কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২

দেবাশিস সরকার

 



অশোক তাঁতী

 

“They put two coins on eyes

And hot burning fire

On their mouth

To celebrate my non-existence.”

 

(Ashoke Tanti)

করোনার করাল গ্রাসে আমাদের সংস্কৃতি জগতের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে চলেছে তার শেষ কোথায় আমাদের জানা নেই, তবে সেই ক্ষতিতে নবতম সংযোজন আমাদের কাছের মানুষ, প্রিয় কথাকার অশোক তাঁতীর চলে যাওয়া মৃত্যু এসে যেন আচমকা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল ওকে না, ওর দুচোখের পাতায় কোনো মুদ্রা রেখে মুখাগ্নি করে কোনো পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ ঘনিষ্ঠজনরা পাননি, সরকারী ব্যবস্থাপনায় আপাদমস্তক প্লাস্টিক আবৃত হয়ে চুল্লীতে উঠলেন তিনিআমরা যে যার বাড়িতে বসেই স্তম্ভিত হয়ে শুনলাম তাঁর প্রয়াণবার্তা

অস্বিত্বহীনতার উদযাপন নয়, বরং অশোকের চলে যাওয়ায় দুর্গাপুর তথা সমগ্র লিটল ম্যাগাজিনের ভিন্ন ধারার গল্প চর্চ্চার যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়ে গেল তা  এক সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করবো

অশোকের সবথেকে বড় কাজরাঢ়বাংলার কারখানার গল্প; বিষয় চেতনা নির্মাণনামের প্রবন্ধর বইটি বইটির উদ্দেশ্য নামকরণেই স্পষ্ট, তবে ভাবী পাঠকদের আগ্রহ জাগানোর জন্যে বিষয়চেতনার কোন স্তর আলোকিত করেছেন লেখক তার ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে- ভাষা, সাহিত্য ইন্ড্রাস্ট্রি কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে অণ্বিত, পারস্পরিকতা, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদের বাসস্থান, কারখানার পরিবেশ চেতনার পরিবর্তন, কারখানার পরিবেশ ভাষাকোন্ বিষয়টিকে রাঢ়ের লেখকেরা উপজীব্য করেননি! এই উপলব্ধি যেমন বিস্মিত করে, ততোধিক বিস্মিত করে প্রাবন্ধিকদের অনুসন্ধিৎসা পঠন অভ্যাস

দুঃখের বিষয়, এই অমূল্য গবেষণা গ্রন্থটি বিদ্দ্বজনের নজরে আসেনি অবশ্য প্রান্তিক লেখকরা বরাবরই উপেক্ষিত

বাজারের পৃষ্ঠপোষকতাহীনতায় এই এলাকার যে সমস্ত ছোটগল্প হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সংরক্ষণের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না’’ বলে এই বইটিতে যে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন লেখক তা যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক কঠিন বাস্তবতা অশোকের এই প্রবন্ধ সংকলনটির ভূমিকায় সমীর রায়চৌধুরী যথাযথ বলেছেন, “এই গ্রন্থের যে কোনো একটি পরিচ্ছেদ নিয়ে আগামী সমালোচকরা পৃ্থক গ্রন্থ   দিশা সংকেত গড়ে তুলতে পারবেন”।

নয়ের দশকেকল্প বিভাষপত্রিকায় (সম্পাদক - পার্থজিৎ ভক্ত) অশোকের  প্রথম আত্মপ্রকাশ তবে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় অভিযান পাব্লিশার্স  থেকেশূন্য দশকের গল্পনামে যে সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশ হয়, তাতে সাধনদা অশোককে তাঁর নিজস্ব যুক্তিতেশূন্য দশকের কথাকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন

আমরা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে অশোকের গল্প নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে পারি

গাছগল্পটি দিয়ে শুরু করা যাক এক বৃ্দ্ধ অথবা গাছের গল্প এটিদক্ষিণ  চব্বিশ পরগণার বাদা বা ভেড়ি অঞ্চল গল্পের পটভূমি গল্পে প্রোটাগনিস্ট গিরিবুড়ো গিরিবুড়ো সর্বহারা, থাকার মধ্যে রয়েছে একটি ছোট ছিটে বেড়ার ঘর, সে ঘরটি নেবার জন্য ভাইপোদের ছোঁকছোকানি, বুড়ো কবে মরবে তবে শিরিষ গাছের মত বুড়ো এখনও সোজা খসখসে ছালের মত মোটা চামড়াবুড়োর একটা ছেলে চুরি করে জেল খাটছিল সেটা এখন কোথায়? আর একটা ছেলে কোথায় মজুর খাটে সে খবর কোন গাছ আর নেয়?’’ বুড়ো দরমার কুঁড়েতে একাই থাকে, সঙ্গী বলতে একটা নেড়ি কুকুর নিস্তরঙ্গ গ্রামীন জীবন অন্যান্য আর পাঁচজনের মত গল্পের গিরিবুড়োর যাপন অভ্যাসও প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি এজমালি পুকুরের জল ছেঁচে ফেলা এবং পুকুড়পাড়ের গাছ কাটার উদ্যোগটিই এই গল্পের ঘটনাক্রম

প্রথমে গল্পের পটভূমি নির্মাণে লেখকের লিখনভঙ্গির কিছু নমুনা আমরা দেখে নেবগিরিবুড়ো বাদার দিকে যায় বাহ্যে করতে নেড়িটাও শব্দ পেয়ে ওঠে  হেলতে দুলতে যায় খেতেবা’ – কেন, খুড়ো তোমাদের কি ছাবাল পোন হতুনি? –হবেনে কেন? গন্ডাগন্ডা হতু তেমন মরতুও একটা গাচ হবার জায়গায় কি চারটে গাচ হয়? একন হয় তাইচুন হচ্চে ফলতেচেও বেশ কিন্তু জমি কি আর তেমন শাঁসালো থাকতেচে? জমি যদি গেল তো মাই দেবে কে? তা তোরা কি খাওয়াচ্চিস? অসুদ? কোটর দুদ? ওরা কি আর জানতেচে কোতায় মাটির টান? তার কেমন মিস্টি স্বাদ? ওরা সব চোর হবে, ডাকাত হবে, খুনে হবে গিরিবুড়ো ওঠে হনহন করে বাড়ি যায় এক ছিলিম তামাক জ্বালে গাছের গোড়ায় এসে পা ছড়িয়ে দেয় নেড়িটা কোথায় ছিল হালকা চালে বিছানা ঝেড়ে বুড়োর পাশে শুয়ে পড়ে গাছের নীচটা ঠান্ডাপাম্পের একটানা শব্দ থেমে বিক্ষিপ্ত শব্দ শোনা যায় বুড়ো ওঠে মালকোচা দেওয়া গামছা পুকুর পাড়ে আসে নেড়িটা আগেই বেরিয়েছে পাইপের মধ্যে পাঁক ঢোকা বন্ধ করতে চুবুড়ির ওপর পাইপের মুখটা রাখা”।

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন হল ডিটেলিং বোঝাতে নেড়ি কুকুরটির চলাফেরা বা পুকুরে পাম্প চালিয়ে জল বের করে ফেলার সময় জলের ভেতরে সাকসন হেডটিতে যাতে পাঁক না ঢোকে, সেসব আপাত তুচ্ছ বর্ণনা যা গল্পের গতিবৃ্দ্ধি করে না, এগুলিকেই বলে ডিটেলিং এই ডিটেলিংই বর্ণিত বস্তুর দৃশ্যমূল্য তোয়ের করে গল্পের ভেতরে ফেরা যাক পুকুর পাড়ের যে বিশাল শিরিষ গাছের ছায়া ছিল বুড়ো আর তার সঙ্গী নেড়ি কুকুরটির বিশ্রামস্থল, এক ভোরে সেই  শিরিষ গাছটি কাটতে তিনজন লোক চলে আসে সেই গাছটি কাটায় আপত্তি জানালে বুড়োকে হাতে-পায়ে বেঁধে পুকুর পাড়ে ফেলে রেখে প্রথমে গাছটির  ডালগুলি কাটতে শুরু করে এরপর এক কান্ড ঘটে – “সবার অন্যমনস্কতায়  বুড়ো বাঁধন খুলে ফেলে পাঁচুদের তিনজনকে ঢিল মেরে গাছ থেকে নামতে বাধ্য করে তারপর পরম মমতায় গাছের গায়ে হাত বোলায় বুড়োর চামড়া ক্রমশ গাছের মত খসখসে হয়ে যায়রোদ জল বৃষ্টিতে মাখামখি গিরিবুড়ো একটা গোটা গাছ হয়ে যায়”।

ইদানীংকালে পপুলার ফিকশনের দাপাদাপি যেভাবে বেড়ে উঠেছে তাতে মনে হয় সমাজমনস্কতা বা সমাজের অন্ধবিন্দুগুলি থেকে লেখক তার দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট রম্যতা বেচে খাওয়া বাজারী পত্রিকাগুলির নিকৃষ্ট লেখাগুলি কোনো লক্ষ্যে পৌঁছায় না সুখের বিষয় লিটল ম্যগাজিনগুলি রম্যতা বিক্রি করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি অশোক তাঁতীও রম্যতা বেচে টু পাইস কামানোর দলে নাম লেখাননি কে জানে আমাদের এই গিরিবুড়োই সুন্দরলাল বহুগুণা কিনা! গাছকে জড়িয়ে ধরা বা পরম মমতায় গাছের গায়ে হাত বোলানো চিপকো আন্দোলনের মুল উদ্দেশ্য সাহিত্য তো এভাবেই জীবনের সাথে অন্বিত হয়ে যায় আমাদের মত আলোকবৃত্তের বাইরে থাকা অক্ষরকর্মীদের কাছে চাহিদা তো এটাই মানুষ যেমন সমাজমুখী হবে, সমাজও তেমনি সাহিত্য অভিমুখী হবে


1 কমেন্টস্:

  1. দেবাশিসের মতামত মূল্যবান। ও নিজে একজন দক্ষ কথাকার। অশোক এবং ও একসঙ্গে কাজ করেছে লেখালেখি নিয়ে। আরও বিস্তৃত দেবাশিসকে চাই অশোকের জন্য।

    উত্তরমুছুন