কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


স্বপ্ন যখন উটের পিঠে

রাজস্থানের রিজার্ভ ফরেস্ট সারিস্কার ভেতর দিয়ে আমাদের পথ। যেখানে বনবিভাগ নোটিশবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে। "বাঘ বিচরণ ক্ষেত্র"। তার মধ্যেই খানিক দূরে দূরে মানুষ বসবাসের গ্রাম। যদিও "মানব বিচরণ ক্ষেত্র" বলে কোন নোটিশবোর্ড লাগানো নেই। তবু বুঝতে অসুবিধে নেই। এখানে বাঘে মানুষে এক ঘাটে নয় এক ঘাটিতে বসবাস করছে। সেই সহাবস্থান কতোটা শান্তিপূর্ণ সেটা জানি না। তবে পথে দেদার বেআইনি বাম্পার। সেগুলোর ওপর দিয়ে লম্ফ দিয়ে দিয়ে গাড়িদের চলতে হয়। পথের দুপাশে সার দিয়ে পাহাড়। আরাবল্লির রেঞ্জ। তবে এখানে পাহাড়গুলো বেঁটে বেঁটে এবং ধূলোয় ধুসর ডালপালা সর্বস্ব গাছপালায় ঢাকা। এ যদি বাঘের বাসা হয়, তবে সেটা মোটেই আমার পছন্দের নয়। তবে আমার পছন্দে কি এসে যায়? বাঘের পছন্দ হলেই হলো। বেঁটে পাহাড়গুলোর অধিকাংশের মাথায় মন্দির। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে সেই মন্দিরগুলোকে দেখতে মন্দির বলে মনেই হবে না। তাই তাদের মন্দির বোঝাতে রঙিন কাপড়ের ঝান্ডা লাগানো আছে। আর আছে পথের ধারে সাদামাটা তোরণ। তাতে মন্দিরের পরিচয় লেখা। মানে পাহাড়ের মাথায় কোন্  দেবী দেবতার মন্দির সেটা লেখা। সেই দেবী দেবতাদের একজনও আমাদের পরিচিত নয়। ওদের ঈশ্বর আমাদের থেকে আলাদা। যাবার পথে এই সব দেখতে দেখতে গেলাম।

দুদিন পরে ফেরা। ফেরার পথে খানিক দূর যাওয়ার পরেই আমাদের গাড়ি থেমে গেল। শুধু আমাদের নয় দেখলাম পরের পর আরো কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শাদিকা জুলুস যা রহা হ্যায়।

এবার এতক্ষণ ধরে যে ঢোল আর বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল তার কারণটিও জানা গেল।

- উ পাহাড় কে উপর তো দেবী মন্দির হ্যায়। বঁহাই শাদি হোগা। বস পাঁচ মিনট। উস্কে বাদ রাস্তা খুল যায়গা।

পাঁচ মিনট ক্রমে ক্রমে আধাঘন্টা হয়ে গেল। রাস্তা আর খোলে না। আমাদের পেছনে আরো গাড়ি এসে এসে জমা হতে লাগলো।

একসময় পথ খুললো। আস্তে আস্তে আমাদের গাড়িগুলো ছাড়তে শুরু করলো। যেতে যেতে দেখলাম,  সাজগোজ করা মাথায় রঙিন পাগড়ি পরা বর-বাবাজীবন পায়ে হেঁটে পাহাড়ে চড়ছে। পাগড়ির বিশালত্ব ছাড়া  নজরে পড়লো তার কোমরে খাপ সমেত এক তলোয়ার। বরের বয়স বছর পাঁচ ছয়ের বেশি হবে না। তার কোমরে ঝোলানো তলোয়ার মাটি ছুঁয়ে আছে।

বর তো দেখলাম। বউ কোথায়? একটু পরেই তাকেও দেখলাম। মেয়ের বাড়ির শোভাযাত্রা বরের বাড়ির শোভাযাত্রা থেকে খানিকটা পিছিয়ে আছে। কনের মাথায় পাগড়ি, মুকুট কিছুই নেই। রঙিন কাপড়ের ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা। তার পরনে মলে লহঙ্গা যা তার দেহের তুলনায় অনেকটাই বড়ো। তা দিয়েই তাকে কনে বলে চিনতে পারলাম। ঐ পোশাক পরে হাঁটা অসম্ভব। পাহাড় বেয়ে ওঠা তো আরো অসম্ভব। তাই বিয়ের কনে এক সুসজ্জিতা মহিলার কোলে চেপে আছে। এবং একঝলক দেখে মালুম হলো কনে কাঁদছে। তবে সেটা আমাদের বিয়ের কনের কান্নার মতো নয়। এটা একটা শিশুকে তার প্রাত্যহিক পরিচিত খেলাধুলা থেকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করার কান্না। মোটকথা এখানে ধুমধাম করে একটি বাল্যবিবাহ সংঘটিত হচ্ছে। দেশে না বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করে আইন আছে? সে তো বরপন বা কনেপন নিষিদ্ধ করেও আইন আছে! মানছে কে?

তাছাড়া খুব সন্দেহ এটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা ভারতবর্ষ। এখানকার আইন কানুন তো আলাদা হবেই।

এখনো অনেক পথ যেতে হবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। তারপর ঝাঁ চকচকে বম্বে দিল্লি এক্সপ্রেস ওয়ে পাওয়া যাবে। সেখানে একটাও বাম্পার নেই। তবে টোল আদায় করার সেন্টার আছে। আগে আগে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে টোলট্যাক্স জমা করতে হতো। এখন ফাস্টট্যাগ-এর যুগ। অটোমেটিক ভাবে টোল কেটে নেওয়া  হয়। গাড়ি থামাতে হয় না। এই স্মুথ ড্রাইভিং-এ ড্রাইভার ছাড়া অন্য যাত্রীদের চোখে ঘুম এনে দেয়। পেছনের  সিটে বসে আমার ঘুম এসে গেল। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথার সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে। যা দেখলাম তা আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে না। কারণ সেই কাল্পনিক দৃশ্য তো আমি নিজেই বিশ্বাস করছি না। তবু যা দেখলাম বলি। দেখলাম আমার পরনেও ওদের মতো পোশাক। মাথায় রঙিন পাগড়ি, পরনের ধুতির রং হলুদ। ফুলহাতা জামায় জরির ফুল। এবং পায়ে খড়খড়ে এক জোড়া নাগরা জুতো।

কনেযাত্রী না বরযাত্রী? আমি ঠিক কোন দলের বুঝতে পারলাম না। একজন ওদেশি ভাষায় আমাকে অভিবাদন করে বললো, "পরনাম মহিন্দর জী"। তবে কি এখন আমার নাম মহেন্দ্র সিং টিকায়েত? মহেন্দ্র  সিং ধোনি হবার তো সম্ভাবনা নেই। আমি পাক্কা জানি ধোনি রাজস্থানের লোক নয়। টিকেইত কি রাজস্থানের লোক? যদ্দুর মনে পড়ছে রাজস্থানের তো মিনাহ বলে একটা টাইটেল হয়। এখন না হয় সেটাই হলাম। মহিন্দর সিং মিনা। মন্দ নয়।

বরের নাম বীরভদ্দর। সেটা জানতে পারলাম কারণ মাঝপথে সে হঠাৎ বললো-

- পিসাব করেগা।

সঙ্গে সঙ্গে তার রঙ্গিন ধুতি খুলে দেওয়া হলো। কোমর থেকে তরোয়াল খুলে ফেলা হলো। অর্ধনগ্ন বাবাজীবনকে পথের পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো। পাহাড়ের গায়ে উবু হয়ে বসে জলত্যাগ করা শুরু করলেন তিনি।

- ক্যা রে বিরভদ্দর। হুয়া?

এভাবে বরের নামটা জানা হলো।

খানিক পরে আবার থামতে হলো। এবার কনের জন্য। তারও এরকম কোনো এক কারণে থামা প্রয়োজন।

মহিলাদের ঘোরটোপের মধ্যে, বাকিদের নজরের আড়ালে, তার কাজটিও সম্পন্ন হলো।

বেশ খানিকটা ওঠার পর একটি উটের দেখা পাওয়া গেল। সেটি আগেই উঠে এসেছে? সে নাকি এখানেই থাকে? দেবী মাতার উট। উটের সাজগোজ চমৎকার। জরির সাজে দারুন ঝলমলে। ধুসর দেশ রাজস্থান সত্যিই খুব রঙিন। চারদিকে ঝলমলে রং-এর মেলা। বিশেষ করে পোশাকে।

এখন উট আমাদের সাথে যাবে। কিন্তু তাতে কেউই চাপবে না। একজন পাগড়িধারী তাকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। শোভাযাত্রার শান বাড়ানোর জন্য এটাই নিয়ম। আরো নিয়ম হচ্ছে বিয়ের পর বর বৌ একসাথে উটের পিঠে চেপে ফিরবে। সেটাও পুরো পথ নয়। নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত। যাতে উটের পিঠে চেপে বিবাহিত বর কনে ভয় না পায়। তাই তাদের ভরসা যোগাতে কোনো একজন পুরুষ মানুষ তাদের সাথে উঁটে চেপে ফিরবে।

আমাদের শোভাযাত্রা মন্দিরে পৌঁছাল। দেবীমাতা কোনো মূর্তি নন। কিম্বা মূর্তিই তবে বিমূর্ত তার নির্মাণ। পাথরের ওপরে পাথর চাপিয়ে। তবে সে সব পাথর নির্বাচনে শিল্পীকে মগজ খাটাতে হয়েছে। একটি গোল পাথর হয়েছে মুখ, দুটি গোল গোল পাথর স্তন। সেরকমই শরীর আর পা বোঝাতে উপযুক্ত আকারের পাথর একের উপর এক, একের পাশে এক সাজানো। কেবল হাত দুটি ফাঁকা। দেবীর হাত নেই। ঠুঁটো জগন্নাথের মহিলা সংস্করণ। হয়তো এখানে হাতের আকারের পাথর পাওয়া যায় না। তাই। গোটা পাথরের মুর্তিটি মেটে সিঁদুর মাখানো। সেটা বেশ চকচক করছে। তার মানে এটা তেল সিঁদুর। সেই দেবী মুর্তির সামনে ছেলের মায়ের কোলে ছেলে আর মেয়ের মায়ের কোলে মেয়েকে বসিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলো। তুমুল হইচই আর বাজনা বাজছে। মন্ত্রটন্ত্র শোনার উপায় নেই। হঠাৎ দেখলাম বর বাবাজী হাত বাড়িয়ে টুক করে দেবীর সামনে রাখা ফলের সম্ভার থেকে একছড়া কলা তুলে নিজের পোষাকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললো। মনে হয় শিশুটি উপবাসী। তাই তার খিদে পেয়েছে। খিদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ মানুষের মৌলিক অধিকার। সে জন্য চুরি ডাকাতিও করা চলে।

উপবাসী নিশ্চয় মেয়েটিও। তার কি অবস্থা? ও হরি! এতো এতো শোরগোলের মধ্যেও বিয়ের কনে মায়ের  কোলে বসে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। তার নাক থেকে চেন লাগানো নাকচাবি বা নথনীটা খসে পড়েছে তার কোলে। দুই মা’ই দীর্ঘ ঘোমটার আড়ালে। তাদের পক্ষে এই সব দেখার উপায় নেই।

তাই কলা চুরি বা নথনীর খসে পড়া তারা দেখতে পেলেন না। অথবা দেখলেও নজর আন্দাজ করলেন।

এমন সময় হঠাৎ বাঘের গর্জন শোনা গেল। একবার দুবার এবং তিনবার। জঙ্গল পাহাড় কেঁপে উঠলো। মুহূর্তের জন্য এখানে সবাই চুপ করে গেল। ঢোল বাঁশিও চুপ করে গেল। তারপর তিন ডাক থামতেই দ্বিগুণ  উৎসাহে সব বেজে উঠলো। এই বিবাহে বাঘের আশীর্বাদ পাওয়া গেছে। যা খুবই মঙ্গলের বিষয়। বুঝলাম  দেশের আইন নয়, বাঘের দেশে বাঘের অনুমোদনটাই গুরুত্বপূর্ণ।

বিয়ে সম্পন্ন হলো। এবার ফেরার পালা। উটের পিঠে চাপতে হবে। ওমা দেখি ঠেলে ঠুলে মহিনদ্দর জী অর্থাৎ আমাকেই উটের পিঠে তুলে দেওয়া হলো। আমি তার মানে বরপক্ষ। তারপর একে একে বর ও বউকে তোলা হলো। বর টুক করে একফাঁকে আমার হাতে কলার ছড়াটা গুঁজে দিয়ে দিব্যি উঠে পড়লো। দেখা গেল আমার চেয়ে অনেক কম সাহায্য লাগলো তার। রাজস্থানের বীর বালক বলে কথা! কনের চোখে তখনও ঘুম। গালে  চোখের জলের শুকনো দাগা। দু হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিতে হলো। তবে অতি সাবধানে। যাতে আমি নিজে না খসে পড়ি আর বরের দেওয়া কলার ছড়াটা আমার দেহের চাপে থেঁতলে না যায়।

উটওলা দড়িতে ঝাকানি দিতেই উঁট নড়ে উঠলো। উটকে মরুভূমির জাহাজ বলা হয়। এখানে দেখলাম সে পাহাড়ের জীপ গাড়িও বটে। এবড়োখেবড়ো পথে জীপের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে তার চলা। আমার জটায়ুর উটযাত্রার কথা মনে পড়তে লাগলো। কিন্তু আমি তো এখন মহিন্দর সিং। আমার তো জটায়ু হওয়া চলবে না। আমি উটের পিঠে যথাসম্ভব গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। সেইসঙ্গে আমাকে বর, বরের কলার ছড়া আর কচি ঘুম কাতুরে কনেকে সামলাতে হচ্ছিল। আমরা ঠিক সেই যায়গায় পৌঁছে গিয়ে থামলাম। যেখানে আমাদের উটের পিঠে থেকে নামতে হবে। নিয়ম মতো উট আর এর আগে যাবে না। ওমা হঠাৎ আবার বাঘের গর্জন। এবার গর্জনটা এলো অনেক কাছ থেকে। বাঘ যেন মাত্র হাত দশেক দূরে। এর ফলে ভীষণ রকম ঘাবড়ে গিয়ে উট হুড়মুড় করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে লাগল। দেখি উটের পিঠের কুঁজ আঁকড়ে আছি আমি। কনে এখন বরের কোলে। ওটাই তো তার উপযুক্ত থাকার জায়গা। যথাস্থানেই আছে। উট ছুটতে থাকলো। পাহাড় থেকে নেমে। দেবীর তোরণ পেরিয়ে একেবারে রাস্তায়। এবং এক ঝটকায়  আমাকে রাস্তার ওপর ফেলে ছুটে চলে গেল গ্রামের ভেতরে।

এই পতনে আমার ঘুমের ঘোর কেটে গেল। দেখলাম আমি আমাদের গাড়ির ব্যাক সিটে। মানে এটা একটা দিবাস্বপ্ন। তবে স্বপ্নটা মন্দ নয়। আমি হাত তুলে পাহাড়ের মাথার দেবী মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে গিয়ে চমকে গেলাম, একি! আমার হাতে একছড়া কলা এলো কোত্থেকে?

দেখলাম গাড়িতে উপস্থিত সবাই তখন কলা খাচ্ছে। আমিও ছুলে মুখে দিলাম। খুব মিষ্টি না হলেও রাজস্থানী কলা কিন্তু খেতে মন্দ নয়!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন