রাঢ়ভূমির জঙ্গলমহলের আদিকথা
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণপশ্চিম প্রান্তে
রাঢ়ভূমির জঙ্গলমহল কয়েকশো বছর আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। কালের নিয়মে তার বিস্তার,
পরিধি এবং চরিত্রের হয়তো কিছু কিছু বদল ঘটেছে, কিন্তু মূল প্রকৃতির কোনো বদল ঘটেনি।
সেই অর্থে এই বঙ্গের বাকি অংশের কাছে এই অঞ্চলটি এক সময় নেহাতই স্বল্প দূরত্বের স্বল্পকালীন
পর্যটনের ভূমি হিসাবেই বেশি পরিচিত ছিল। সেটাও সামান্য কিছু জনসমষ্টির কাছে। কিন্তু
দেড় দশক আগেই মাত্র এই বঙ্গের আপামর মানুষের কাছে জঙ্গলমহল একটি অন্য পরিচিতিতে অন্য
মাত্রায় জায়গা করে নেয়। যার বেশির ভাগ জুড়েই ছিল আতঙ্ক। মূলত তৎকালীন মাওবাদী আন্দোলনের
পরিপ্রেক্ষিতেই পশ্চিম মেদিনীপুর ও তৎসংলগ্ন পুরুলিয়ার কিছু অংশ সম্পর্কে মানুষের
এই পরিচিতি হয়েছিল। কিন্তু রাঢ়বঙ্গের জঙ্গলমহল বলতে এর প্রকৃত ভৌগোলিক ও সামাজিক
চিত্র কিন্তু সেটা নয়।
রাঢ়ভূমির জঙ্গলমহলের ইতিহাস কিন্তু
আরও বিস্তৃত। এর পরিধিও ছিল আরও বিস্তৃত এলাকা নিয়ে। মেদিনীপুর বা পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল
সম্পর্কে আমরা সকলেই প্রায় কমবেশি জানি। কিন্তু অবিভক্ত বর্ধমান জেলার জঙ্গলমহল সম্পর্কে
হয়তো অনেকেই জানি না। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা এবং কাঁকসা থানা ও দুর্গাপুর-ফরিদপুর
থানার জঙ্গলঘেরা বিশাল ভূখণ্ডই ছিল এক সময়ের সব থেকে বড় জঙ্গলমহল এলাকা। মাত্র দুশো
বছর আগেও গুসকরা থেকে বরাকর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এক গভীর জঙ্গল। কালের প্রভাবে কিছুটা
প্রাকৃতিক কারণে এবং কিছুটা ওই এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবিকার প্রয়োজনে
সেই জঙ্গল ক্ষয় হতে শুরু করে। পরবর্তীতে বৃহত্তর দুর্গাপুরে শিল্পাঞ্চল গঠন ও তার
বিস্তৃতির কারণে এই জঙ্গলের একটা বড় অংশই নষ্ট হয়ে গেছে।
আজ আর সেই বৃক্ষসমৃদ্ধ জঙ্গলের
কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় না। ল্যাটেরাইট মাটির উর্বরতাসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে এক সময় বিশাল
বিশাল শাল গাছের ঘনত্ব এতটাই নিবিড় ছিল যে, কোনো কোনো জায়গায় দিনের আলো পর্যন্ত
প্রবেশ করতে পারত না। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হান্টার-সাহেবের ‘এনালার্স অফ রুরাল বেঙ্গল’-এ
এই জঙ্গলভূমির বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
যতদূর জানা যায়, ছিয়াত্তর-এর মন্বন্তরে
একমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার করতে করতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের
গ্রাম ছেড়ে চিরতরে শহরমুখী হয়ে পঞ্চত্বপ্রপ্তির পর এই সব এলাকার গ্রামগঞ্জ ধীরে ধীরে
গভীর জঙ্গলে ঢেকে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই জঙ্গলে আশ্রয় নেয় নানা প্রজাতির হিংস্র
শ্বাপদের দল। যাদের অনেকেরই পূর্বতন বাস ছিল
পার্শ্ববর্তী এক সময়ের বিহার প্রদেশের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে। ক্রমে ক্রমে গ্রাম্য
পথগুলিও হারিয়ে যায় সেই জঙ্গলে।
সেই জনমানবহীন জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া
পথে একদিন একদল সৈন্য প্রায় শ-খানেক মাইল দীর্ঘ বনভূমি মাড়িয়ে পৌঁছোয় বীরভূমের
রুক্ষ প্রান্তরে। কিন্তু একটু বিশ্রামের জন্য
তাঁবু ফেলার কোনো প্রান্তর নেই! নেই কোনো জনপদও।
বীরভূম তখন এক জনমানবহীন বন্ধ্যা দেশ। মন্বন্তরে
বীরভূমের ছ-হাজার গ্রামের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গজিয়ে
ওঠা জঙ্গলে ঢেকে গেছে। মন্বন্তরের সময়ই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কৃষিজমি ঢেকে গেছে আগাছা
আর ঝোপ-জঙ্গলে। চাষ করার মানুষ নেই। এমনকি নেই পড়ে থাকা চাল কিনবার মানুষও। এক টাকায়
এক মন বা দেড় মন বিক্রি হতো যে চাল, সেই চাল তখন তিন টাকা সের। ফলে না খেতে পেয়ে মারা
গিয়েছিল প্রায় আশি লক্ষ মানুষ। জনশূন্য জনবসতি জুড়ে শুধুই নিস্তব্ধ দীর্ঘশ্বাস।
এর পরই ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-সরকার ওই এলাকার বিস্তৃত
জঙ্গলে বন্য হাতি আর বাঘের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তাদের নিধন করতে ডেকে আনল কর্মঠ আর
সাহসি আদিবাসী সম্প্রদায়কে। তখন পশ্চিমের সীমান্তবর্তী এই এলাকার বীরভূম থেকে বিষ্ণুপুর
পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বৈদ্যনাথ ধাম পর্যন্ত সমগ্র এলাকাই বীরভূম নামে পরিচিত ছিল। তারপর বীরভূম নামে আলাদা
একটি জেলা তৈরি করে সদর শহর বিষ্ণুপুর থেকে সিউড়িতে নিয়ে আসা হল। তখন সিউড়িতে না আছে
কোনো পাকা দালানকোঠা, না আছে সমাজজীবনের কোনো সুব্যবস্থা। অফিস-কাছারি করার জন্য তেমন
কোনো ভালো বাড়িই পাওয়া যায়নি। মেলেনি জেলা কালেক্টর-এর অফিস বানানোর জন্য কোনো আবাসস্থল।
এই ভূমিরই লাগোয়া বর্ধমান অঞ্চলের
একটি অংশ গোপভূম-এর সেনপাহাড়ি পরগনা। প্রাচীনকালের অজাবতী, আজকের অজয় নদীর দক্ষিণে
ছিল সেনপাহাড়ি আর অন্য পারে ছিল সেনভূম। সেখানেই ছিল সাতকাটার জঙ্গল। সেই অঞ্চলের
কাঁকসার রাজবংশের নিজেদের ভেতর কলহ ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহিরাগত মুসলিম আক্রমণকারী
সেনাদল প্রায় ধ্বংস করে দিলো। সৈয়দ বুখারীর নেতৃত্বে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোপভূম-এর
উপরে।
কাঁকসার উত্তরের জঙ্গলভূমিতে আক্রমণকারীদের
হাতে রাজবংশের সাতজনের মৃত্যুর পর জঙ্গলের আরও গভীরে ‘উৎগড়’-এ আশ্রয় নেয় কাঁকসার রাজবংশের এক বংশধর
ও তাঁর পরিবার। পরবর্তীতে সেই জঙ্গলের নামই হয় 'গড়জঙ্গল'। অজয়ের অন্য পারেও বিভিন্ন
জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে গিয়েছিলেন বলে সেখানকার নাম হয় সেনভূম। যার মধ্যে আছে কাঁকসা এবং
আউসগ্রাম। এই কাঁকসা ও আউসগ্রামের জঙ্গলভূমিই বর্ধমান জেলার ‘জঙ্গলমহল’।
এই ভাবেই এক সময়ে রাঢ়ভূমির যে
জঙ্গলমহল বিস্তৃতি পেয়েছিল, আজও সেই জঙ্গলমহল বেঁচে আছে স্বমহিমায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই
সে তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় গাছ লাগিয়ে গাছ বাঁচিয়ে
জঙ্গলমহলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই প্রাচীন
শ্রী কি সে আর ফিরে পাবে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন