কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

কবিতার কালিমাটি ১৩৯




 

বাড়ি

 

বাড়ির দিকে চেয়ে থাকি। সুপুরি বাগানের দীর্ঘ ছায়ায় বাড়িটি দুলে ওঠে; শালিকের সভায় ঝড়ের আতঙ্ক এজেন্ডাভুক্ত হলে আমরা পইয়ার শীর্ষে শক্ত বাঁধন দিয়ে রাখি। ঢোঙল উড়ে যায় পাটখেতে, আমগাছের ডাল ভেঙে পড়ে। সমাধির ভেতর থেকে বাবা-মা চিৎকার করে বলতে থাকেন, 'নতুন ঘরে সবাই আশ্রয় নাও'। নতুন ঘরটিও এখন আর নতুন নেই। বাড়ির সংস্কার জরুরি অথচ ঔদাস্যের শিকার হয়ে উঠছে বাড়িটি। সুপুরি বাগানে সাপের চলাচল বেড়েছে। তাদের কালো জিহ্বায় ড্রাগনের জমানো আগুন। এতো আগুন কোথা থেকে এলো?

 

মেঘ ও পাণ্ডুলিপি

 

কালো মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে গতিময় বাতাসে পাহাড়ের উড্ডয়ন দৃশ্যমান হয়। পাহাড় প্রতিনিয়ত রূপ বদলায়; ভেসে যেতে যেতে যখন অদৃশ্য হয় তখন সাদা মেঘের সচলতা নীলের আশ্রয়ের ভেতর হামাগুড়ি দিতে থাকে; দূরে সূর্যকিরণ সাদা মেঘের শীর্ষতরঙ্গের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেয়। ক্যাডাস্ট্রাল জরিপরেখা মেঘের স্তূপগুলোকে পৃথক করলেও সকল স্তূপ আসঙ্গ কামনায় ঘনীভূত হয়। তাদের দুর্নিবার যাত্রা সকল আকাশ-সীমানাকে ভেঙে ফেলে। তারা ধরিত্রীর জীবকে বন্ধনহীন যাত্রার জয়ধ্বনি শেখাতে চায়। মানুষ বন্ধনহীন যাত্রার ভেতর দুঃসহ যন্ত্রণার পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করে।

 

বারিস্তা ও মৃত্যুদূত

 

মাঝে মাঝে পুরোনো সহকর্মীর সাহায্য নিয়ে নিমপাতা নিয়ে আসি। আমার চেনা গাছটি বেশ বড় বলে চিকন দুচারটি সপত্র শাখা ভেঙে নেবার সময় মর্মাহত হই না। নিজের স্বার্থকে মানুষ উপেক্ষা করতে পারে না, তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের ক্ষতি ডেকে আনে। বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, কাশীনাথ রায়ের কাব্যসহ কিছু গ্রন্থে উই-কলোনি স্থাপিত হওয়ায় ব্যাগে পুরে সেগুলোকে গার্বেজ ক্যানে ফেলে দিতে হয়েছে। কীটবিক্ষত ও কাদারং কীটমলে চিত্রিত কয়েকটি বইয়ের কাভার ছিঁড়ে সেগুলোর অসহ্য উলঙ্গতা দেখতে হয়েছে আমাকে। আমার জন্য এ দৃশ্য বেদনাদায়ক। আজকাল বই বিষাদের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বইয়ের দিকে যত তাকাই মৃত্যুদূত তত ভেংচি কাটে। মৃত্যুদূত প্রুফ্রকের কোট চেপে ধরে মানুষের অসহায়ত্বের চরম মুহূর্তকে দৃশ্যমান করে তুলেছিল। সে আমার গলিত শরীরের ভবিষ্যচিত্র দেখিয়ে আমাকে বলে, 'দুর্গামূর্তির মাটির শরীরের চেয়ে মানুষের শরীর মূল্যহীন।' আমি শরীরের গৌণতা সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু মানব শরীরের সৌষ্ঠব ও রম্যতা আমাকে মুগ্ধ করে; আমি ফেনায়িত কফির ভেতর তরুণী বারিস্তার রূপ ও রসের প্রত্নতরঙ্গ খুঁজি। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে নিসর্গ, মানুষের রূপ এবং গ্রন্থের ঐশ্বর্য থেকে কিছুকাল দূরে থাকা ভালো।


 

 


5 কমেন্টস্:

  1. কবিতা তিনটি পড়লাম।পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা অসাধারণ। উপলব্ধির গাঢ়তা ও শ্রমলব্ধ বাক্য-ব্যবহার বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে।চেনা জগতকে নতুন করে চিনতে হয়।কবির জন্যে শুভকামনা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. গৌরাঙ্গ মোহান্ত
      আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। নন্দিত থাকুন।

      মুছুন
  2. মোস্তফা তোফায়েল হোসেন:
    'ঢোঙল' ও 'পইয়া'র সাথে আমার পরিচয় উত্তরবঙ্গে জন্ম ও বেড়ে-ওঠার সূত্রে। ঝড় উঠলে থাকার ঘরের পইয়া শক্ত করে বাঁধার তাড়া পড়ে; কিন্তু তা অসময়ে ও বিলম্বে। ঘর ভেঙেই যায়; বাড়ির পশ্চাতের সুপুরিবাগানে আশ্রয় নিতে গেলে মৌলিক ও বাইবেলীয় ঘাতকবাহিনী, সাপের দল ফণা তুলে আক্রমণ করতে আসে।
    এই চিত্রময় বর্ণনার রূপক সৌন্দর্য তার অর্থদ্যোতনাকে অস্পষ্ট না রাখে তো না রাখুক- আমাদের আদিকালের সকল স্মৃতিময় সম্পদকে অমোচনীয় সাহিত্যসম্পদে পরিণত করে। এর প্রশংসা করতেই হয়।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. গৌরাঙ্গ মোহান্ত
      আপনার চমৎকার মন্তব্য আমাকে স্পর্শ করছে। কবিতাটিতে আমি উত্তরবঙ্গের যে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছি সেদুটির বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আপনি ইতিবাচক অভিমত দিয়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই।

      মুছুন
  3. অসাধারণ কবিতা পাঠ করলাম । কবিকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।

    উত্তরমুছুন