কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


দিরাং মনস্ট্রির সোনালি ঈগল

 

সাধারণত পাহাড় যাত্রায় প্রচুর পাখির দেখা পাওয়া যায়। চেনা অচেনা হাজাররকম। অচেনাই বেশি থাকে। এবং তারা ঝাঁক বেঁধেই থাকে। গাছে থাকে, আকাশে ওড়ে। খুব চেঁচামেচি করে সবাইকে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। এবারে আমাদের গন্তব্য অরুণাচল প্রদেশ। যাবো তাওয়াং, দিরাং, সেলা পাশ বুমলা পাশ ইত্যাদি জায়গায়। তাদের উচ্চতা  অনেক। অনেকাংশ বরফে ঢাকা থাকে। হয়তো সেই কারণেই এবারের তাওয়াং যাত্রায় পাখিদের আনাগোনা খুব একটা চোখে পড়েনি। হয়তো এখানকার প্রবল শীতই তাদের অনুপস্থিতির কারণ। এমনিতে এলাকায় গাছপালা কম নেই।

তবে আচমকাই একটা বড় সাইজের পাখি দেখতে পেয়েছিলাম দিরাং মনস্ট্রির ছাদে। চুপচাপ বসেছিল পাখিটা। আমার মনে হলো পাখিটা রোদ পোহাচ্ছে। বরফের দেশ হলেও এখানকার রোদ হয় খুব ঝকঝকে। সেই রোদ এসে পড়েছে তার গায়ে। সেই সোনালী রোদের জন্য মনে হচ্ছে পাখিটার গায়ের রংটাই সোনালি।

আমার মনে হলো, এটাই কি তবে সোনালি ঈগল? The great Himalayan Golden Eagle?

কিন্তু এখানে সে একা একা বসে আছে কেন? বাকি পাখিদের মতো ঈগল বাজ চিল এরা অবশ্যি দল বেঁধে থাকে না। এমনকি জুটি বেঁধেও থাকে না। আকাশের গায়ে অনেক উঁচুতে ওদের একা একাই উড়তে দেখেছি। এরা সকলেই বোধহয় একা স্বভাবের পাখি। আমার পক্ষী বিষয়ক জ্ঞান খুবই কম। মুরগি ছাড়া অন্য কোনো পাখি দেখে সেটা পুরুষ  পাখি না মহিলা পাখি তাও বুঝি না। ও হ্যাঁ। ময়ূর ময়ুরী চিনি সে তো কেবল ময়ূরের পেখম হয়, ময়ূরীর হয় না বলে।

হঠাৎ দেখি এক বৌদ্ধ মঙ্ক ঐ মনস্ট্রির ছাদে বেয়ে বেয়ে উঠেছেন। বোধহয় চেষ্টা করছেন পাখিটার কাছে যেতে। আমরা মনস্ট্রির নিচের চত্ত্বরে  দাঁড়িয়ছিলাম। এখানে দুপাশে সার দিয়ে অনেক অনেক জপযন্ত্র রয়েছে। তাদের গায়ে বৌদ্ধ  মন্ত্র লেখা "ওঁ মনি পদ্মে হুম"। তবে সেটার লিপি আলাদা। আদলে চেনা যায়।

আমার ১৫ মাসের নাতনি মনের আনন্দে তার বাবার কোলে চেপে সেই ধর্মচক্রগুলো ঘোরানোর চেষ্টা করছে। একজন বয়স্ক মন্ক এগিয়ে এসে নাতনিকে আদর করলেন। তারপর আমার ছেলেকে বললেন, It should be clock wise.

মানে ধর্মচক্রগুলোকে কোন দিকে ঘোরাতে হবে সেটা তিনি জানিয়ে দিলেন। সে বলার মধ্যে ভুল করার জন্য অনুযোগ নেই বরং এতোটাই বিনয় রয়েছে যে মনে হলো আমরা যে সঠিক পদ্ধতিটা জানি না সেটা আমাদের নয় বরং তাঁরই অপরাধ। বারকয়েক Sorryও বললেন।

তারপর আমার দৃষ্টি অনুসরন করে উনি বুঝলেন আমি মনস্ট্রির ছাদে বসা সোনালি ঈগলটাকে দেখছি। আমার মনে  হচ্ছিল ছাদের মন্কটি পাখিটার আরো কাছে গেলে পাখিটা উড়ে যাবে। নিচের বয়স্ক মন্ক আমাকে বললেন, Poor creature. The bird is wounded. He has gone to treat her.

তার কথা শুনে বুঝলাম ওটি মেয়ে পাখি। এবং সেটা উনি জানেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম মন্কটি পাখিটির কাছে পৌঁছে গেল। পাখিটা একটুও বিচলিত না হয়ে চুপচাপ বসে বসে মন্কএর চিকিৎসা গ্রহণ করলো। তাকে যথাযথ ট্রিটমেন্ট দিয়ে মন্কটি ছাদ থেকে নেমে আসতে লাগলো। আমরাও সিড়ি বেয়ে নামতে থাকলাম মনস্ট্রি থেকে। যখন আমাদের গাড়ি মনস্ট্রির পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছে, যতক্ষণ দেখা গেল, মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পাখিটা মনস্ট্রির ছাদেই বসে আছে। ট্রিটমেন্ট হয়ে গেছে। নিশ্চয় সেরে গেলে উড়ে চলে যাবে। আমার তো মন্কদের মতো উদার হৃদয় নেই। তাঁদের মতো এ জগতের সমস্ত প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা, মায়া মমতাও নেই। তবু পাখিটার জন্য মন কেমন করে উঠলো। মনে মনেই প্রার্থনা করলাম, পাখিটা যেন সেরে ওঠে। তারপর উড়ে উড়ে ফিরে যায় আকাশে।

নাস্তিকের প্রার্থনায় কি কাজ দেয়?

কে জানে!

আমাদের দলে বেশ কয়েকজন ধার্মিক মানুষজন ছিলেন। তাঁরা কেউই কিন্তু এই পাখির ঘটনার দিকে মন দেননি। তাঁরা মনস্ট্রির রঙিন সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। বুদ্ধ মুর্তিকে প্রণাম করেছেন। সঙ্গের ছোটোদের বলেছেন, ঐ দেখ ভগবান বুদ্ধ। নমো করো।

বুদ্ধ কি নমস্কার চান? যতদূর জানি তিনি তো নিজেকে ঈশ্বর বানানোর বিরুদ্ধে ছিলেন। ঐ জনগণেরা নির্বিচারে উল্টোপাল্টা ধর্মচক্র ঘুরিয়েছেন। আর বিস্তর ছবি তুলেছেন। নিজেদের, মনস্ট্রির এবং সন্মিলিত দল্ফি। সেল্ফির বহুবচন তো দল্ফিই হবে মনে হয়! ওরা কেউই পাখিকে দেখেনি। তবে আহত হিমালয়ান সোনালি ঈগলিনীর তাতে কিছুই যায় আসে না। নাস্তিকের অনুকম্পা বা ধার্মিকের উপেক্ষা কোনো কিছুই তাকে প্রভাবিত করবে না। আমার বিশ্বাস, বৌদ্ধ মন্কদের ভালোবাসা আর চিকিৎসাই তার সেরে ওঠার জন্য যথেষ্ট।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন