে এতে খুশি কিনা। নাকি সে এত দিনে তার
সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে? অভিমন্যু জানায় যে সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন সে এই
জন্যই অপেক্ষা করছিল যাতে কর্নেল তার সিদ্ধান্তটা জানাতে পারে নিজে থেকে। কর্নেল শ্যামাঙ্গী
কিন্তু এবার অভিমন্যুকে সতর্ক করে দিতে ভোলে না যে তার জীবন একটা অন্য লয়ে বাঁধা যা
থেকে বেরোবার কথা সে ভাবতেও পারে না। উত্তরে অভিমন্যু জানায় যে সেইটাই তার সেই আকর্ষণী
শক্তি যার জন্যে অভিমন্যু তাকে ভালোবাসে। নিজেদের মধ্যে একটা সম্মানজনক চুক্তি করে
ফেলে কর্নেল শ্যামাঙ্গী ও অভিমন্যু যে তারা কাজের সময় যখন যেখানে দরকার তখন সেখানে
থাকবে আর তার পরের বাকী সময়টা তারা একসঙ্গে কাটাবে এই বাড়িতেই।
শুরু হয়ে যায় কর্নেল শ্যামাঙ্গী আর অভিমন্যুর যৌথ জীবন। কর্নেল
শ্যামাঙ্গী তাকে প্রথমেই নিয়ে যায় নিহিতপাতালপুরীর বাড়িতে মানময়ী ও অনঙ্গের কাছে। তারপর
ফোনে জানায় শকুন্তলা, চৈতি, সুদাম আর অলংকৃতাকে। সুদাম তো সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অলংকৃতাকে
নিয়ে গাড়ি করে পৌঁছে যায় অভিমন্যুর অভ্যর্থনার জন্য। কর্নেল শ্যামাঙ্গী সকলের সঙ্গে
পরিচয় করিয়ে দেয় অভিমন্যুর। তারপর অন্যরাও যারা যারা আসতে পারে তারা এসে পড়ে। বাড়িটা
ভরে যায় আত্মীয়স্বজনে। চলে দেদার খাওয়া দাওয়া, হুল্লোড় আর কিছুটা সঙ্গীতের সঙ্গে ঢিমে
তালে মৃদু কোমর দুলিয়ে নাচ, যা সাধারণত বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিদের বাড়ির পার্টিতে
আয়োজন করা হয়। চৈতি ঠিক করে দিগন্তসেনায় একটা নতুন বাংলো বাড়ি বানানো হবে সেখানকার
রাষ্ট্রপতির থাকার জন্য। সেটা করে ফেলতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে অবিলম্বে কর্নেল
আর অভিমন্যু সেখানে গিয়ে থাকতে পারে।
কর্নেল শ্যামাঙ্গীর কিন্তু এই ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগে
না। কথাটা সে অভিমন্যুর কাছে মন খুলে বলেও। অভিমন্যু বুঝতে পারে না সে কি করবে। তবু
কর্নেলকে সে জিজ্ঞাসা করে যে এমন কোনো কিছু আছে কিনা যেটা সে ওদের বলতে পারে। কিন্তু
তাতে কর্নেল শ্যামাঙ্গী জানায় যে তাতে কোনো লাভ হবে না। কর্নেল শ্যামাঙ্গী বিভিন্ন
পরিস্থিতি নিয়ে অভিমন্যুর সঙ্গে আলোচনা করে। খোলাখুলি বলে ফেলে যে তার মনে হচ্ছে সামনে
একটা বড় সড় যুদ্ধ লাগতে যাচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে এই ধরণের ব্যাপারস্যাপারগুলো
তার কাছে খুবই হঠকারিতা মনে হচ্ছে। অভিমন্যু বলে যে এবারের যুদ্ধে সেও অংশগ্রহণ করতে
চায়। কর্নেল শ্যামাঙ্গী জানায়, তার দরকার নেই। তার চাইতে সে বরং যুদ্ধ থেকে ফিরে বিশ্রামের
সময়টা যদি ওর সঙ্গে থাকতে পারে তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।
কর্নেল শ্যামাঙ্গীর অনুমতি নিয়ে অভিমন্যু চলে যায় নিহিতপাতালপুরীর
বাড়িতে। সেখানে গিয়ে অনঙ্গ আর মানময়ীকে সব কথা জানায়। কথাটা ওদের বেশ মনে ধরে। ওরা
ভাবতে থাকে যে সত্যিই যুদ্ধের ব্যাপারটা ওদের মাথায় রাখা উচিত ছিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে
খরচের ব্যাপারটাও। এবার ওদের আরো একটা ব্যাপার মাথায় আসে। সেটা হল নিরাপত্তা ব্যাবস্থা।
যদি যুদ্ধটা বিয়ের আগের দিনই বা পরের দিনই লাগে তাহলে সবটাই ভেস্তে যাবে। তার ওপরে
যুদ্ধের খরচের বোঝা যখন সাধারণ মানুষের মাথায় ভীষণ ভাবে চেপে বসছে, তখন এমন ঢালাও বিলাসের
ব্যাবস্থা সাধারণ মানুষ ও মন্ত্রী আমলারা মেনে নেবে, ভেতরে ভেতরে অসন্তোষের জন্ম দেবে
না, তার কী মানে আছে? কিন্তু অবস্থা এখন অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।
মানময়ী আর অনঙ্গ অভিমন্যুকে বলে যে করেই হোক ব্যাপারটা খুব ব্যাক্তিগত স্তরে রাখতে
হবে।
অভিমন্যুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আফ্রিকা, রাশিয়া আর চীনকে
যদি চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধে আটকে ফেলা যায়। কথাটা সে শ্যামাঙ্গীকে বলে। কর্নেল শ্যামাঙ্গীর
তা বেশ মনে ধরে। একটু রদবদল করে সেটা কাজে লাগাবার ব্যাবস্থাও হয়ে যায়। খুব তাড়াতাড়িই
যাতে চুক্তি করে ফেলা যায় প্রতিরক্ষা দপ্তর তার ব্যাবস্থাও করে ফেলে। চুক্তিটা হয়েও
যায়।
কর্নেল শ্যামাঙ্গী একটা পাপবোধে ভুগতে থাকে। আস্তে আস্তে সে
বিরক্ত হয়ে উঠতে শুরু করে চৈতি আর শকুন্তলার ওপর। অভিমন্যুকে সে আগেভাগেই বলে রাখে
যে যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধ লাগতে পারে। আর সেটা হলে তাকে চলে যেতে হবে যুদ্ধে। অভিমন্যু
কর্নেল শ্যামাঙ্গীকে নিশ্চিন্ত করে বলে যে তাতে কোনও অসুবিধে হবে না।
অবশেষে সেই দিন সামনে এসে উপস্থিত হয়। অভিমন্যু আর কর্নেল সকলের
সামনে হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার করে যে আজ থেকে তারা যৌথ জীবন যাপন করতে যাচ্ছে। বেশির
ভাগ মন্ত্রী, আমলারা পুষ্পস্তবক উপহার দিল। শ্যামাঙ্গীর ছেলে মেয়েরা একে একে এসে তাদের
জীবনসঙ্গীদের নিয়ে শ্যামাঙ্গী আর অভিমন্যুকে নানা উপহার আর ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়। সাংবাদিকরা
দুজনের ছবি তোলে। দূরদর্শনের ক্যামেরায় বন্দী হয় তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানের ছবি। কিন্তু
কোথাও সেসব ছাপা বা সম্প্রচার করা হয় না। সমস্ত অতিথিরা খেয়ে দেয়ে চলে গেলে কর্নেল
শ্যামাঙ্গী আর অভিমন্যু দুজনেই তাদের শোবার ঘরে চলে যায়। সংশ্লিষ্ট সকলের চেয়ে অনেক
বেশি ‘যুদ্ধটা এই লাগল বলে’ এরকম আতঙ্কে সময় গুনতে গুনতে ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল হতেই চোখ মেলে তাকিয়ে কোথাও শ্যামাঙ্গীকে দেখতে পেল না
অভিমন্যু। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকিয়ে দেখল শ্যামাঙ্গী এসে ঘরে ঢুকল। ও তাড়াতাড়ি উঠে
বসে জানতে চাইল কিছু হয়েছে কিনা। কর্নেল শ্যামাঙ্গী
ঘাড় নেড়ে জানাল যে কিছুই হয় নি। তারপর কাছে এসে অভিমন্যুর মুখে চোখে গালে আঙুল দিয়ে
বিলি কাটতে থাকে। অভিমন্যু আলতো চোখে কুণ্ঠিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। তারপর দৃষ্টি টা সরিয়ে
নিল। কর্নেল ওকে বলল, ছুটির দিন বলে আজ দুপুরটা ও বাড়িতেই থাকবে। অভিমন্যু চাইলে সেই
সময়টা ওরা একসঙ্গে কাটাতে পারে। শুনে অভিমন্যু এতটা শিহরিত হয়ে উঠল যে সে কোনো কথা
বলে উঠতে পারল না।
(সমাপ্ত)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন