পরিযায়ী
সে বলল, শুনিয়া বুঝিতে পারিতেছ না, পাখিটির
মধ্যে একটি গল্প রহিয়াছে?
তার শরীরের চারপাশে ডিমের সাদা অংশের মতো একটা
মেঘ। দরজার মাথার ওপর বহু পুরাতন হরিণের মাথা, হালকা তেরছে পড়েছে। হরিণের চোখদুটো
তার দিকে। আলো তার শরীরে উল্কির মতো এক জাফরি বানিয়েছে। তার দিগন্ত জুড়ে সাদাকালো
আলোর রোশনাই। আমার মনে হলো তার থাইয়ের নিচের
উঙ্কি থেকে বহু পুরাতন বনভূমির ম্যাপের
গন্ধ উঠে আসছে।
- তুমি পূর্বে পাখিটির
ডাক শোন নাই। আজ সন্ধ্যায় প্রথম শুনিতেছ। তোমার কিছু মনে হইতেছে না?
আমি পাখিটাকে দেখিনি। এমন অদ্ভুত সুন্দর ডাক
পাখির হতেও পারে। তবে পাখি কেমন দেখতে হবে জানি না। জারুল গাছের পাতার নিচে
অন্ধকার। পাখি সেই অন্ধকারে এসে বাসা বেঁধেছে আজ রাতের জন্য। আবার কালও থাকতে
পারে। থাকতে পারে আরও কিছুদিন।
পাখি বলতে আমি বুঝি উপসাগরীয় যুদ্ধের শেষে তেলের
সমুদ্রে ভাসমান কালো কালো কিছু জীব - যারা উড়তে পারে না, ভাসতে
পারে না, হাঁটতে পারে না। আস্ত একটা যুদ্ধ ঘাড়ের ওপর এসে পড়লে কী করতে হবে বুঝতে
পারে না। তাদের কল্পনাশক্তি নেই। সমুদ্রের নোনা জল আর ঝাউয়ের সারি বোঝে। বোঝে বুকভরা গরম
বাতাস নিয়ে নিরক্ষীয় ভাসতে ভাসতে, উপবৃত্তাকারে উড়তে উড়তে মৃত্যু। আমি বললাম, ঐসব
পাখির গল্প আছে।
সে বলল, সমস্ত পদার্থ অপদার্থ ঘটনা ঘটনাহীনতাই
গল্প। যুদ্ধের যেমত গল্প রহিয়াছে, শান্তিরও যুদ্ধ রহিয়াছে। শান্তি তুমি
কাহাকে বলিবে, যুদ্ধ ব্যাতিত তাহা কি?
অন্ধকার ঘরের ভেতর তখনও তার শরীর জুড়ে মেঘিন
নগ্নতা। কোথাও পেঁজা তুলোর মতো সাদা, কোথাও নিবিড়তার মতো ঘোর কালো। তার কণ্ঠস্বর
এমন এক দূরবর্তী একাকীত্ব থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যেন সে আমার সাথে কথা বলছে না।
স্বগোতক্তি করছে নিজের বুকের গাভীন মেঘগুলোর সাথে। হরিণের রৌদ্রতক্ষ্ণ
চোখদুটো স্থির তাকিয়ে থাকে তার কণ্ঠার স্বেদবিন্দুর দিকে।
তার কথায় সত্যিই আমার কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে। একটা
টর্চ নিয়ে সোজা ছাদে চলে এলাম। পাখিটাকে একবার দেখতে হবে। পাখিটাকে একবার দেখতে
হবে। বাতাসে যুদ্ধের গন্ধ আছে কিনা জানতে হবে। কার্নিশ ধরে অনেক উঁকি মেরেও গাছের
বড় পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। পাতার নিচে যুদ্ধ নেই অন্ধকার আছে। অন্ধকারে
নৈঃশব্দ আছে। হতাশ হয়ে ধরে ফিরে এলাম।
তার নগ্ন শরীরের রেখায় তখন কুয়াশার গন্ধ।
হিমরেখা থেকে সে মৃদু উচ্চারণ করল, অন্ধকার আকাশ আর দ্বিতীয়ার চাঁদ। অন্যকিছু দেখিতে
পাইলে?
- না, না। পাখি চাঁদটাঁদ
কিছুই নেই। কারো টিভিতে হয়তো কিছু শব্দ হয়েছে।
এমন সময় পাখি আবার
ডেকে উঠল। মেঘিন, বেদনার্ত স্বর। আমি লাফিয়ে উঠলাম। সে বলল, শান্ত হও, নিস্তব্ধ
হও। পাখি এখন জ্যোৎস্না পান করিতেছে।
এমন বোকাবোকা চুপচাপ অন্ধকারে বসে থাকতে মোটেও
ভালো লাগছিল না। তাই আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে মুখ তুলে বলল, এখন আমার চুমু
খেতে ভালো লাগিতেছে না। তবে তুমি খুশী হইলে খাইতে পারো।
- তুমি আমাকে জড়িয়ে
কোনও সম্পর্কের কথা ভাবতে পারো না, না?
- সম্পর্ক? কী প্রকার?
আমরা সম্পর্কিত ইহা আমি জানি। আমরা বন্ধু।
- তা নয়, একজন পুরুষ
আর নারীর মধ্যে স্বাভাবিক যে সম্পর্ক।
- এক্ষণে আমরা পুরুষ ও
নারী।
- ক্ষণ তো
বড় ক্ষণস্থায়ী! এখনি শুরু হয়ে এখনি শেষ হয়ে যায়। আমি চাই অনন্ত সময় তোমার
প্রত্নশরীর থাকুক আমার বুক জুড়ে।
সে তাকাল, বলল, আমার কোনো ঘর নাই। কেহই আমার
প্রেমিক নহে। আমি কাহাকেও স্বামী বলিয়া স্বীকার করি না। তুমি জোর
করিতে পারো, ভোগ করিতে পারো, ছিঁড়িতে পারো, ভাঙিয়া ফেলিতে পারো, কিন্তু দখল করিতে
পারিবে না। আমি স্বাধীন।
এই বলে সে পাদু’টো ভাঁজ করল। হাতদু’টো বিস্তার
করল। বন্ধ জানালার জাফরিবাহিত ঘুলঘুলির রোদাভাসে নিজেকে উড়িয়ে দিল।
জারুলগাছের পাখিটা
আনন্দে কিচকিচ করে ডেকে উঠল। সেও কি উড়ল? আমার ঘর
থেকে জারুলগাছটা দেখা যায় না।
বেশ লাগল
উত্তরমুছুন