কথা লেখা
কথা বলার যে ভাষা আর লেখার যে ভাষা, তারা যদি এক
হয়, তাহলে কেমন হয়? কথাকে লিখতে গেলে একটু থমকে যেতে হবে। আর লেখাকে বলতে গেলে
আটকে যেতে হবে বারবার। এভাবেই আমাদের ভাষা বিভিন্ন রূপে ধরা দেয়। কবিতার ভাষা,
গদ্যের ভাষা, প্রবন্ধের ভাষা, একটু হলেও আলাদা একে অপরের থেকে। একই ভাষা অঞ্চল
ভিত্তিতে আবার ভিন্নরূপে বলা হয়ে থাকে। বাঁকুড়া,
মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ - এরকম
আরও জেলা আছে যেখানে স্বাভাবিক কথ্য বাংলার অন্য রূপ আছে। আবার একই জেলার মধ্যেও
কত রকমের টান! হুগলী জেলার নদী তীরবর্তী এলাকার থেকে তারকেশ্বর অঞ্চলের ভাষা একদমই
অন্য টানের। এ যেন এক মজার খেলা।
যেন এক আমির মধ্যে অনেক আমি লুকোনো। উত্তর
কলকাতার
নেবু, নংকা, নুচির গল্পের পাশে দক্ষিণ কলকাতার ‘ইসে’ অনায়াসে জায়গা করে নেয়। যদিও
আজকাল ‘আধুনিক’ মানুষজন একধরনের
হিন্দি, ইংরেজি মিশ্রিত বাংলায় কথা বলতে পছন্দ করেন। মুখ বেশি ফাঁক না
করে খেতে এবং হাসতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এবং এনারা সর্বদাই ‘র’কে ‘ড়’ উচ্চারণ করেন।
‘স’ কে ‘শ’।
পশ্চিমবাংলার বাইরেও তো বাঙালি থাকেন। বাংলাদেশের
মানুষও এই জেলা ভিত্তিক ভাষার কবল থেকে মুক্ত নন। তবে এনারা যে বাঙাল ভাষায় কথা
বলে থাকেন, সেই ভাষায় লিখতে কম দেখা যায়। এমনকি কোনো অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও এনারা প্রমিত
ভাষাই ব্যবহার করেন। এবার বাকি রইল অসম, ত্রিপুরার বাঙালি। আসলে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার
সব জায়গাতেই হয়ে থাকে। দেশ বিদেশ নির্বিশেষে। তাহলে এরাই বা বাদ যাবেন কেন! আমার আঞ্চলিকতা
নিয়ে কোনো অস্পৃশ্যতা নেই।
বরং বেশ মিষ্টি লাগে অন্যরকম ভাবে ভাষার ব্যবহার
শুনতে। কিন্তু সমস্যাটা আমার অন্য। আমি চাইছি, আমার কথাকে লিখতে। এই কথা লিখতে
গিয়ে আমি লেখা হারাচ্ছি না তো? লেখা বলতে কী শুধু কবিতা! গল্প লেখা হারাচ্ছি, মজার
ঘটনা লিখতে পারছি না, দুঃখের কথা লিখতে বিরক্তি আসছে। লেখায় অতিরিক্ত আবেগ এলে
নাকি সেই লেখা দাঁড়ায় না! কিন্তু ঠিক কতখানি আবেগ দিয়ে লিখলে লেখা হারাবে না, সেটা
আগে জানা দরকার। আর সেই জানা বোধহয় লিখতে লিখতেই হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক
কতখানি আবেগ এলে বা আবেগ বর্জন করলে আমি আমার কথা লিখতে পারব, সেটাই আমার জানার
বিষয়।
এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে কথা লেখার থেকে শক্ত
কাজ আর নেই। আসলে কবিতা লেখা বা গল্প উপন্যাস লেখা, নাটক লেখা, অথবা প্রবন্ধ কোনো কাজটাই সহজ নয় মোটে।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ঠিক এখুনি একটা কথা লেখা খুব জরুরী। একটা কথা না লেখা হলে
বুঝি প্রলয় ঘটবে কোথাও। লেখার ভাষায় কথা লিখলে হবে না, তাহলে এই খেলায় তুমি আউট!
কথা লিখতে গেলে কি খুব ভাবতে হয়? কিন্তু আমরা যে অনর্গল এত কথা বলছি খুব একটা না
ভেবেই, সেইরকম কিছু হালকাফুলকা কথা
লেখা যায় না? যায় নিশ্চয়ই, আমি
পারছি না, এটাই মোদ্দা কথা। আমার কথারা না-লেখার দিকে চলে যাচ্ছে। তা
বেশ, যাক, যাক। আচ্ছা, এই যে আমার কথারা না-লেখার দিকে চলে যাচ্ছে
দেখেও, আমি বললাম- বেশ বেশ! এটা
অদ্ভুত না? আমার তো চিৎকার করা উচিত ছিল এই সময়ে। আমার তো রাগে হতাশায় কান্নাকাটি
করা খুব জরুরী ছিল। এসব না করে আমি কী করে বলতে পারলাম- বেশ বেশ! খুব অদ্ভুত লাগে
অনেক সময়ে এই অস্বাভাবিক
আচরণ। যেটা করার কথা, যেটা করা সেই মুহূর্তে আবশ্যক, তা না করে একদম বিপরীত ঠিক
না, কেমন বেলাইন হয়ে যাই।
তাহলে বরং স্বাভাবিক হওয়া যাক। চিৎকার করে যেতে
বারণ করি আমাদের কথাদের না-লেখার দিকে। আর বারণ না শুনলে গায়ের জোরে, লড়াই করে
ফিরিয়ে আনি ওদের। তারপর একটু ভুলিয়ে দিলেই হবে। আর একবার কেন, বারবার চেষ্টা করা যাক
কথাকে লেখার। ডান হাতের অদৃশ্য টেনিস র্যাকেটটা দু’ পায়ের কাফ মাসলে বেশ কয়েকবার ঠুকে দিলাম। আহ্,
কোথায় যে কি কি রস ক্ষরণ হলো, হতেই
থাকল, আর আমার মনের ভেতরের কথাগুলো বুড়বুড়ি কেটে লেখা হতে লাগল। লিখে ফেলছি পাতার
পর পাতা। তৎসম ব্যবহার বাদ, ভারী শব্দ বাদ, একদম ক্যাসুয়াল, ঠিক আমারই কথা বলার
টোনে লিখে ফেলছি কথাদের। তাতে যদি হিন্দি ইংরেজির মিশেল থাকে, থাকুক। কে নাক সিটকা্লো, তাতে আমার কী! আমি তো আর
বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যকরণ সম্মত চর্চা নিয়ে আলোচনা করছি না! লিখে যাই, লিখে যাই...
আচ্ছা এবার না হয় একটু থেমে দেখি,
কী লিখলাম! ও হরি! এ দেখি দশ বারো লাইনের কয়েকটা কবিতার মতো করে লেখা কিছু, তিন পাতার পাতে না
দেওয়া গাঁজাখুরি গপ্প আর এই রকম রাবিশ এলেবেলে না-কথা। তাহলে? তাহলে কি আমার কথারা
ফুরিয়ে গেছে? নাকি কোথাও চলে গেছে?
বুঝতে পারছি, কথাদের খোঁজা খুব দরকার। ওরা কোথা
কোথায় যেতে পারে সে সম্বন্ধে একটা ধারণা যদি থাকত, খুব সহজ হতো তাহলে খেলাটা। আমায় এখন হাতড়াতে
হবে আকাশ-পাতাল। আকাশে কথা থাকে! পাতালে? ধুর ধুর। নিশ্চয়ই থাকে
কোথাও না কোথাও। এই খেলাটা অনেকটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো। খড় ঘাঁটতে ঘাঁটতে যদি বাই চান্স ছুঁচটা হাতে ঠেকে
যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু ছুঁচ বিঁধে গেলে আঙুলে, রক্তারক্তি ঘটতে পারে, সময়
মতো ইনজেকশন না নিলে
টিটেনাসে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, খোঁজাই সার হলো, ছুঁচ পাওয়া গেল না। এই খোঁজাখুঁজি চালাবে কিনা
সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমাকে খুঁজতেই হবে। যদি খুঁজে না পাই, ওই
খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আসব, এটাও ঠিক। আসলে ওই হরমোন,
ওইটুকু রসই বদলে দিতে পারে ইচ্ছে অনিচ্ছেকে। ওই রসের নাম দিলাম জীবন-রহস্য। ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে তা অমৃত, আর বেহিসেবী
ব্যবহার করলে বিষ। এই ঠিক মতোর মাপটা আমি জানি না
অবশ্য। তাই কখনও অমৃত পান করে অমর হই, কখনও বিষ গিলে মরা। তবুও ওই খোঁজ আমার ছাড়লে
চলবে না।
প্রথমে আকাশের দিকেই চোখ যায়। এই আকাশ আমার থেকে
অনেক দূরে। তাই বলে এমন দূরেও না যে আমি তাকে দেখতে পাই না। কত তার রঙ বদল, কত তার
মেঘবৃষ্টির খেলা, সবই তো দেখি। এখানে আমার অনেক কথা লুকোনো আছে। অনেক ব্যথাও।
কথার সাথে ব্যথার খুব ভাব। আবার ঝগড়াও হয় ঘন ঘন। তবুও ওরা পাশাপাশি থাকে। আকাশ
ছোঁয়া যায় না বলে কি আমি ওখান থেকে লুকোনো কথাদের পেড়ে আনতে পারব না? নিশ্চয়ই পারব। আমারও এক লম্বা আঁকশি আছে। আকাশ যত
দূরেই থাক, আমার আঁকশি ঠিক ধরে ফেলবে আকাশকে। আমার ঝুলিতে ভরে নেব ওখান থেকে কিছু
কথা আর কিছু ব্যথা। সব নেব না, আবার পরের বারের জন্য রেখে যাব। জানি, আমার বাকি কথাদের আকাশ যত্ন করে তুলে রেখে
দেবে।
চোখ নামালেই দেখি দিগন্ত রেখা জুড়ে মিশে আছে সবুজ
গাছের সারি। এই গাছকে আমি কী করে অস্বীকার করতে পারি! গাছের গা বেয়ে বেয়ে আমার
কথারা উঠে যায় পাতা থেকে পাতায়, একদম মগডালে ওদের ঝুলতে দেখি, খিলখিল করে হাসতে
দেখি এক দুরন্ত ছেলের মতো। ওরে নেমে আয়, পড়ে
যাবি, পড়ে যাবি... শুনে আরও হাসে, আরও উঁচুতে যেন যেতে চায়। এসব দুরন্ত
কথাদের আমি গাছ বলে ডাকি। পাখি
বলে ডাকি। থাক ওরা ওদের মতো
খলবলিয়ে। ওরা যেন অমন দুষ্টুটিই থাকে। ওদের বয়স যেন না বাড়ে, যেন ঝাঁপ দিতে পারে
মগডাল থেকে অবলীলায়।
কিছু কথাদের ডানা থাকে। মাঝেমাঝে একটু জিরিয়ে
নিতে এলে, ওদের কাছে থাকি। ওদের ডানার ঘাম মুছে দিই, ধুলোবালি ঝেড়েঝুড়ে দিতে থাকি
পালকের। এই কথাদেরও বয়স বাড়তে দিই না। এমনই অস্থিরমতি থাক এদের ওড়াউড়ি। যখন ইচ্ছে
হবে এসে বসবে আমার কাছে, আবার ইচ্ছে হলে উড়ে চলে যাবে। তবে জিরিয়ে
নিতে বলি মাঝেমাঝেই। ডানা ভরে গেলে আর উড়তে পারবে না কথা-পাখি। কথাদের উড়ে যেতে
দিতে হয়, কথারা না উড়লে বসবে কেন পাশে!
আর কিছু কথা থাকে
মাটিতে মিশে। মাটির ভেতর থেকে যখন ঘাস জন্মায়, চারা জন্মায়, কথারাও জন্মে। ওদের
সাথে সাথেই বড় হতে থাকে। কিছু ঘাস-কথা লতিয়ে লতিয়ে থাকে মাটির বুকে, কিছু গাছ-কথা
বাড়ে, সেই দুষ্টুমি পেরিয়ে মহীরুহ হয়। কথাদের ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বুকে। এমন
ভাব দেখায় যেন আকাশকে ঢেকে দেবে। আলোকে ঢেকে দেবে। হাওয়াকে বন্দী করবে। আসলে এসব
কিছুই পারে না ও। অক্ষম অহং নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অহমিকা-কথা। এই গাছে ফুল ফোটে না,
ফল ফলে না, তবু ছায়া দেয় বটে। এইটুকু দিয়েই যেন সব দেওয়া হয়ে গেছে ওর! একদিন সকালে
উঠে দেখি কে যেন করাত দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে ওকে। হয়ত চোরা শিকারির দল। চারিদিকে
আলোয় আলো-কথা, ঘাস-কথা যেন মুখ তুলে হাসছে আকাশের দিকে চেয়ে। কাটা গুঁড়িটার দিকে
তাকালে বুক টনটন করে ওঠে এখনও। কিন্তু মুক্ত আলো বাতাসের দানে কথায় মন ভরে থাকে। আমার কথারা
এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে যায়, তাদের ইচ্ছে মতো, আমার ইচ্ছেও ওদের সঙ্গী হয়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন