কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

স্টেফানি বার্বারি

 

ভেনিস রিভিউ: কিম কি দ্যুকের শেষ ছবি ‘কল অফ গড’ (‘ঈশ্বরের আহ্বান’)


(অনুবাদ : অদিতি ফাল্গুনী)




জীবন জুড়ে স্ক্রিন ও স্ক্রিনের বাইরে বহু ক্ষোভের প্রকাশ ও অন্যায়ে জড়িত থেকে অবশেষে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন কোরীয় চলচ্চিত্রের মহান নির্মাতা কিম কি দ্যুক। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বন্ধুরা তাঁর শেষ সিনেমাটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। একটি আবেগপূর্ণ প্রণয় যা দ্রুতই ঈর্ষা ও ঘৃণায় পরিণত হয় - তবে শেষ হয় এক ঐকান্তিক সাঙ্গীতিক সুরে - যেন এক অত্যাশ্চর্য দূর্বত্তের সমাধিলিপি।

‘কল অফ গড’ সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ হয় কিরঘিজিস্থান, এস্তোনিয়া ও  লাতভিয়ায়। ২০১৯ সালে। ২০২০-এর শেষে কোভিডের জটিলতায় কিম মারা যান। তাঁর এস্তোনিয়া ভিত্তিক প্রযোজক আর্তুর ভিবার চলচ্চিত্রটির সংযোজনার কাজ সম্পন্ন করেন। যৌন কারচুপি, বিক্ষতকারী সহিংসতা, আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা ও নৈসর্গিক পৃথিবীর প্রশান্তিদায়ী সৌন্দর্য - কিমের কাজের যাবতীয় সঙ্কেতমূলক উপাদানই এই সিনেমায় আছে। ১৯৯৬ সালে ‘ঈৎড়পড়ফরষব’ (‘কুমীর’)  সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্র ভুবনে পা রাখা থেকে শুরু করে শেষ সিনেমায় পর্যন্ত কিম কি দ্যুকের কাজের সঙ্কেত লক্ষণগুলো মোটামুটি এমনটাই।

একজন পুরুষ (আবভলাই মারাতোভ) এবং একটি মেয়ে (ঝানেল সের্গাজিনা)  রাস্তার মোড়ে পরস্পর প্রথম পরিচিত হয়। কিম গোটা ছবিটির চিত্রধারণ করেছেন যেন মাখন মসৃণ সাদা-কালোয়। তাঁর চরিত্রগুলো যেন ঠিক জ্যামিতিক চেহারায় ফ্রেমবন্দী হয় আর রাস্তার মোড়ের প্রেক্ষাপট হিসেবে রয়েছে এক তরুবীথি যা কোন পার্কের দিকে আপনাকে যেন টেনে নিয়ে যায় আর ক্যামেরা এসবের সামনেই বর্গাকারে স্থাপিত। পুরুষটি ‘ড্রিম কাফে’ কোথায় সেটা জানতে চায়, যা আসলে সুবিধাজনকভাবে পাশেই অবস্থিত। মেয়েটির সাথে কথোপকথনের শুরুতে হাল্কা মজা করার সময় হুট করেই এক তরুণ ছিনতাইকারী এসে মেয়েটির হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায় আর পুরুষটি তখন ছেলেটিকে ধাওয়া করে এবং ছিনতাইকারীর সাথে খানিকটা হাতাহাতির পর  ব্যাগটি উদ্ধারে সক্ষম হয়। তারপর পুরুষটি মেয়েটিকে নৈশভোজে ডাকে। নৈশভোজে ডাকার দৃশ্যটি দেখা ও অনুভবে - গোটা দৃশ্যটিই মনে হয় যেন ফরাসী নব তরঙ্গ সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত। এমনকি সের্গাজিনার পোশাক, একটি ছোট সাদা পোশাক যেন ‘আম্ব্রেলাস অফ শেরবুর্গ’-এর ওয়াড্রোব থেকে নেয়া।

ফরাসী নবতরঙ্গ সিনেমা থেকে ধার করা এই নিরাসক্ত ভাবটি সিনেমায় ক্রমাগত আরো অপ্রাকৃত একটি চেহারা পরিগ্রহ করা শুরু করে। পুরুষটির সাথে প্রথমবার দেখা হবার পর মেয়েটি মাঝরাতে ফোনে একটি রহস্যময় গলার উত্তর দেয়া শুরু করে। আর রহস্যময় কণ্ঠস্বরটি তাকে বলে যে সে (মেয়েটি) এইমাত্র স্বপ্নে দেখেছে যে একটি লোক তাকে জিজ্ঞাসা করেছে যে ‘ড্রিম কাফে’টি কোথায়। মেয়েটি তখন ফোনে স্বীকার করে যে এটা সত্য। মেয়েটি যদি এরপরে কী হয়েছে জানতে চায়, সেই রহস্যময় কণ্ঠস্বরটি বলে - তাহলে মেয়েটিকে অবশ্যই আবার ঘুমিয়ে পড়তে হবে। মেয়েটি অবশ্য জেগে থাকতে চায়, তবে, যা কিছু স্বপ্নে ঘটে তা বাস্তব জীবনেও ঘটে। মেয়েটি স্বপ্ন দেখাই বেছে নেয়।

এর একদিনের ভেতরেই দেখা যায় যে মেয়েটি এবং লোকটি তার (ভদ্রলোকের) গাড়িতে উত্তপ্ত দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত। এবং তারপরই সে বুঝতে পারে যে লোকটি ইতোমধ্যেই অন্য নারীদের সাথে জড়িত এবং যাদের মধ্যে রয়েছে খোদ ‘ড্রিম কাফে’-র মালকিন নিজেই। মেয়েটি তখন পৈশাচিক ঈর্ষাবোধে আক্রান্ত হয়। মেয়েটি লোকটিকে বলে যে, তাকে (লোকটিকে) শুধু তারই হতে হবে, মেয়েটি তাকে অন্য নারীদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে এবং তারপর জিদ করে যে সে লোকটির সাথে যাবে যেন সে মেয়েটির কথা শুনে চলে। এরপরের নখ-কামড়ানো কয়েক মিনিটে ‘কল টু গড’ হয়ে ওঠে একটি ‘হরর ফিল্ম’ বা বিভীষিকা জাগানিয়া চলচ্চিত্র এবং লোকটিই যেন এখানে ভীতির শিকার ও মামলায় বাদীর মত সে যেন তার দু:স্বপ্নের আখ্যান বর্ণনা করছে। কিন্ত এরপরই লোকটির ভেতর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাসনা জেগে ওঠে। যেন উন্মাদনার ধারাক্রম শুরু হয়। অত্যন্ত চঞ্চল বা দ্রুতগতি, তবে একই সাথে আঁকড়ে ধরা সব দৃশ্য যেন অন্য একটা স্বপ্নে ঢুকে পড়ার আগে এই সিনেমার শিরোনামে নিহিত প্রতিশ্রুতিটুকু বাস্তবায়িত হবে বা হবে না।

পরিচালক কিমের ঈশ্বর যেন এই ছবিটির নানা খুঁটি-নাটিতে ইঙ্গিতবহভাবে লুকিয়ে থাকেন - ফুলের পাঁপড়ি, চারপাশের পাহাড়ের উপর ঝকঝক করতে থাকা তুষার - তবে ঈশ্বর যেন খানিকটা লুক্কায়িত। অন্যদিকে শয়তান কিন্ত এই সিনেমার স্ব-মহিমায় বিরাজিত।

বহু দিন ধরেই কোরিয়ায় কিম নারীর নিস্তেজ, পুরুষের হাতে মার খেয়ে তীক্ষ্ণ আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়া মানবী হিসেবে চিত্রায়িত করার জন্য সমালোচিত। আরো বিশেষত: একের পর এক সিনেমায় ঘুরে-ফিরে বিশদভাবে চিত্রিত সব যৌন দৃশ্যের জন্য (কখনো কখনো বা উদ্ভটভাবেই বা যেন চিত্রিত) তাঁর ছবি স্বদেশে নিন্দিত হয়েছে এবং স্থানীয় বাজারে বা কোরিয়ায় বক্সঅফিস সাফল্য বলতে গেলে কখনোই পায়নি। তবে তাঁর ছবিগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সিনেমা ফেস্টিভ্যালে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে, যেখানে তাঁর ছবিগুলোর অসম্ভব শক্তি  ও কালাপাহাড়ি তেজের জন্য পশ্চিমেই বরং কিমের কপালে জুটেছে বহু একনিষ্ঠ ভক্তের দল।

২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় কিমের ‘ব্যাড বয়’ সিনেমাটি একে তো জনপ্রিয়তা পায় না, তাতে এক অভিনেত্রীর দায়ের করা কিম ও সিনেমার এক পুরুষ অভিনেতার বিরুদ্ধে আনা ধর্ষণের অভিযোগে কিমের অত্যাচারী ভাবমূর্তি স্পষ্টতর হয়। কিমের বিরুদ্ধে আসতে থাকে একের পর এক অভিযোগ, যেমন ২০১৮ সালের একটি ঝড় তোলা টিভি প্রতিবেদন তাঁর সুনাম স্বদেশে অন্তত: চিরদিনের মত ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। তিনজন কোরীয় অভিনেত্রী অভিযোগ করেন যে স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্যে লেখা নেই এমন যৌন দৃশ্যে অভিনয় করার অনুরোধ না  রাখায় ক্ষিপ্ত কিম অভিনেত্রীদের কাউকে কাউকে সেটে সবার সামনেই গায়ে হাত তোলেন বা চড় মারেন। দক্ষিণ কোরিয়ার নারীবাদী গোষ্ঠিগুলো কিমের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ফলে মৃত্যুর আগে শেষ কিছু বছর তাঁকে মূলত: বিদেশেই কাজ করতে হয়েছে। তাঁর শেষ ছবি ‘কল অফ গড’ রুশ ভাষায় ও কিরঘিজ  অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে নির্মিত হয় এবং তারও পরের ছবিটি তাঁর লাটভিয়ায় নির্মাণের ইচ্ছা ছিল। ভেনিস চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালে কিম কি দ্যুকের ছবি দেখানোর বিরুদ্ধে কোরিয়ার নারীবাদী সংগঠনসমূহ মুখর ছিল। তবে নন্দনতাত্ত্বিক পরিচালক আলবের্তো বারবেরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে জানান যে ‘মানুষ এবং শিল্পীর ভেতরকার বিচ্ছেদ অনিবার্য’। এই বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক মূলত: আজীবন চলতে পারে - শুধু ‘কল অফ গড’এর প্রশ্নেই নয়।

প্রায়ই জীবনের নানা খসখসে, রুক্ষ দিককে প্রধান করেই ছবি বানিয়েছেন কিম, তবে কখনো কখনো তাঁর ছবিতে এসেছে তূরীয় নানা দৃশ্য বা মূহূর্ত। ‘কল অফ গড’ সিনেমাতেও এমন দৃশ্য আছে: সিনেমার লোকটির গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে  গাছের ফাঁক থেকে আসা রঙীন আলো দৈহিক সম্পর্কে যাবে কি যাবে না এমন বিষয়ে নায়ক-নায়িকার মামুলি কথা কাটাকাটিকে চাপা দেয়, দর্শককে এই দৃশ্যটি মুগ্ধ করবে। আছে কিমের যাবতীয় মানসিক নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে ফেলার মত ভয়ানক সব দৃশ্যের ঝলক, যেমন নায়ক-নায়িকা একটি আলিঙ্গনে ডুবে যেতে থাকে লোকটির প্রাক্তন বান্ধবীর টাটকা কবরের উপর। এই দৃশ্যের প্রতিটি মূহূর্ত ঠিক ততটাই আক্রমণাত্মক যতটা কিম চান। তবে কিমের ছবির শতভাগ ভোক্তা তথা ভক্তদের মতে এটুকু যথেষ্ট নয়। এটা কোনভাবেই একটি ফোঁপানোর শব্দ মাত্র নয়, তবে ‘বিশাল অপরাধী’ কিম একটি খুব ছোট্ট মাত্র ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেন চিরতরে।

(২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘ডেডলাইন’-এ প্রকাশিত)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন