কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

স্বর্গ এসেছে নেমে

 


(১)   

কলেজগেটে চলছে কিছু একটা। ঘুরে দাঁড়ালো ঘরমুখো মনস্বিনী। সামনে এগোনো কি ঠিক হবে? ভাবল এক মুহূর্ত। এ তো নিত্য দিনের ঘটনা। নতুন কি আছে? কোনটা রাজনৈতিক কোনটা বা একান্তই ব্যক্তিগত। তবে কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন থেকেই দেখেছে মনস্বিনী, সবকিছুরই গন্তব্য ঐ রাজনীতির ঘোলাজল। নাকানি চোবানি তারপর উদ্ধারকর্তা হিসেবে কোন ক্ষমতাবান। উদ্ধার অবশ্যই, তবে শর্তসাপেক্ষ। এ ব্যাপারটাও এমনই কিছু হবে আর কি! দূরত্ব বেশী নয়। ওই তো দেখা যাচ্ছে। মাঝে দাঁড়িয়ে নবাগত রণজয় স্যর। বৃত্তের মত তাঁকে ঘিরে আছে রুদ্রাক্ষ সরকার আর ছাত্রসংসদের সদস্য তথা সরকারের কিছু চ্যালা। বন্ধুরা পেছন থেকে হাঁক পাড়ছে, ‘মনস্বিনী ঘরে যাচ্ছিস তো যা, নয় তো ফিরে আয়, গন্ডগোলে জড়াস না’।

নির্ভিক আর জেদী বলে অনেকের অভিযোগ আছে মনস্বিনীর বিরুদ্ধে। বন্ধুরা জানে সে কথা, তাই বৃথা চিৎকার না করে বুকে উত্তেজনা নিয়ে দেখতে থাকল শুধু, কি ঘটে এরপর। কাছাকাছি গিয়ে দেখল মনস্বিনী, রণজয় স্যর স্বভাবোচিত দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মারমুখো রুদ্রাক্ষ সরকার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গকে। একটা ভোঁতা তর্ক ফেঁদে বসল রুদ্রাক্ষ, ‘দশ নম্বর পরীক্ষা হলে আপনাকে ইনভিজিলেটরের ডিউটি দেওয়া হয়েছিল, ঠিক বলছি কিনা?’ ‘সেন্ট পারসেন্ট ঠিক বলেছ’, জবাবে বললেন রণজয় স্যর। ‘আপনাকে কে মাথার দিব্বি দিয়েছিল, হলে কে কি করছে না করছে তার খবরদারী করবার?’ এই রে! মাথামোটা না হলে এমন প্রশ্ন করে কেউ? হাসি চাপল মনস্বিনী। এই বুদ্ধি নিয়ে এরা সংসদের বড় বড় পোষ্ট হোল্ড করে! অবশ্য হতেই পারে, এটা নিছক ক্ষমতার প্রদর্শন। এটা যে পায়ে পা জড়িয়ে ঝগড়ার অজুহাত এটা বুঝতে একরত্তি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। রণজয় স্যরের যুক্তি, পরীক্ষা হলে ওটাই তো ছিল তাঁর কাজ। পাল্টা তর্ক, ‘না, ওটা ছিল আপনার পার্সিয়ালিটি, আপনি চাননি আমার বন্ধুরা সব পাশ করে যাক, উলটে আপনি আপনাদের নয়নের মণি ছাত্তরটি, তার স্বার্থটাই শুধু দেখলেন। একবারও মনে এল না, ওরা পাশ করলে কলেজেরও নাম হবে। বেশ রুষ্ঠ দেখালো রণজয় স্যরকে। জবাবে বললেন তিনি, ‘ভুল করছ, সব ছাত্রই আমাদের কাছে সমান। তবে যে ছাত্র সব কিছুতেই নিজেকে অনন্য করে তুলতে পারে সে তো শিক্ষকদের নজরে পড়তে বাধ্য। ফিফথ সেমস্টারের পরীক্ষা। ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। তোমার বন্ধুরা ছেলেটিকে শুরু থেকে উত্যক্ত করেছে, থ্রেট করেছে, পরীক্ষার পর বাইরে বেরোলে দেখে নেবে। আমি কিন্তু কেবলমাত্র ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি’। তেড়ে উঠলো রুদ্রাক্ষ, ‘কি করতে পারতেন আপনি, করে দেখতেন একবার!’ এরমধ্যে ক্লাসে যাওয়ার ঘন্টা বাজল। রণজয় আদেশের সুরে বললেন, ‘আর কথা নয়, এ ব্যাপারে তোমাদের যদি কিছু বলার থাকে, প্রিন্সিপ্যাল স্যর তো আছেনই, রিপোর্ট  কর তাঁর  কাছে’। রুদ্রাক্ষ ওসব যুক্তিবুদ্ধির ধারে কাছে নেই। তাছাড়া এটুকু বুদ্ধি ঘটে আছে যে এমন ভিত্তিহীন কোন ইস্যু ধোপে টিকবে না। পেশীর আস্ফালন দেখিয়ে কাজ হাসিল হয়ে গেলে কে যায় আর প্রিন্সিপ্যালের সাথে কচকচিতে! ওদিকে ছাত্ররা দুভাগ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সুবিধাবাদীদের দল, যারা সংখ্যাতেও বেশী, স্বভাবতই সেনাপতির হয়ে চেঁচিয়ে মরছে আর কিছুসংখ্যক অন্যদিকে রণজয় স্যরের সমর্থনে। মনস্বিনী চেনামুখ। অনেকবার দলে টানার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি সংসদ-সম্পাদকের পদে প্রার্থী হওয়ার টোপও দেওয়া হয়েছে। মনস্বিনীর এক গোঁ। রাজনীতির খেলায় সে নেই। সোজাসাপ্টা কথা বলতে কখনও ওকে ভয় পেতে দেখেনি ওর বন্ধুরা। তাই যখন ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে মনস্বিনী তখন পেছন থেকে এক হ্যাঁচকা টান। কোন এক বান্ধবী জোর করে টেনে নিয়ে চলল সিঁড়ি বেয়ে। মনস্বিনীর যুক্তি, একজন ভালমানুষ স্যরকে ওরা অপমান করে যাবে আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো? পালটা যুক্তি বান্ধবীর, স্যরকে বাঁচানোর অনেক ছেলে আছে, তোকে আর ওসবে জড়াতে হবে না, ওদের বিশ্বাস নেই, ওরা সব পারে’। ইঙ্গিতটা বুঝল মনস্বিনী। কিছু বলতে যাবে এসময় ঘটলো সেই বিপত্তি। ক্রমশঃ উচ্চগ্রামে চলে যাচ্ছিল তর্কের মাত্রা। সহসাই সেনাপতির দুই চ্যালা ঘুষি উঁচিয়ে তেড়ে গেল রণজয় স্যরের দিকে। ভিড়ের মধ্য থেকে সবেগে ছুটে এসে কে একজন দাঁড়ালো ঢালের মত রনজয় স্যরকে আড়াল করে। ‘মার, মার শালাকে। গাঁ থেকে মেধা নিয়ে এসেছে, প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে সবকটা স্যরকে তেল মেরে হাত করে নিয়েছে। এই যে মেধাবী ছাত্র, বেশী তেড়িবেড়ি করলে তোর ঐ গাঁ ঘরেই পার্সেল করে দেবো’।  ‘একদম বাজে কথা নয়, বৈশ্বানর বর্মনকে তোমাদের লেভেলে নামিয়ে আনার চেষ্টা করো না’। কথা শেষ হতেই উদ্যত মুষ্টির একটি সজোর আঘাত নেমে এল বৈশ্বানরকে লক্ষ্য করে। মাটিতে পড়ে গেল বৈশ্বানর। মাথাটা পড়েছে একটি আধলা ইটের উপর। মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে গলগল করে। থানাপুলিশ হয়ে যেতে পারে। দুর্বৃত্তের দল তড়িঘড়ি কেটে পড়লো বৈশ্বানরকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে। এগিয়ে এলেন রণজয় স্যর নিজে। সাথে দু’একজন ছাত্র। খবরটা পৌঁছে গেল প্রিন্সিপাল স্যরের কাছে। তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন প্রেস-পুলিশ পর্যন্ত যাতে না পৌঁছায় খবরটা। এদিকে পুলিশকেসের আশংকায় ছাত্রছাত্রী সব  ক্লাসের ভিতরে সেঁধিয়ে গেছে, যেন আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু দেখিনি এমন একটি ভাব। এতক্ষণে দোতলার করিডর থেকে তড়তড় করে নেমে এসেছে মনস্বিনী। কাছে গিয়ে দেখল, ছেলেটি আর কেউ নয়, তার বাবারই আশ্রিত বৈশ্বানর যে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে এই ঘটনার কেন্দ্রে। ছেলেটা তো ওর চেনা। কথাবার্তা যদিও হয়নি কখনো। ওদের আউট হাউজে যে দু’তিনজন ছেলে আশ্রিত হিসাবে থাকে ও তো তাদেরই একজন। বিপিএল কার্ডধারী পরিবারের সদস্য এরা । পয়সা নেই কিন্তু মেধা আছে। মনস্বিনীর বাবা বেশী দূর এগোতে পারেননি পড়াশুনো নিয়ে, তবে উর্বর মস্তিষ্কের  জোরে আজ তিনি জেলা শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও পৌঁছাতে পারেননি নিজের লালিত লক্ষ্যে, তাই প্রতিবছর খুঁজে নিয়ে আসেন একটি করে ছেলে যে দরিদ্র ঘরের সন্তান অথচ  মেধাসম্পন্ন। তার থাকা খাওয়া পরা ও পঠনপাঠনের সমস্ত খরচ বহন করেন তিনি। তিনি মনে করেন এটাই তাঁর পুণ্যার্জনের একমাত্র উপায়। এদের জন্য একটা অলিখিত নিয়ম আছে। এরা সমস্তরকম সুবিধা ভোগ করবে কিন্তু বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে এদের কোনরকম যোগাযোগ থাকবে না। প্রয়োজনে এরা বাড়ির কাজের লোকের মারফৎ খবর পাঠাতে পারবে অনঙ্গবাবুকে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই পড়াশুনোয় ইতি, ফিরে যাও ঘরে। এই বিশেষ কারণেই এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও তেমন পরিচয় গড়ে ওঠেনি বৈশ্বানর আর মনস্বিনীর  মধ্যে।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন