সমকালীন ছোটগল্প |
মায়া
এই চারকাঠা জমিটা মিলি কিনেছিল
২০০৪ সালে। তখন এই ঢালুয়া অঞ্চলে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে শুধু মাদুরকাঠির বন। একটা সরকারি
জুনিয়র হাইস্কুল, কয়েকঘর এখানকার আদি নিবাসীর সাথে কয়েকঘর বিহার-ঝাড়খন্ড থেকে আসা মানুষজন,
একটা বিসদৃশভাবে বৃহৎ টেকনিক্যাল কলেজ, বর্ষায় হাঁটুডোবা জল, প্রচুর গোয়াল আর হরিমুদির
একটা দোকান, যার একপাশে দুপুরবেলা হরিমুদির বউ কলেজের কয়েকজন স্টাফকে ভাত খাওয়াত। হরিমুদির
দোকানের সামনে অটোস্ট্যান্ড থেকে সাকুল্যে চারটে অটো চলতো গড়িয়া স্টেশন অব্দি। দিনের
বেশীরভাগ সময় ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই থাকতো না। গরুর মাথায় মাথায় সাদা বকেরা চড়ে বসে
থাকত। নির্জন দুপুরে কুবোপাখির ডাক ভেসে আসত। ক্লাস সিক্সের অঙ্কক্লাস নিতে নিতে একটু
অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত মিলি। সন্ধ্যে নামার আগে
নাককাটি পাখিরা আকাশে ফিবোনাকি সিরিজে চক্কর কেটে তাদের কুলায় ফিরত। মিলি ব্যাগ গুছিয়ে
ততক্ষণে অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে জরিপ করত স্থানীয় মানুষদের ভাবভঙ্গি ও ভাষা। কোনো চাহিদা
নেই এদের জীবনে তেমন। একটু পেটভরা ভাত, দুপুরে হাতপাখা ঘুরিয়ে ঘুম–এর বেশি কিছু পেলে
যেন মহা সমস্যায় পড়ে যাবে তারা, এমনিই সহজ সরল মানুষ সব। তবে, পুজো-আচ্চা বেশ লেগে
থাকত। মাঝেমধ্যেই মিলি দেখত, খড়মড়ে সুতির শাড়ি আর সিঁথিতে মেটে রঙের সিঁদুর থেবড়ে সাজিতে
পুজোর ফলমূল নিয়ে সারি বেঁধে বউগুলি যাচ্ছে পুকুরপারে। পুকুরটা স্কুলের মাঠের পাশেই।
শান্ত সবুজ ঠান্ডা জল পুকুরের। টিফিনের সময় মিলি দাঁড়িয়ে থাকতো কিছুক্ষণ তার পাশে।
একদিন সরসর করে আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে দেখে, ঠিক ছ ইঞ্চি দূর দিয়ে প্রায় তিনফুটের একটা
সাপ চলে যাচ্ছে। তারপর তো গত কুড়ি বছর ধরে সেই আধা গঞ্জ জায়গাটা মিলির চোখের সামনেই
একটু একটু করে কেমন একটা আধুনিক শহরের রূপ নিল। পুরোটাই স্বপ্নের মতো মনে হয় মিলির।
এই এতোদিন ধরে ওর এই চারকাঠা জায়গায় ও মনের সুখে গাছ লাগিয়েছে, বন্ধু ও কলিগদের নিয়ে পিকনিক করেছে হইহই করে, কিন্তু
এখানে বাড়ি বানানোর কথা মাথাতেও আনেনি।
দুবাই থেকে ফিরে এসে ওর বর ধীমান এবার প্রস্তাবটা দিল, 'ফ্ল্যাটটা বেচে দিয়ে এবার একটা বাড়ি বানাই, চলো।'
'কোথায় বানাবে!'
'কেন, তোমার জমিতে!'
'ধ্যাৎ! ওখানে এখনো জল জমে যায় একটু বৃষ্টি হলেই। জলের কোয়ালিটি
খুব খারাপ। চুলের দফারফা হবে'
'আরে বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে! শুরু
তো করা যাক!'
অগত্যা।
এগারো মাস পর সেই বাড়িতে আজ ঢুকছে
মিলিরা। একদম সকালবেলা মিলি যখন এসে পৌঁছল পুজোর সামগ্রী নিয়ে, মায়া-মাসীমা এক বাটি
পায়েস দিয়ে গেলেন এসে। মিলি তো অবাক! 'এই এতো সকালে আপনি এসব কেন করতে গেলেন?'
'তুলসীতলায় দিও। আমি আলপনা দিয়ে
রেখেছি। আর সন্ধেবেলায় পাড়ার বাচ্চাদের ডেকে একটু হরির লুটের আয়োজন করো।'
'আপনি দুপুরে এখানেই খাবেন কিন্তু
আজ, মাসীমা।'
এই এগারো মাস ধরে মিলি যখনই এই বাড়ির দেখভাল করতে এসেছে, মায়া-মাসীমা এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। দক্ষিণের বারান্দাটা উনিই বলে বলে বের করিয়েছেন মিলিকে দিয়ে। গাছগুলো কাটা পড়ছিল যখন, মিলি খেয়াল করেছে, মাসীমা আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে নিলেন। 'একটুখানি উঠোন রেখো, মিলি। এককোণায় একটা ছোট্ট তুলসীমঞ্চ বানিও।' –বলেছিলেন মাসীমা। আজ সেই তুলসীমঞ্চ ঘিরে ভোর ভোর এসে আলপনা দিয়েছেন উনি। খড়িমাটি শুকিয়ে গিয়ে কী মনোরম সব কল্কা ফুটে উঠেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মিলি।
পুজো, হইহই, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, খাওয়াদাওয়া – সবকিছু নিয়ে সারাদিন মেতে থাকল মিলি আর ধীমানের নতুন বাড়ি। বিকেলে সবাই ফিরে গেলে মিলি হরির লুটের আয়োজন করতে বসলো। পাড়ার কচিকাঁচার দল আসতে শুরু করল। সঙ্গে এলো তাদের মা-কাকিমা-দিদিমা-ঠাকুমার দল। মিলি অপেক্ষা করছিল মায়া-মাসীমার জন্য। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে এবার। উঠোনে জমা হওয়া দলটি উসখুস শুরু করেছে এবার। মিলি জিজ্ঞেস করল ওঁদেরকে, 'মায়া-মাসীমার বাড়িতে কেউ খবর দেবেন একবার? কেন যে দেরি হচ্ছে এতো! শরীর খারাপ হল না তো? দুপুরেও আসেননি!'
ওঁরা একটু অবাক হলেন। এ ওর মুখের
দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন 'কার কথা বলছেন গো? কোন মাসীমা?'
'মায়ামাসীমা। ওই পূবের বাড়িটার।
সকালেই এসেছিলেন। একটু অপেক্ষা করুন। আমি ডেকে
নিয়ে আসি।'
পায়ে চটি গলিয়ে যেতে উদ্যত হতেই এক বয়স্ক মহিলা এসে হাত ধরলেন মিলির। অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন 'কার কথা বলছেন, ম্যাডাম? ও বাড়ি তো আজ তিরিশ বছর তালাবন্ধ। আমার ছেলেই দেখাশোনা করত। গতমাসে বিক্রি হয়ে গেছে বলে শুনেছি।'
মিলি দৃঢ় গলায় বলল, 'না না। আপনাদের
ভুল হচ্ছে। আজ সকালেও তো মাসীমা এসেছেন! আলপনা দিয়েছেন। পায়েস দিয়ে গেছেন'।
'ও বাড়ির কত্তামা শুনেছি তিরিশ
বছর আগে ওই স্কুলের সামনের পুকুরে ডুবে মারা গেছিলেন। আমাদের দুগগামন্ডপে ওঁর আলপনা
আর ভোগ রান্নার গল্প আমরাও শুনেছি বিয়ে হয়ে এসে এ পাড়ায়। কিন্তু আপনি কার কথা বলছেন,
বুঝতে পারতিছি না'
মিলি কেমন বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করল,
'ওঁর কি কপালে শ্বেতী ছিল, কেউ জানেন?'
দলের সবথেকে বৃদ্ধা মহিলাটি জবাব
দিলেন, 'হ্যাঁ তো! ওই শ্বেতীর জন্যিই তো অশান্তিতে ডুবে মরল!'
মিলি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।
হরির লুটের পর ফিরে গেছে সবাই। ধীমান এসব কিছুই জানল না। সে বন্ধুদের এগিয়ে দিতে গেছে। মিলি এসে বসলো তুলসীমঞ্চের সামনে। আলপনার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, 'মাসীমা, তুমি খুশি হয়েছ? আমার পাশে এসে বসবে না একটু? তোমারই তো বাড়ি। সব তোমার ইচ্ছামত বানিয়েছি। আসবে না?'
ধীমান গেট খুলে নতুন বাড়িতে ঢুকে দেখল, মিলি আর এক বয়স্ক মহিলা তুলসীমঞ্চের সামনে বসে খুব হেসে হেসে গল্প করছে। কপাল জুড়ে শ্বেতীর দাগ দেখে ধীমান চিনল, ইনিই তাহলে মিলির মায়া-মাসীমা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন