কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

শয়নযান : একটি নীতিমূলক গল্প
অর্ক চট্টোপাধ্যায়



অসিত একমাত্র শুয়ে শুয়ে ভাবতে পারতো। না শুলে তার মাথা কাজ করতো না। এ জন্য জীবনে কম ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাকে! কোনোদিন পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করতে পারেনি। শেষে হেড মাস্টারকে বলে কয়ে একটা ঘরে শুয়ে শুয়ে, মানে বেঞ্চের ওপর উপুড় হয়ে, পরীক্ষা দিত। পরে যখন ইস্কুল মাস্টারি শুরু করলো, তখন তো ঝামেলাটা চরমে উঠলো। কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইতো না; ভাবতো, ফাঁকিবাজি আর কী! ক্লাস না নেবার অজুহাত! কিন্তু ক্রমশ যখন বোঝা যেতে লাগলো যে অসিতের সত্যিই একটা সমস্যা আছে, তখন ইস্কুলের হেডমাস্টার বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে, একবার না হয় অসিতবাবুকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক"। চেয়ার টেবিলের জায়গায় একটা খাটিয়া পাতা হলো আর অসিত তার ওপর শুয়ে শুয়ে সামনে বেঞ্চে বসা ছেলেদের দিব্যি পড়িয়ে দিলো। এই বন্দোবস্তে প্রথম প্রথম ছেলেরা বেজায় হাসাহাসি করতো, কিন্তু ক্রমশ অসিতের উচ্চাঙ্গের পড়ানো তাদের মন কাড়লো! যে অসিতকে সবাই ক্লাসে দাঁড়িয়ে কিম্বা বসে খাবি খেতে দেখেছে, সে কিনা শুয়ে শুয়ে অমন সুন্দর কাটা কাটা যুক্তি দিয়ে কথা বলে গেল টানা!

কিন্তু সব থেকে বড় সমস্যাটা অসিতের জীবনে নয়, বরং তার মরণে হলো! যে পুণ্য তিথিতে ভর দুপুরবেলা রিটায়ারমেন্টের দেদার ভাতঘুমের ভেতর ঝুপ করে থেমে গেল তার হৃৎপিণ্ড, সেই তিথিতে কেন, তার পর সাত সাতটা দিন কেটে গেলো, অমাবস্যা চলে এলো, তাও তার ব্রেন ডেথ হলো না। অসিতকে যারা অনেকদিন ধরে চিনতো সেইসব বন্ধুরা ডাক্তার মহিতোষ চ্যাটার্জিকে অনেক বোঝালেন যে, অসিতকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে না রাখলে তার মাথায় ভাবনার আনাগোনা থামানো যাবে না; এত বছরের অভ্যেস কিনা! কিন্তু মহিতোষবাবু বিজ্ঞানের লোক, এইসব আষাঢ়ে গপ্প শুনতে যাবেন কেন? অগত্যা অসিতকে ব্রেন ডেথের অপেক্ষায় তার কেবিনেই রেখে দিলেন তিনি। এইভাবে আরো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। বডি পচতে শুরু করায় প্রেসেরভেটিভ দিতে হলো। কিন্তু না, ব্রেন ডেথের কোনো সীন-ই নেই। মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ডাক্তাররা। অসিতও ক্রমশ একটা সেনসেশন হয়ে উঠতে লাগলো। মহিতোষবাবুও থই করে উঠতে পারলেন না আর। তার সিনিয়রদের সাথে অনেক আলোচনা-আলাপ করেও যখন কোনো কুল বা কিনারা হলো না, তখন অগত্যা অসিতবাবুর বন্ধুদের কথা মেনে নিয়ে বললেন "আচ্ছা, ঠিক আছে, একবার না হয় অসিতবাবুকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক"। অতএব মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে শনিবারের মাঝরাতে অসিতকে মর্গে ট্রান্সফার করা হলো; সেখানে বিশেষ এক যন্ত্রের সাহায্যে বরফের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখা হলো তাকে। এইভাবে রাখার পর দিন দুয়েকের মাথায় অবশেষে অসিতের মগজ স্থির হলো এবং তারপর বন্ধুদের কথামতো সোমবার মাঝরাতে দক্ষিণ ভারতের এক জনগোষ্ঠির কায়দায় অসিতকে পালকির মতো একটি বস্তুতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো কবরখানায়; পাছে আবার মাথা কাজ করতে শুরু করে! এরপর ওই দক্ষিণী কায়দাতেই বসে থাকা অবস্থায় তাকে কবর দেওয়া হলো; শুইয়ে দিলে পাছে আবার মাথা নড়ে ওঠে ভেতর থেকে! তাকে না পোড়ানোর কারণটা এর থেকেই আন্দাজ করা যায়! অবশ্য পোড়ানোর মতো সেরকম কিছু আর ছিল না সে শরীরে! এইভাবে আমরা আরো একবার বুঝলাম যে, চিন্তা ব্যাপারটাকে না থামানো গেলে কী ঘোর বিপত্তি হতে পারে!

2 কমেন্টস্:

  1. সহজ সরল প্রথাসাম্মত গদ্যে লেখা এই গল্পে এক প্রচ্ছন্নভ কৌতুক পাঠককে আকৄষ্ট করবে। ভাবা বন্ধ করা দরকার কিনা সেটা ভাবার সময় কি তাহলে এসে গেল?

    উত্তরমুছুন