কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

অদিতি ফাল্গুনী

 

সমকালীন ছোটগল্প




রুক্সিনী কানুর দিনযাপন

 (১)

মা বলতো চা পাতা আর সূর্যের আলো সতীন আছে। সূর্যের আলো বেশি কড়া হবেক ত’ চা পাতা বেশি জন্মাবে না। কি জন্মালে ঘন হবে না। ভারি হবে না।আর বৃষ্টি দ্যাখো চা পাতার দুলহান আছে বটে। আসমান ঘন করে বারিস নামে ত’ বেশুমার সবুজ চা পাতায় ভরে যায় এই লস্করপুর ভ্যালি থেকে সিলেট ভ্যালি অবধি অসঙখ্য বাগান। ডানকান বা ফিনলের মত বৃটিশ সাহেবদের তৈরি চা বাগান বলো কি এখন বাঙালী ম্যানেজারদের চা বাগান বলো…বৃষ্টি আসবে কি দেখতে দেখতে চা পাতাগুলো পুরুষ্টু আর ভারি হয়ে উঠবে। সকাল থেকে দুপুর অবধি পয়লা দফার কাজ শেষে চা পাতা মাপতে গেলে হেসে-খেলে সতেরো থেকে একুশ কেজি কি তার বেশি ঝুড়ির ভার দেখায় মেশিনে। কলম চারার চা পাতা হলে মেশিনে একুশ কেজি আর ফুলি চারা চা পাতা হলে সতেরো কেজি ভার দেখালেই ব্যস, পেয়ে গেল হাজিরার টাকা। বৃষ্টিতে একটু ভিজতে হয় বটে…সে কি বাগানিয়া মেয়েদের অভ্যাস নেই বুঝি? কিন্ত্ত ঘন্টা দুই কাজ করলেই ঝুড়ি ভরে উঠে। পহেলা দফাতেই সকাল আর বিকাল…দুই দফার কাজ উঠে যায়। সেই সাথে বাড়তি কাজের টাকা। আর দু’বেলা কাজ করলে ত’ কথাই নেই। অনেকটা বাড়তি টাকা মিলে যায়। অন্যদিকে এই চৈত্র থেকে অগ্রহায়ণ- ইঙরেজি মাসের যাকে বলে মার্চ থেকে ডিসেম্বর- যখন সূর্য থাকে চড়া তখন চা পাতা হয় না। বাগান কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া হয়ে যায়। বহুত বল আছে যেসব বিটি বা মরদলোকের তারা পর্যন্ত বেশি চা পাতা পায় না। হাজিরার সমান মাপের পাতা সারাদিন ধরে তোলা যায় না। অথচ বৃষ্টির সময় সারাদিন চা পাতা তুলে কাজ শেষ হয় না। মরণ তক মা বৃষ্টির ভেতর খুব খাটতে পারত। কি খাটিয়ে ছিল মা! কোনদিন তবু একটু জ্বর-কাশি হয় নি তার। বৃষ্টির দিনের ভর সন্ধ্যায় ভিজে সপসপে শাড়ি-ব্লাউজে ঘরে ফিরে মা শুকনা শাড়ি পরেই চোলাই বানাতে বসে যেতো। একটু চোলাই খেলেই মা ফের চাঙা! মা ছিল যেন দশভূজা। ঐ দুর্গা মায়ের মতোই। বাগান থেকে ফিরে এক হাতে আটা মেখে রুটি বানাচ্ছে, গরম গরম রুটি তরকারি খেতে দিচ্ছে তাদের ভাই-বোনদের, চোলাই বানিয়ে বাবাকে দিচ্ছে আর নিজে একটু খেয়ে নিচ্ছে গা গরম করতে, গরুর দুধ দুয়ে বিক্রি করছে কাছের রেল লাইনের পাশের বাজারে, সকালবেলা রুক্সিনীকে স্কুলে পাঠানোর জন্য গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে, “রুকমিনী- উঠ্ রে বিটিয়া- উঠ্! লিখা পড়াহ না করবি ত’ আমার মতই চা পাতি তুলে জিন্দেগি সারা হবে! আরে এ রুকমিনী- হায় হায় বিটিয়ার নাম হামি রাখলাম কানহাইয়া ঠাকুরের বিবি রুকমিনীর নামে আর বিটিয়া কিনা স্কুল কামাই করে ঘুমায়!’

মা’র গায়ে ছাপা শাড়ি বাম দিক থেকে ঘুরিয়ে পরা। কপালে বিন্দি। আজ মাথায় অনেকটা লম্বা হয়ে আয়নায় তাকালে নিজের ভেতর মা’র প্রতিফলন দেখে চমকে যায় রুক্সিনী। সে কি মা’র মতই দেখতে হয়ে উঠছে দিন দিন? এক বৃষ্টির দুপুরে বাগানের অনেকটা গভীরে অনেক বেশি চা পাতা তোলা আর সপ্তাহের তলপে বাড়তি টাকার স্বপ্নে বিভোল মা’কে একটি বিষধর সাপ ছোবল দেবার পর লেবার কলোনীর উঠোনে এনে রাখার পর লম্বা আর ফ্যাকাশে ফর্সা মা’র মতই কি দেখতে লাগছে না রুক্সিনী কে? ফুলবাড়ি চা বাগানের সেই লেবার কলোনীতে তারা ছিল মাত্র ছয়/সাত ঘর উত্তর প্রদেশের মানুষ। পদবিতে তারা কানু। ভূমিজ, পাত্র, রাজবঙশী, মুণ্ডা এমন নানা জাতের বাগানিয়ার ভেতর ইউপিঅলা কি উত্তর প্রদেশ থেকে আসা তারা ছিল মাত্র কয়েক ঘর। অন্যদের দেখে তারা দেখতে একটু আলাদা। সটান লম্বা আর বেতস লতার মত ছিপছিপে, গৌরবর্ণা কানু মেয়েদের দেখলে বাগানের সাফ-সুতরো, ভদ্রলোক ম্যানেজারদের পর্যন্ত নি:শ্বাস ঘন হয়ে আসে। রুক্সিনীর মা যৌবন পুরোপুরি পার না হতেই বিধবা হয়েছিল। সেটা রুক্সিনী যেবার ছয় ক্লাস থেকে সাত ক্লাসে উঠছে সেসময়ের কথা। মা’র নাম ছিল যশোদা। বাবা মারা গেলে যশোদা মা তখন মা আর বাবা দুইই একসাথে হয়ে উঠছে। কিসে যেন মারা গেছিল বাবা? ঐ চা বাগানের লেবাররা যেভাবে মারা যায়। খাটুনি আর মদ। মদ আর খাটুনি। তখন ত’ বড় দাদা এগারো ক্লাসের পড়া ছেড়ে বাবার কাজে নেমে গেলো। মা চা পাতা তোলে আর দাদা বাগানে বাবা যে ভারি কাজগুলো করতো, সেই কাজগুলোয় হাত লাগায়। বাগানে ড্রেন তৈরি, শণ কাটা, বৃষ্টির দিনে নতুন চারাগাছ লাগানো, শেডট্রি লাগানো…দেখতে দেখতে রঘু দাদার হাত-পাগুলো শক্ত, খসখসে হতে থাকে। শক্ত-পোক্ত পুরুষালি গড়নের চেহারা পেতে থাকে রঘু দাদা।
“শুন্ বেটা- তোর নজর খারাপ আছে। সতারো উমর পুরা হয় নাই তোর আর তু ঐ বাকতি লেড়কির পিছ নিয়েছিস? আরে- উ কালা লেড়কিকে ত’ হামি ঘরের বহু মানব না- আমরা ইউপিঅলা। তাতে উর বাবা ত’ গতবার খ্রিষ্টান ধর্ম লিয়েছে।ইউপি থেকে তোর বাপ-দাদা এই বাগানে আসে সেই শ পঞ্চাশ সাল আগে- হৃষিকেশ যেখানে গঙ্গা মাঈয়ের ঘর…সেই হৃষিকেশের আদমি তারা। রামজি কিষেনজির পূজা করি আমরা কানুরা আর তু কিনা এক খ্রিষ্টান লেড়কির পিছ ঢুড়িস?”
রঘু দা কিছু বলে না। ক্রুদ্ধ মা রুটি-তরকারি পাতে বেড়ে দেবার পর নির্লিপ্ত ঢঙ্গে এক গ্লাস হাড়িয়া রঘু দা’র দিকে এগিয়ে দেয় যেমন আগে বাবাকে দিত। যেন দিনের কাজের ক্লান্তি চলে যায়, শরীরের ব্যথা-বেদনা ভুলে যেতে পারে। বিধবা হবার পর থেকে মা আর হাড়িয়া খায় না। শরীরে যত ব্যথা হোক! লক্ষ্য করেছে রুক্সিনী। শুধু লবণ আর আদা দিয়ে চা বানানোর বহর বেড়েছে মায়ের। এক কাপ চা ঠকাস করে রুক্সিনীর সামনে রাখে মা, “খা লবাবের বিটিয়া! তুদের বাপ মরে স্বর্গে গিয়াছে কি বৃন্দাবন গিয়াছে তা’ কানহাইয়া ঠাকুরই জানে! যতদিন পারব তুকে স্কুলে পড়াবো আর তারপর বিহা দেব। ইখন চা খেয়ে আমাকে মন্দকিনী পার কর্। বৈকুণ্ঠ কি পাশ যাব কিনা!”
তারপর সেই ভর রাতে চাপকল থেকে বালতিতে তোলা জলে দিনে দ্বিতীয়বারের মত স্নান করতো মা। বিধবা হবার পর স্নান করা কি পূজা করার বাতিক বেড়ে গেছিলো মা’র। দ্বিতীয় দফা স্নান সেরে মাটির ঘরে বঙশী হাতে বালগোপালের ছবির সামনে মা ধূপ-ধূনা জ্বালিয়ে ভজন গাইতো গুনগুন করে, “আজো শাম মোহোলিয়ো বানশরি বজালো কে? বানশরি বজালো কানহাইয়া, মুরলী শুনালো কে? হর হর শিব করতো যাত, গাগরি শির ভরত যাত, নির নার ভরণ চলি, সুধ নার হি হার কে!”
সে কোন্ হৃষিকেশ নামের গঙ্গা মাঈয়ের তীরের এক ছোট্ট শহর। মেয়েরা সেখানে ঘাগড়া চোলি পরে ঘুরে বেড়াতো। কানহাইয়ার বানশরি শুনতে রাধা নামে এক মেয়ে গাগরি ভরার ছলে, শিবের নাম নিয়ে বারিস টুপটাপ নদীয়ায় যাচ্ছে একা একা। রুক্সিনী- সে কে? গোয়ালা যাদব বঙশের পুত্র কানহাইয়া ভগবান যাকে রথে তুলে নিয়ে পালিয়েছিলেন, তুমি কি সেই রুক্সিনী? মা কি বাবা ডাকতো রুকমিনী বলে? বাঙলা স্কুলে সবাই ডাকে রুক্সিনী? এখন এই ঝমঝম বৃষ্টির ভেতর টুকরিতে পাতা ভরতে ভরতে রুক্সিনীর মনে হতে থাকে যদি একটি সাপ এসে মা’র মত তার পায়ে আলতো চুমু খায়? রঘু দাদা আজ ছয় মাস হয় জেলে। মা’র মৃত্যুর পর বাকতি ঘরের কালো মেয়ে নির্মলা জুলিয়েট বাকতিকেই রঘু দাদা ঘরে আনলো। তা’ নিয়ে পঞ্চায়েতের বিচার বসলো। মা’র কানের এক জোড়া রূপোর মাকড়ি বেচে জরিমানার পয়সা দেয়া হলো। বড় দাদার খ্রিষ্টান মেয়ে শাদি করার জরিমানা। কানহাইয়া ঠাকুরই জানে ঐ কালো মেয়েকে নিয়ে দাদার এত সন্দেহ বাতিক কেন আর এত পেয়ার কেন? মানে পেয়ার না থাকলে, বিবিকে খুব দামি মনে না করলে এত অকারণ সন্দেহ হয় না কোন পুরুষের। তবে বহু মানে ভাবি কিন্ত্ত তার ভাল চরিত্রের মেয়ে। দাদারই থেকে থেকে অকারণ সন্দেহ। একবার ভাবির এক মামাতো ভাই এসেছিলো বহু দূরের এক চা বাগান থেকে। দাদা তাকে আগে দ্যাখে নি। সন্ধ্যা বেলায় কাজ থেকে বাড়ি এসে সেই ভাইয়ের সাথে ভাবিকে হাসতে দেখে হাতের হাসুয়া দিয়ে পেয়ারের বিবিকে এমন আঘাত করলো যে ভাবি প্রায় মরে মরে! কি রক্ত আর কি জখম! সেই জেল হয়ে বসলো দাদার। ভাবির আবার বাচ্চা হবে। সে কাজ করতে পারছিল না। ছোট ভাইটির স্কুল, সঙসারের খরচ, ভাবির পেটে রঘু দাদার বাচ্চা...সব ভার মাথায় নিয়ে লম্বি বা দীর্ঘাঙ্গিনী যশোদা কানুর তেম্নি লম্বি বিটিয়া রুক্সিনী কানু একদিন তার মা’র মতই টানটান, দীর্ঘ পদক্ষেপে পিঠে টুকরি নিয়ে চা পাতা তোলার কাজে বের হয়ে পড়লো। সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি ফিরলে কাম থেকে ফেরা মরদ মানুষকে যেমন আদর-যত্ন করা হয়, তেমন আদর-যত্নে ভাবি তাকে চা বানিয়ে দেয়, ভাত বেড়ে দেয় আর হাসুয়া দিয়ে তাকে জখম করা স্বামীর জন্য কান্নাকাটি করে, “পেয়ারের বাড়াবাড়ি। এ ত’ অত্যাচার! তবু তোমার ভাইকে জেলে না নিতে পুলিশ বাবুর পা ধরলাম- পুলিশ আমার কথা শুনল না। জেল থেকে খালাস হলে বাড়ি এসে বাচ্চার মুখ দেখবে ত’ বুঝবে কত অন্যায় করেছে- বাচ্চার মুখ দেখো ঠিক বাপের মতই হবে!”
অভিমানে ভাবির চোখে জল টলমল করে আর তখন রুক্সিনীর তার নিজের থেকে এই কালো ভাবিকে ঢের বেশি সুন্দরীতর মনে হয়। রুক্সিনী গোরি, রুক্সিনী লম্বি...দশ ক্লাস পড়া রুক্সিনীকে রাস্তায় কি বাগানে বাঙালী কি বাগানিয়া সবাই অবাক হয়ে দ্যাখে...তবু রুক্সিনী জানে আজো তার দেহে-মনে সেই রঙ লাগে নি যা কেবল একজন পুরুষই লাগাতে পারে একজন নারীর দেহে-মনে...আর সেই রঙ কি সেই ঘোর যখন কোন নারীর দেহে-মনে লাগে, তখন তার রূপের পাশে কে সিধা হতে পারে? রুক্সিনী যে আজো পারছে না! ইসশ্...দ্যাখো ভাবির চোখে কেমন মায়া...মুখ লজ্জা আর আবেশে লাল...যেন ফাগুয়া পরবের সব রঙ, লাল পরবের সব আবির ভাবির নাকে-মুখে কে লাগিয়ে দিয়েছে! যে মরদ তাকে অন্যায্য সন্দেহ করে, অন্তসত্ত্বা অবস্থায় হাতে আর পিঠে হাসুয়ার কোপ দিয়েছে, চা বাগানের হাসপাতালে তিন দিনের স্যালাইন থেকে উঠতে না উঠতে ডাক্তাররা ভাবির বুকে নল চেপে জেনেছে যে সে বাচ্চার মা হতে চলেছে...রুক্সিনীর সেই রঘু দাদার কথাই চব্বিশ ঘণ্টা ভাবে মেয়েটি। সেই মরদের বাচ্চার জন্যই সে কাথা সেলাই করে, সারাক্ষণ স্বপ্ন ঢালা চোখ-মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রুক্সিনীর মনে অমন পেয়ার নেই কেন? কাকেই বা পেয়ার করবে রুক্সিনী? এই বাগানে কানু যে কয়েক ঘর আছে তারা, সব ঘরের পুরুষগুলো হয় বিবাহিত পুরুষ অথবা বাচ্চা ছেলে যারা কিনা রুক্সিনীর চেয়ে বয়সে ছোট। দাদা ইউপির ছেলে হয়ে আসাম থেকে আসা কালো বাকতি মেয়ে বিয়ে করেছিল বলে মা’র আপসোষ ছিল খুব। রুক্সিনী ভিন জাতে বিয়ে বসবে না। তবে কাকেই বা বিয়ে করবে সে? আবার সবাই ত’ তারা লেবার জাত বটে। শ্রমিকের জাত। তবে এত ভেদই বা কেন? তার সমান ঘরে পাত্র পেতে হলে তাকে ত’ ফিরে সেই ইউপি চলে যেতে হবে। ইউপি গেছে সে দু/একবার। এখনো কিছু আত্মীয় আছে সেখানে। তবে বেশিদিন মন লাগে নি। আবার এই চা বাগানেই ফিরে এসেছে।
“রুকমিনী- রুকমিনী!”
এত গভীর রাতে তার ঘরে কড়া নাড়ে কে? না, দুই নারীকণ্ঠই। দরজা খুললে দ্যাখে সাগরী আর বেহুলা পাত্র।
‌‌‌‌‌‌‌“কি নিদ্ রে বাবা- বাগানে আগুন আর তুই নিদ যাস?”
সত্যিই ত’ ফুলবাড়ি চা বাগানে আগুন জ্বলে উঠেছে। কে ধরালো আগুন? ভারি উদর নিয়ে ক্লান্ত ভাবি ঘুমিয়ে ছিল রুকমিনীর পাশেই। সে ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
‌‌“মহাদেবের শাপ-মহাদেবের শাপ-বাগান ত’ আগুনে খেয়ে নিবে”— বলে শোরগোল তুলছে বাগানের প্রবীণেরা। সেই রাতটা কেটেছিল আগুনের আলো আর লেবার কলোনী জুড়ে তুমুল হৈ চৈয়ের ভেতর। আর সকাল বেলাই ভাবির উঠেছিল ব্যথা। তীব্র ব্যথা। লেবার পেইন। ভাবির দু’বছরের ছোট, অবিবাহিত ননদ সে। তখনো তার নিজের বিয়ে হয় নি। পুরো পরিবারের সে-ই যেন পুরুষ মানুষ। এর তার হাত-পা ধরে, একটা ভ্যানগাড়ি এনে ভাবিকে নিয়ে সে ছুটলো হাসপাতালের পথে। যেতে যেতে দেখলো ফুলবাড়ি চা বাগানের সামনে রেল লাইনের পাশে পড়ে আছে অসঙখ্য দগ্ধ আর অর্দ্ধ-দগ্ধ হারো, বাতারু, ডুপি, ময়না আর টিয়া পাখির শব।
“রুকমিনী দিদি-রুকমিনী দিদি!”
চা বাগানের সামনে রেল লাইনের পাশে তাম্বু খাটিয়ে যারা কিছুদিন ধরে কাজ করছিল তাদের একজন ঐ ময়মনসিঙহ থেকে আসা রহিম নামের ছেলেটি। নিজে থেকে রুকমিনীর সাথে কয়েকদিন কথা বলতে এসেছে। মাঝে মাঝেই রুকমিনীকে সে ফুল দেয়।
“দিদি- তোমার জইন্য এই চাম্পা ফুল পাড়লাম” কি “দিদি-দরো, তোমার জইন্য দুইডা জবা ফুল পাড়লাম।“
একদিন রহিমকে তার তাম্বুর এক বয়েসী লোক ঠাট্টাই করে বসলো, “রহিম বাদশা আর রূপবানের কেস হইলো নাকি তর, অ রহিম?” ঠাট্টাটা বুঝেছে রুকমিনী। সেই থেকে রহিমকে দেখলে অস্বস্তি হয় তার।
“দিদি গো- কই যাইবাইন?”
“হাসপাতাল। এখন সময় নাই।’’
ভ্যানে চেপে এবঙ দাদার বউকে চাপিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে ছুটতে পথেই রুকমিনী দ্যাখে রুণা নিয়া, নাইয়ো লাঙ, সরি খঙলা আর রেমি পনঙকে। খাসি মেয়েরা বলতে গেলে পানপুঞ্জি থেকে বেরই হয় না। ঐ এক স্কুলে যা দেখা হতো। আজ পানপুঞ্জি থেকে বের হয়েছে কেন?
‌প্রসবের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেই নির্মলা জুলিয়েট বাকতি জিজ্ঞাসা করে আগুনে খাসি মেয়েদের পানপুঞ্জি পুড়েছে কিনা? সেবার আগুন লাগার পর ঢাকা থেকে অনেক সাঙবাদিক এসেছিল। তারা ইনোকল (ইউনোকল), মাগুরছড়া এসব শব্দ মিলিয়ে আশপাশের সবাইকে নানা প্রশ্ন করতো যার কোন উত্তরই রুক্সিনী জানত না। সে শুধু জানতো তাদের চা বাগানের অনেকটা জায়গা পুড়ে গেছিল, সামনে বিধ্বস্ত হয়েছিল রেললাইন, অনেক পাখি মরে গেছিল আর খাসি মেয়েদের পানপুঞ্জিতে অনেক পান গাছ পুড়ে গেছিলো।

(২)

প্রথমে ফাড়ি বাগানের ছোট্ট টিনের শেডের হাসপাতাল থেকে মূল চা বাগানের হাসপাতাল হয়ে উপজেলার হাসপাতাল ঘুরে শেষতক রঘু দাদার বউয়ের কোলে ছেলে এলো বটে। সেই লবকুমারের বয়স এখন বারো। রঘু দাদা জেল থেকে ছাড়া পেল মাস চারেক পর। ছেলের মুখে নিজের মুখ কেটে বসানো দেখার পর থেকে আর সে বউকে সন্দেহ করে নি। ঘরে ফেরার দু’মাসের মাথায় রঘু দাদা মৌলভিবাজার থেকে অনেক দূরে হবিগঞ্জের চান্দপুর চা বাগানের অর্জুন কানুর সাথে রুক্সিনীর বিয়ে ঠিক করলো। অজুর্ন কানু অবশ্য বিয়ে ঠিক হবার মাস খানেক আগে এই ফুলবাড়ি চা বাগানে এসেছিলো মামা বাড়ি বেড়াতে। হাতে তীর নিয়ে একটি পাখির দিকে তাক করার সময় রুক্সিনীর সাথে তার দেখা হয়।

“এই ধেনুকে (ধনুক) দ্যাখ্। ত্রেতায় রামের ধেনু আর দ্বাপরে অর্জুনের এই ধেনু। সব জুলুমের জবাব এই ধেনু! রাম ত’ সীতা মাঈকে শাদি করেছিলেন ভারি একটা ধেনুক উঠিয়ে...”
কেন জানি লজ্জিত হয়েছিল রুক্সিনী। জীবনে কখনো মাথা নীচু না করা রুক্সিনী সহসাই অবনত হয়েছিল লজ্জায় আর সেই প্রথম সে অনুভব করে যেন এক আশ্চর্য আবির তার চুল থেকে কপাল হয়ে গাল বেয়ে আর গলা হয়ে ক্রমাগত বাহিত হচ্ছে গোটা শরীরে। ফাগুয়ার সব রঙ, লাল পরবের সব আবির তার গায়ে লেগে যাচ্ছে! তবু শাদির বছর না ঘুরতে সেই রুক্সিনীর গায়েই উঠলো কিনা সাদা থান? ট্রেড ইউনিয়নের যে নেতাকে বিশ্বাস করে স্ট্রাইকে গেছিল অর্জুন, সেই নেতাই যখন লেবারদের ইজ্জত বেচে দিল মালিকের কাছে...কারখানা থেকে চাকরি যাবার পর এক ভোর রাতে কখন সে রুক্সিনীর কাছ থেকে উঠে গিয়ে নিজের হাতে জীবন শেষ করলো কে জানে! চাকরি গেছে বলে রুক্সিনী ত’ তাকে গাল-মন্দ করে নি।বরঙ সেই রাতে ভালবাসা দিয়ে অজুর্নকে সব দুঃখ ভুলাতে চেয়েছিল। নিথর অর্জুন সেই রাতে ভালবাসা নেয় নি। শুধু বলেছিল যে তার বড় মজবুরি হয়েছে আর রাতটা সে ভাল মত ঘুমাতে চায়।রুক্সিনীর গর্ভের সন্তানের কথা একবার ভাবল না অর্জুন?
“মাঈ!‘
অধিরথ স্কুল শেষ করে ঘরে ঢুকছে। বাগানে এখন স্ট্রাইক চলছে। প্রতিদিন সকালে দু’ঘণ্টা স্ট্রাইক চলে। তারপর কাজ শুরু হয়। রুক্সিনীকে এখন কাজে যেতে হবে। এর ভেতর অধিরথের জন্য দুপুরের রান্না সেরেছে সে।
“বড় রাস্তার পাশে হাজার হাজার মানুষ রে মাঈ! কেউ ইকোনো জোন চায় না! বাপার তিন কিয়াড় জমি কি বেহাত হবে মাঈ?”
“শুধু জমি না রে বেটা...তোর বাপের শ্মশান যে ঐ জমিতে!”
“কাল যে ডিসি অফিসে নাকি যাবে সব- তুই যাবি মাঈ?”
“যাব বেটা-’’
“কি করিস মাঈ? কি ঘসিষ?”
অর্জুনের মরিচা পড়া তীর-ধনুক তখন মাত্রই ঘষে ঘষে চকচকে করে তুলছিল তার বিধবা স্ত্রী রুক্সিনী। কপালে লেপ্টে থাকা একগাছি চুল ডান হাতে তুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায় রুক্সিনী, “তোর জন্য বেটা। এগারো বছর বয়স হলো না তোর? বাপা নাই-এই ধেনুক এখন তোর!”


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন