কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১৫


Bison Yellowstone


ইয়েলোস্টোনে রাত্রির একটা রহস্যময় রূপ আছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকা আমার চেনা সুন্দরবর, কানহা, বান্ধবগড়, রণথম্বোর বা কাবিনী নয়। এখানে ঘন সবুজের আড়ালে নেই কালো হলুদের ডোরা। এ আমার পরিচিত মাসাইমারা, আম্বোসেলী  নয়... এই প্রান্তরে শোনা যায় না সিংহের গর্জন, হস্তীর বৃংহণ। এখানে রাত আসে তার নিজস্ব শব্দ আর গন্ধ নিয়ে। গন্ধকের ধোঁয়াটে কুন্ডলী ভেদ করে হেঁটে যায় তৃণভোজীর দল, সেজব্রাশের ঝোপে সরে সরে যায় শ্বাপদের ছায়া, প্রান্তরের জলাশয়ে অবগাহন করে জ্যোৎস্না।

'আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী

আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার

আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়

মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।

বাতাসে ছেঁড়া মেঘ, চাঁদের চারপাশে

সহসা দানা বাঁধে নীল সময়

বাইরে এসে দেখি পৃথিবী শুন্‌শান্‌

রাস্তাগুলি যেন আকাশময়।'

আমি একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে  হেইডেন ভ্যালির পাশে বসেছিলাম বহুক্ষণ। ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে বাজ জানালো, 'রাত পৌনে দশটা বাজে। লজে ফিরবে না? তোমাকে চিনি না? কালকেও তো ভোরবেলা আসা চাই.... তাই না?'


Fishing Bridge Yellowstone


তাই না তাই। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ফিরতি পথে যাত্রা। পেরিয়ে গেলাম লেক ভিলেজ, ফিসিং ব্রিজ, ইয়েলোস্টোন লেক। রাস্তায় কত না বাইসন আর হরিণ। দিনের বেলা যে রাস্তায় থাকে পর্যটকের গাড়ির ভিড়ভাট্টা, রাতে সেই পথ বাইসনের, হরিণের। আমি খুব ধীরে ধীরে মনোযোগ দিয়ে বাজের সঙ্গে সেই রাস্তা পেরোচ্ছিলাম। খানিক বাদে সিলভ্যান লেক আর সিলভ্যান পাস্। চারিদিকে আলকাতরার মতো অন্ধকার। রাস্তা পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে উঠছে। পাশে অতল খাদ। সেই আবসরোকা পর্বতমালা। আগ্নেয়শিলা দিয়ে তৈরী যার চূড়াগুলি কাকের ঠোঁটের মতো কালো আর তীক্ষ্ণ। আবসরোকা উপজাতির এলাকা। লম্বা ঠোঁটের পাখির সন্তান। হঠাৎ পেছন থেকে তীব্র হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বাজের চেয়েও বিরাট একটা গাড়ি কোথা থেকে এসে একেবারে আমার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। হাই বিমের আলো আমার রিয়ার ভিউ মিররে পড়ে আমার দু চোখ ঝলসে দিচ্ছে। আমি যে একটু পাশে গিয়ে জায়গা দেব তেমন পরিসরটুকুও  নেই । নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর তীব্র আলোর মধ্যবর্তিনী আমি। রাভেন! আলো এবং অন্ধকারের মধ্যবর্তী প্রহরী।

'এ যেন নিশিডাক, মৃতের হাতছানি

এ যেন কুহকের অজানা বীজ

এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়

হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ।

আমাকে যেতে হবে এখনো যেতে হবে

রয়েছে অশরীরী অপেক্ষায়

যেখানে ব্যাকুলতা ঢেউয়ের তালে দোলে

যেখানে ধ্বনিগুলি স্মৃতিকে খায়।'

ভীষণ বিপদের সময় দেখেছি আমার মাথার ভেতরে কেউ কয়েকটা বরফকুচি ছড়িয়ে দেয়। তাঁকে আমার প্রণাম। একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে রিয়ার ভিউ মিররটা আকাশপানে তুলে দিলাম। আমার চোখে এখন কেবল বাজের হেডলাইটে আলোকিত পথ। চোয়াল শক্ত করে, ঠিক যে গতি এই পথের জন্য নিরাপদ সেই গতিতে এগোতে লাগলাম লজের পথ ধরে।

'আমারে তোমরা দাবায়া রাখতে পারবা  না!'


Mammoth Hot Springs Elk


পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে যেখানে সম্ভব হলো সেখানে ইন্ডিকেটর দিয়ে গাড়ি পথের পাশে সরিয়ে নিতে অন্য অধৈর্য্য গাড়িটি খুব রাগ দেখিয়ে সা সা করে চলে গেল। আমি নিরাপদে আমার পাইন কাঠের ২ নম্বর কেবিনে ফিরলাম। সেখানে মাইক্রো ওয়েভে সেই মিক্সড বেরি পাই গরম করে খেয়ে প্রশান্ত নিদ্রা।

সূর্যাস্তের সময়  থাকে প্রৌঢ়ত্বের বিষণ্ণতা আর সূর্যোদয়ে থাকে শৈশবের সম্ভাবনাময় বিস্ময়। আমার তো সব দেখা চাই, সব। পরদিন সকালে খুব ভোরে উঠে ফ্লাস্কে চা  আর বিস্কুট নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখি পাইন বনে একটা আশ্চর্য নতুন দিন আগতপ্রায়। বাজকে চালু করে সবে একটু এগিয়েছি, সে অমনি খ্যাচখ্যাচ করে জানালো যে সামনের ডানদিকের চাকার হাওয়া কমে গ্যাছে! শুনে তো আমার হাওয়া টাইট! কাছাকাছি তো কোনো পেট্রলপাম্প বা গাড়ির গ্যারেজ নেই। পার্কের ভেতর লেক ভিলেজে একটা পেট্রলপাম্প দেখেছিলাম বটে কিন্তু সে তো এখান থেকে প্রায় ৫০ মাইল পথ। তার ভেতরে ওই পাহাড়ি রাস্তা। কোডি শহর তো উল্টোপথে আরও দূর। মগজের বরফকুচি তখন আমার রগ বেয়ে গলে পড়ছিল!

হঠাৎ দেখি একটা রাভেন ডানা ঝাপ্টে পাইনের ডালে এসে বসেছে। সম্পূর্ণ কাকতালীয় ঘটনা তবু আমার দ্বিধাভঞ্জনে ওটুকুই যথেষ্ট ছিল। আমি দুগ্গা দুগ্গা বলে গেটের বাইরে ডানদিকে মোড় নিয়ে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের পূবদিকের গেট বরাবর চলতে শুরু করলাম। সেই চেনা পথ, সেই আবসরোকা পর্বতমালা, সেই সিলভ্যান লেক আর একটা আনকোরা দিন। বাজের খ্যাচখ্যাচি ক্রমে বন্ধ হয়ে এল। সে বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছে। এমত অবস্থাতেও ইয়েলোস্টোন লেকের ভোরবেলা অস্বীকার করে এগোনো গেলো না। লেকের পাশে ফুটে থাকা বনফুল, জলে প্রথম আলোর আদর, গন্ধকের ধোঁয়াটে রহস্য, পাখির মিঠে গান, এই অভাবনীয়ের  জন্যেই তো বেঁচে থাকা। আমি লেকের ধার দিয়ে অভিভূত হয়ে হাঁটছিলাম আর বাজ পথের ধরে তার স্তিমিততেজ ডান চাকা নিয়ে প্যাঁচাপানা মুখ করে বসেছিল। কথাবার্তা বন্ধ। সফরে এই প্রথম নিজেকে বিবাহিত মনে হল!

এরপর পেট্রলপাম্প, চাকার হাওয়া, তেল আর অল্প ঘুরঘুর করে লজে ফেরত। সেখানে সকাল ৭:৩০ থেকে ১০:০০ অবধি ব্রেকফাস্টের সময়। এর পরে পৌঁছলে হরি এন্ড মটর। যার রাত কেটেছে পাঁউরুটি, টমেটো স্যুপ আর এক স্লাইস মিক্সড বেরি পাই খেয়ে, সে ব্রেকফাস্ট না পেলে ওই শান্তগোছের কালচে বাদামী ল্যাব্রাডরকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলতে পারে! সে রিস্কে গিয়ে কাজ নেই। প্রথমেই ঝোড়ো কাক হয়ে সুসজ্জিত ডাইনিং হলে ঢুকে একটা পেটচুক্তি ব্রেকফাস্ট সারলাম। এখানে যে রান্না বান্না চমৎকার তা গতকালের টমেটো স্যুপই বলে দিয়েছিল। তারপরে ঘরে গিয়ে ভালো করে স্নান সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে খানিক সেই কালচে বাদামি ল্যাব্রাডরের সঙ্গে আলাপচারিতা। সেই দলে হঠাৎ রিবন বাঁধা আর একটি ছোট সাদা ব্যক্তিত্ত্বপূর্ণ কুকুরের আগমন ও তড়িৎ প্রস্থান। তারপর আপিসঘরে  গিয়ে চাবি ফেরত। ইস্ট গেটের দিকে চলতে চলতে ভাবছিলাম এই সফরে কত না ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাত্রিবাস, কত না এক রাত্রের মালিকানা, কত না চাবি ফেরত...

'আমার কাছে এখনো পড়ে আছে

তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি

কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোল!

থুতনি পড়ে তিল তো তোমার আছে

এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?

চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো'

সারাটা দিন ধরে পার্কের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তবে যেহেতু আমি এখানে আগে একবার এসেছি তাই যেইসব জায়গায় পর্যটকদের খুব ভিড়, যেখানে বিশাল বিশাল উষ্ণ প্রস্রবণ, গন্ধকের বিভিন্ন ভূ-তাপীয় স্ফূরণ আমি সেই সব এলাকা পাশ কাটিয়ে বাইসন আর হরিণে মজে রইলাম। একটা গোল চক্রাকার পথে পার্কটিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে পৌঁছলাম নরিস। পার্কের  উষ্ণতম এলাকা। সেখান থেকে শেষ দুপুরে ম্যামথ হট স্প্রিংস (Mammoth Hot Springs). সেখানে শহরের ভেতরেই দলে দলে এল্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে, রোদ পোয়াচ্ছে, মাঠের ঘাস খাচ্ছে... কাশীর ষাঁড়ের মত মন্থর, অবাধ গতিবিধি। একজন গার্ড মহিলা হাতে লাউডস্পিকার নিয়ে সকলকে সতর্ক করছিলেন।

'এল্ক বন্য প্রাণী। গুঁতিয়ে দিলে বিপদে পড়বেন। আপনারা ওদের কাছে যাবেন না বা ওদের খেতে দিতে চেষ্টা করবেন না।'

তা সত্ত্বেও দেখলাম কিছু পর্যটক এল্কের সঙ্গে সেলফি তোলার চেষ্টায় কোনো গাফিলতি করছে না।


Night in yellowstone


আমি চলেছি উত্তরমুখে।  ইয়েলোস্টোনের উত্তরের গেটের লাগোয়া শহর গার্ডিনার। সেখানেই আজ আমার রাত্রিবাস। সেখানেই আজকের মত চাবি বুঝে নেওয়া।

'চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে

রেখেছিলাম আজি সময় হলো--

লিখিও উহা ফিরৎ চাহো কিনা?

 

অবান্তর স্মৃতি মধ্যে আছে

তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো

লিখিও উহা  ফিরৎ চাহো কিনা?'

 

(ক্রমশ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন