চারানা আটানা
(৫) তেরো-স্পর্শ
বছরটা শেষ হতে চললো।
এই জাস্ট সেদিন ধূপধুনো দিয়ে বরণ করলাম বছরটাকে, এর মধ্যে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চোদ্দ শাক খেয়ে এর চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ফেলা হলো। আর কদিন পড়েই হুড়মুড়িয়ে দু’হাজার চোদ্দ এসে পড়বে।
এলে আর ঠ্যাকাচ্ছে কে! গোরারা তো চায়ই যে, এ বছর জলদি ফুটুক, তেরো নাকি অশুভ। তেরোস্পর্শেই – মানে সংস্কিতোয় আমরা যে বলি ত্র্যহস্পর্শ, তাতেই – নাকি ওদের দেশের হাতে হেরিকেন, মানে ক্যাটরিনা-ফ্যাটরিনা টাইপের বিভিন্ন সেক্সি সেক্সি নামের ঝড়-ঝঞ্ঝ্বা। মারী ও মড়ক নিয়ে আমরা ঘর করছি আজীবন, আমাদের এসবে কিস্যু এসে যায় না। একটু মাড়ি-টাড়ি ফোলে হয়তো, অথবা পুরনো মোড়াটা মড়মড় করে ভেঙে যায়। মুড়ি-মুড়কির দাম বাড়ে। সিন্দুকের মধ্যের কালেকশনের মোড়ক খুলে মিরাকুলাসলি দেখা যায় মর্মরমূর্তি হাপিস, কে ঝেড়ে দিয়েছে! মারোয়াড়ির হাতে বিকিয়ে যায় রূপোর মরিচদান।
মান্না দে চলে গেলেন। একে একে নিভিছে দেউটি! এটা অবশ্য একটু বিশেষ যাওয়া, প্রবাসে দৈবের বশের মতো। বহুদিন ধরে ভুগছিলেন, বয়সও হয়েছিল, স্রেফ এত বছর বেঁচে থাকার জন্যে মোরারজী দেশাইকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিরা অতিরিক্ত পরিমাণে মিষ্টি আর তেলেভাজা খায় বলে এত বছর বাঁচে না, ব্যতিক্রম জ্যোতিবাবু। অবশ্য জ্যোতিবাবু পদবীতে বসু হলেও সঙ্গে একটা সরকার ছিল, দরকারে কাজে লাগতো। মান্না দে’র শুধুই দে, তাই দিয়েই গেলেন, বদলে পেলেন না তেমন কিছু। ব্যাঙ্গালোরের এক হাসপাতালে বেশ ক’মাস চিকিৎসা হবার পর আর টানতে পারলেন না মান্না। কাগজে বেরলো, তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা নাকি অমানুষ, তাঁকে দেখতোও না। শেষযাত্রায় জনা কুড়ি লোক ছিল, মূলত অবাঙালি। এর চেয়ে তার দল থেকে সাস্পেন্ডেড কুণাল যে কোনো রাস্তার মোড়ে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে কলকাতায় বেশি লোক হবে, অটোয়ালারা অন্তত খানিকক্ষণ প্যাসেঞ্জার না নিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবে। কর্ণাটক সরকার ঘোষণা করল, হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দেবে। বাস, ফুঁসে উঠলো বাঙালি! আমাদের লোক মলো, আর বিল দেবে ওরা! কেন, আমাদের কি মান-ইজ্জত বলে কিছুই নেই?
আছে, ঐ ধুয়েই তো খাচ্চি! তবে সিন্দুকে ট্যাকা আছে কিনা সন্দেহ। যাতে কিছু পুঁজি জমা পড়ে, তার জন্যে সিগারেট-বিড়িতে ঝেড়ে ট্যাক্স বসিয়ে জনগণকে বেশি করে ফোঁকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাতেও কাজ বিশেষ হচ্ছে না বোধ হয়, এখন শুনছি মালের দোকান দিনরাত্তির খোলা, যাতে গ্যাসে কাজ না হলে অন্ততঃ লিকুইডে পুষিয়ে নেওয়া যায়। তো সেই পয়সায় মান্না দে’র চিকিচ্ছের বিল মেটানোটা কি খুব ভালো দেখাতো?
মরদেহ কলকাতায় উড়িয়ে নিয়ে আসার কথাও হয়েছিল, সম্ভবত শেষ কাজ হয়ে যাওয়ার পর! বেঁচে থাকতে যারা খোঁজ নেয় নি কখনো, তারা সদলবলে নেতৃত্বের নিন্দে করতে লাগল। মান্না দে মরিয়া প্রমাণ করিলেন, বাঙালি একই আছে। শুধু তাঁর গুণমুগ্ধ কয়েকজন, যারা তাঁর স্বর্ণকণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ ছিল, তাঁর গানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল ভালোবাসার সংজ্ঞা, তাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নীরবে গুমরে কাঁদতে লাগল নিশুতি রাত।
তেরোর সবই যে কান্নাকাটির নয়, তার জন্যে একশো বছর পেছিয়ে গেলেই বোঝা যাবে। আমাদের কলকাতার লোক, বাংলায় পদ্য ফদ্য লিখতো, হুট করে কী মাথায় চাপলো, তার থেকে মাত্র শ’খানেকের ইংরাজি ট্রানস্লেশন করে ফেললো, আর তার জন্যে নধর একটা নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেল। ঊনিশশো তেরো সালের কথা। মাংসভাতের লোভ দেখিয়ে লরি বোঝাই জনমজুর জুটিয়ে এনে ব্রিগেডে মিটিং করে বা যাদের মা বেঁচে নেই তাদের মাওবাদী ঘোষণা করে জেনেরালি নোবেল প্রাইজ পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, পাঁচ পাঁচ রকম ব্যাপারে নোবেল দেওয়া হয়, লেখালিখি তার একটা, তার আগে এশিয়া থেকে সেই পাঁচ রকমের কোনোটার জন্যেই কেউ নোবেল প্রাইজ পায়নি। দারুণ ক্যালির ব্যাপার, তবে ক্যালকাটার লোক হলেও কালীপুজো করত না সেই দাড়িওলা বাহান্ন বছরের বুড়ো। অতগুলো টাকা পেল, কোথায় সারদার মতো চিটফান্ডে হেবি রিটার্ণের জন্যে ইনভেস্ট করবে, তা না পুরো টাকাটা ঢেলে দিল এক ইস্কুল বানাতে! বাঙালিকে শিক্ষিত করবে!
যেমন কম্মো, তেমন ফল। সেই মেডেল ঝেড়ে দিয়েছে কোনো এক বঙ্গসন্তান। হোম মিনিস্ট্রি হকার টকারদের ওপর হম্বিতম্বি করে ওদের ক্যাডার বানিয়ে ফেলেছে, তবে সেই মেডেল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বুড়োটা ‘সহজপাঠ’ বলে বাচ্চাদের জন্যে বই লিখেছিল। বাচ্চারা পড়তো টড়তো। তবে রাজ্যের অভিভাবকরা বললো, না না, এ অতিশয় কঠিন। পুরনো ধ্যানধারণা পালটে বরং আধুনিক কবিদের পদ্য ঢোকানো হোক। দাড়িওলা কবি কি আমাদের দলে শর্ট পড়েছে? এর ইনডিরেক্ট এফেক্টে ইয়াং সুকান্তও চলে গেল মায়ের ভোগে। বেচারী নিজে বিয়ে করার আগেই ‘স্বর্গে’ চলে গেল, কিন্তু এমন ভাইপো রেখে গেল, যে এখন পুন্নিমের চাঁদকে নিয়ে কিছু বললে হাজতবাস হতে পারে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বলে এক ভদ্রলোক, যাঁর ছিল ছাপাখানার ব্যবসা, তিনিও সেই ঊনিশশো তেরো সালেই ‘সন্দেশ’ বলে এক পত্রিকা বের করে বসলেন। টুনটুনির গল্প, ছেলেদের রামায়ণ-মহাভারত এইসব লিখে তিনি বাচ্চাদের মনোরঞ্জন করছিলেন। ছেলে সুকুমারকে লন্ডনে পাঠিয়ে বললেন, যা, ছাপাখানার লেটেস্ট টেকনোলজি শিখে আয়! ছেলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ডবল ডিগ্রীধারী। দেশে ফিরে ‘সন্দেশ’ হাতে পেয়ে সেও বাচ্চাদের জন্যে পদ্য-গদ্য লিখে হাত মকশো করা শুরু করে দিল। ‘আবোল তাবোল’, ‘খাই খাই’, ‘পাগলা দাশু’, ‘অবাক জলপান’ – এইসব যা যা সে লিখে গেছে, তা এই একশো বছরেও আর কেউ পারেনি। আমসত্ত্ব-দুধ-কদলী ছাড়াই সেই সন্দেশ চেটেপুটে শেষ করত বাচ্চারা, পিঁপড়ের জন্যে কিস্যু ফেলে রাখত না।
সেই ঊনিশশো তেরো সালেই টাঙ্গাইলের সরকারবাড়িতে প্রতুল বলে এক ছেলে জন্মালো। দেশ চালাচ্ছে বিদেশী সরকার, কিন্তু মা ষষ্ঠীর কৃপায় বঙ্গসন্তানের সংখ্যা কোনো সময়েই অপ্রতুল নয়। বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে ইংরেজদের তাঁবেদারি করতে পারলে ভবিষ্যত গুছিয়ে নেওয়া যেখানে সহজ, সেখানে যেন কোনো এক দৈব ম্যাজিকেই এই প্রতুলের বড় হয়ে শখ হলো ম্যাজিক শেখার। দুনিয়াকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ম্যাজিক দেখিয়ে গেল সে। যাবার আগে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়ে গেল তার আশ্চর্য জগতের যাদুকাঠি।
বাংলার তখন বেশ জটিল পরিস্থিতি। কার্জনসাহেব আট বছর আগে বাংলাকে কাৎলা মাছের মতো কেটে দু-টুকরো করে মুড়ো-ল্যাজায় দ্বন্দ্ব বাধিয়ে ডিভাইড অ্যান্ড রুল চালু করেছেন, যার উত্তরে বাংলা উঠেছে গর্জে। অরবিন্দের নেতৃত্বে বাংলায় বোমা বানানো হচ্ছে ইংরেজদের মেরে তাড়ানোর জন্যে। ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’র ব্যানারে অরবিন্দের সাথে আছেন ভাই বারীন, বাঘা যতীনের মতো বাঘের বাচ্চারা। ভুল জায়গায় বোমা মেরে শহীদ হলো প্রফুল্ল, ফাঁসিতে চড়ানো হলো ষোল বছরের ক্ষুদিরামকে। সারা বাংলার আকাশে বাতাসে ভাসতে লাগলো মর্মস্পর্শী গান – ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’।
ছ’বছর পর কাটা বাংলা জোড়া লাগাতে বাধ্য হলো ইংরেজ, কিন্তু রাজধানী কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে গেল দিল্লী। ভাবলো, দিল্লী দূর হ্যায়! সেই ঊনিশশো তেরোতেই ঊড়িষ্যার কটকের র্যাভেনশ’ কলেজ থেকে ম্যাট্রিকে সেকেন্ড হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সীতে পড়তে এলো এক সুদর্শন যুবক। সেখানে ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন ভারতীয়দের নিয়ে ভুলভাল মন্তব্য করায় তাকে এমন শিক্ষা দিল যে, তিনি ওঠেন কি বসেন, বুঝতে পারলেন না। ভারতের পরবর্তী ইতিহাসের অনেকটা এই ছেলে সুভাষের নিজের কীর্তি। দিল্লী চলো ডাক দিয়েছিল সে, সেখানে পৌঁছাতে পারলে আজ দেশের হাল অন্যরকম হতো।
দেশের অন্যপ্রান্তেও সেই তেরো সালে বিচিত্র ঘটনা ঘটছিলো। মহীশূরের উপকণ্ঠে ধারোয়ার ও হুবলি দুই পাশাপাশি শহর, যমজ ভাইয়ের মতো। চিক্কুরাও নাদিগার নামে এক ভদ্রলোক, তাঁর বাড়ি ধারোয়ারে, চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্ত্রী অম্বাবাঈ ভালোবাসেন গান, কর্ণাটকী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত। দুর্ভাগ্য তাঁর, যে পরিবারে অম্বা-র জন্ম হয়েছিল, সমাজের চোখে সেটা নিচু জাত, তাদের গান গাওয়ারই অধিকার নেই, স্টেজে পরিবেশন তো দূরের কথা। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন অম্বাবাঈ, সাধনা করে যান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। হয়তো এমন দিন আসবে, যখন এই নিষ্ঠুর জাতপাতপ্রথা দূর হয়ে যাবে। তাঁর নিজের জীবিতকালে না হলেও, হয়তো পরবর্তী প্রজন্মে।
ঊনিশশো তেরো সালে তাঁর কোল আলো করে এলো এক কন্যাসন্তান, চিক্কুরাও তার নাম রাখলেন গাঙ্গুবাঈ। পরে সারা ভারত তাঁর ক্লাসিকাল গানের যাদুতে মুগ্ধ হলো।
আমাদের দেশে গান শুনলেই এখন লোকে বলে, কোন্ সিনেমার? তো সেই তেরো সালেই ভারতের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি রিলীজ হলো সিনেমাহলে, তার নাম ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, পরিচালক দাদাসাহেব ফালকে। এ ছবিটি ছিল অ-বাক্। ভারতীয় ছবিতে সংলাপ শুরু হওয়া আরো পরের ঘটনা, কিন্তু সেই যুগে পরাধীন ভারতে এটাও এক অবাক কাণ্ডই বটে। আর সেই চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপাতে সেই তেরো সালেই রাওয়ালপিণ্ডি শহরে এক পাঞ্জাবী ক্ষত্রি পরিবারে জন্ম হলো যুধিষ্ঠির সাহনির, আমরা যাঁকে পরে চিনলাম বলরাজ নামে। আর মুম্বইয়ের শহরতলিতে কাপড়ের কলে চাকরি করা আভাজী পালব-এর ঘরে জন্মালেন ভগবান, ক্রমে তিনি হয়ে গেলেন ভগবান দাদা।
মরেচে! রম্যরচনা লেখার কথা, এটা হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস। তার ওপর গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গল ছাড়া এতে আর কোনো মহিলার নাম নেই। ইতিহাস কি শুধু পুরুষের তৈরি এক ইমারত, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিগত দিনের শত শত ভুল?
ঊনিশশো তেরো সালের এক মহিলার কীর্তি দিয়ে শেষ করি এই সংখ্যার চারানা আটানা। সেই বছরের শেষের দিকে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এক তরুণী মেরী ফেল্প্স্ জেকব আবিষ্কার করলেন মহিলাদের প্রথম আধুনিক বক্ষবন্ধনী। তাঁর করা নতুন ডিজাইনের পেটেন্টও নিলেন তিনি। এর আগে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের ঊর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস হিসাবে ব্যবহৃত পোশাক ছিল কর্সেট, তা শুরু করেছিলেন ফরাসী রাজা দ্বিতীয় হেনরির পত্নী রাণী ক্যাথেরিন। মেয়েদের সৌন্দর্য বলতে বোঝানো হতো আওয়ারগ্লাস ফিগার অর্থাৎ ভারী বক্ষ ও নিতম্ব, মধ্যে সরু কোমর, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্সের সেই ছত্রিশ-চব্বিশ-ছত্রিশ। ক্যাথেরিনের তাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের সরু কোমর বীভৎসভাবে আঁটসাঁট করে রাখা। তাঁর ডিজাইনের কর্সেটে ব্যবহৃত হতো তিমিমাছের কাঁটা অথবা ধাতব সরু রড, যেগুলো দিয়ে কোমরের কাছটা টাইট করে রাখা হতো। মাঝে মাঝেই সেগুলো হয় শরীরে ফুটে যেত, বা পোশাক ভেদ করে দৃষ্টিকটু হয়ে শজারুর মতো খাড়া হয়ে থাকত।
দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফ্যাশনের নামে মেয়েরা সহ্য করে এসেছে যে যন্ত্রণা, মেরীর এই ব্রেসিয়ার আবিষ্কার তা থেকে তাদের মুক্ত করে। দিনে দিনে মেরীর অন্তর্বাসের চাহিদা বাড়তে থাকলেও মেরী এই ব্যবসা চালাতে পারেননি, তিনি তো ব্যবসায়ী ছিলেন না! ভাবলে অবাক লাগে, মাত্র পনেরশো ডলারে তিনি তাঁর পেটেন্ট বিক্রী করে দেন ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নামে এক কোম্পানীকে। এরা কিন্তু সিনেমা বানানোর ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নয়। পরবর্তী তিরিশ বছরে এই কোম্পানী দেড় কোটি ডলারের বাণিজ্য করে শুধু এই বক্ষবন্ধনীরই। ১৯১৭ সালে পুরনো কর্সেট ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছরে প্রায় আঠাশ হাজার টন ষ্টীল অন্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পায়।
ঊনিশশো তেরো সালের আগে, তার মানে ব্রা-ফ্রা ছিল না। সে জন্যেই কি কবিরা উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতে পারতেন? রবি ঠাকুরের ঠিক তেরো সালেই নোবেল পাওয়ার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ আছে কিনা, এই নিয়ে একটা থীসিস করা যেতে পারে না? এনিবডি ইন্টারেস্টেড?
দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা -- সব চলে গেল। এ বারের মতো পুজোর সীজ্ন্ শেষ। তেরোর গেরোয় আটকে থাকা বছরের বাকি ক’টা দিন একই রকম উৎসবমুখরিত থাকুক আপনাদের জীবন, অন্তরে শক্তি থাক, পাতে সুখাদ্য থাক, মুখে থাক অনাবিল হাসি, এই কামনা করেই আজ ছুটি নিচ্ছি।
(৫) তেরো-স্পর্শ
বছরটা শেষ হতে চললো।
এই জাস্ট সেদিন ধূপধুনো দিয়ে বরণ করলাম বছরটাকে, এর মধ্যে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চোদ্দ শাক খেয়ে এর চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ফেলা হলো। আর কদিন পড়েই হুড়মুড়িয়ে দু’হাজার চোদ্দ এসে পড়বে।
এলে আর ঠ্যাকাচ্ছে কে! গোরারা তো চায়ই যে, এ বছর জলদি ফুটুক, তেরো নাকি অশুভ। তেরোস্পর্শেই – মানে সংস্কিতোয় আমরা যে বলি ত্র্যহস্পর্শ, তাতেই – নাকি ওদের দেশের হাতে হেরিকেন, মানে ক্যাটরিনা-ফ্যাটরিনা টাইপের বিভিন্ন সেক্সি সেক্সি নামের ঝড়-ঝঞ্ঝ্বা। মারী ও মড়ক নিয়ে আমরা ঘর করছি আজীবন, আমাদের এসবে কিস্যু এসে যায় না। একটু মাড়ি-টাড়ি ফোলে হয়তো, অথবা পুরনো মোড়াটা মড়মড় করে ভেঙে যায়। মুড়ি-মুড়কির দাম বাড়ে। সিন্দুকের মধ্যের কালেকশনের মোড়ক খুলে মিরাকুলাসলি দেখা যায় মর্মরমূর্তি হাপিস, কে ঝেড়ে দিয়েছে! মারোয়াড়ির হাতে বিকিয়ে যায় রূপোর মরিচদান।
মান্না দে চলে গেলেন। একে একে নিভিছে দেউটি! এটা অবশ্য একটু বিশেষ যাওয়া, প্রবাসে দৈবের বশের মতো। বহুদিন ধরে ভুগছিলেন, বয়সও হয়েছিল, স্রেফ এত বছর বেঁচে থাকার জন্যে মোরারজী দেশাইকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিরা অতিরিক্ত পরিমাণে মিষ্টি আর তেলেভাজা খায় বলে এত বছর বাঁচে না, ব্যতিক্রম জ্যোতিবাবু। অবশ্য জ্যোতিবাবু পদবীতে বসু হলেও সঙ্গে একটা সরকার ছিল, দরকারে কাজে লাগতো। মান্না দে’র শুধুই দে, তাই দিয়েই গেলেন, বদলে পেলেন না তেমন কিছু। ব্যাঙ্গালোরের এক হাসপাতালে বেশ ক’মাস চিকিৎসা হবার পর আর টানতে পারলেন না মান্না। কাগজে বেরলো, তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা নাকি অমানুষ, তাঁকে দেখতোও না। শেষযাত্রায় জনা কুড়ি লোক ছিল, মূলত অবাঙালি। এর চেয়ে তার দল থেকে সাস্পেন্ডেড কুণাল যে কোনো রাস্তার মোড়ে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে কলকাতায় বেশি লোক হবে, অটোয়ালারা অন্তত খানিকক্ষণ প্যাসেঞ্জার না নিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবে। কর্ণাটক সরকার ঘোষণা করল, হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দেবে। বাস, ফুঁসে উঠলো বাঙালি! আমাদের লোক মলো, আর বিল দেবে ওরা! কেন, আমাদের কি মান-ইজ্জত বলে কিছুই নেই?
আছে, ঐ ধুয়েই তো খাচ্চি! তবে সিন্দুকে ট্যাকা আছে কিনা সন্দেহ। যাতে কিছু পুঁজি জমা পড়ে, তার জন্যে সিগারেট-বিড়িতে ঝেড়ে ট্যাক্স বসিয়ে জনগণকে বেশি করে ফোঁকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাতেও কাজ বিশেষ হচ্ছে না বোধ হয়, এখন শুনছি মালের দোকান দিনরাত্তির খোলা, যাতে গ্যাসে কাজ না হলে অন্ততঃ লিকুইডে পুষিয়ে নেওয়া যায়। তো সেই পয়সায় মান্না দে’র চিকিচ্ছের বিল মেটানোটা কি খুব ভালো দেখাতো?
মরদেহ কলকাতায় উড়িয়ে নিয়ে আসার কথাও হয়েছিল, সম্ভবত শেষ কাজ হয়ে যাওয়ার পর! বেঁচে থাকতে যারা খোঁজ নেয় নি কখনো, তারা সদলবলে নেতৃত্বের নিন্দে করতে লাগল। মান্না দে মরিয়া প্রমাণ করিলেন, বাঙালি একই আছে। শুধু তাঁর গুণমুগ্ধ কয়েকজন, যারা তাঁর স্বর্ণকণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ ছিল, তাঁর গানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল ভালোবাসার সংজ্ঞা, তাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নীরবে গুমরে কাঁদতে লাগল নিশুতি রাত।
তেরোর সবই যে কান্নাকাটির নয়, তার জন্যে একশো বছর পেছিয়ে গেলেই বোঝা যাবে। আমাদের কলকাতার লোক, বাংলায় পদ্য ফদ্য লিখতো, হুট করে কী মাথায় চাপলো, তার থেকে মাত্র শ’খানেকের ইংরাজি ট্রানস্লেশন করে ফেললো, আর তার জন্যে নধর একটা নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেল। ঊনিশশো তেরো সালের কথা। মাংসভাতের লোভ দেখিয়ে লরি বোঝাই জনমজুর জুটিয়ে এনে ব্রিগেডে মিটিং করে বা যাদের মা বেঁচে নেই তাদের মাওবাদী ঘোষণা করে জেনেরালি নোবেল প্রাইজ পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, পাঁচ পাঁচ রকম ব্যাপারে নোবেল দেওয়া হয়, লেখালিখি তার একটা, তার আগে এশিয়া থেকে সেই পাঁচ রকমের কোনোটার জন্যেই কেউ নোবেল প্রাইজ পায়নি। দারুণ ক্যালির ব্যাপার, তবে ক্যালকাটার লোক হলেও কালীপুজো করত না সেই দাড়িওলা বাহান্ন বছরের বুড়ো। অতগুলো টাকা পেল, কোথায় সারদার মতো চিটফান্ডে হেবি রিটার্ণের জন্যে ইনভেস্ট করবে, তা না পুরো টাকাটা ঢেলে দিল এক ইস্কুল বানাতে! বাঙালিকে শিক্ষিত করবে!
যেমন কম্মো, তেমন ফল। সেই মেডেল ঝেড়ে দিয়েছে কোনো এক বঙ্গসন্তান। হোম মিনিস্ট্রি হকার টকারদের ওপর হম্বিতম্বি করে ওদের ক্যাডার বানিয়ে ফেলেছে, তবে সেই মেডেল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বুড়োটা ‘সহজপাঠ’ বলে বাচ্চাদের জন্যে বই লিখেছিল। বাচ্চারা পড়তো টড়তো। তবে রাজ্যের অভিভাবকরা বললো, না না, এ অতিশয় কঠিন। পুরনো ধ্যানধারণা পালটে বরং আধুনিক কবিদের পদ্য ঢোকানো হোক। দাড়িওলা কবি কি আমাদের দলে শর্ট পড়েছে? এর ইনডিরেক্ট এফেক্টে ইয়াং সুকান্তও চলে গেল মায়ের ভোগে। বেচারী নিজে বিয়ে করার আগেই ‘স্বর্গে’ চলে গেল, কিন্তু এমন ভাইপো রেখে গেল, যে এখন পুন্নিমের চাঁদকে নিয়ে কিছু বললে হাজতবাস হতে পারে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বলে এক ভদ্রলোক, যাঁর ছিল ছাপাখানার ব্যবসা, তিনিও সেই ঊনিশশো তেরো সালেই ‘সন্দেশ’ বলে এক পত্রিকা বের করে বসলেন। টুনটুনির গল্প, ছেলেদের রামায়ণ-মহাভারত এইসব লিখে তিনি বাচ্চাদের মনোরঞ্জন করছিলেন। ছেলে সুকুমারকে লন্ডনে পাঠিয়ে বললেন, যা, ছাপাখানার লেটেস্ট টেকনোলজি শিখে আয়! ছেলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ডবল ডিগ্রীধারী। দেশে ফিরে ‘সন্দেশ’ হাতে পেয়ে সেও বাচ্চাদের জন্যে পদ্য-গদ্য লিখে হাত মকশো করা শুরু করে দিল। ‘আবোল তাবোল’, ‘খাই খাই’, ‘পাগলা দাশু’, ‘অবাক জলপান’ – এইসব যা যা সে লিখে গেছে, তা এই একশো বছরেও আর কেউ পারেনি। আমসত্ত্ব-দুধ-কদলী ছাড়াই সেই সন্দেশ চেটেপুটে শেষ করত বাচ্চারা, পিঁপড়ের জন্যে কিস্যু ফেলে রাখত না।
সেই ঊনিশশো তেরো সালেই টাঙ্গাইলের সরকারবাড়িতে প্রতুল বলে এক ছেলে জন্মালো। দেশ চালাচ্ছে বিদেশী সরকার, কিন্তু মা ষষ্ঠীর কৃপায় বঙ্গসন্তানের সংখ্যা কোনো সময়েই অপ্রতুল নয়। বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে ইংরেজদের তাঁবেদারি করতে পারলে ভবিষ্যত গুছিয়ে নেওয়া যেখানে সহজ, সেখানে যেন কোনো এক দৈব ম্যাজিকেই এই প্রতুলের বড় হয়ে শখ হলো ম্যাজিক শেখার। দুনিয়াকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ম্যাজিক দেখিয়ে গেল সে। যাবার আগে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়ে গেল তার আশ্চর্য জগতের যাদুকাঠি।
বাংলার তখন বেশ জটিল পরিস্থিতি। কার্জনসাহেব আট বছর আগে বাংলাকে কাৎলা মাছের মতো কেটে দু-টুকরো করে মুড়ো-ল্যাজায় দ্বন্দ্ব বাধিয়ে ডিভাইড অ্যান্ড রুল চালু করেছেন, যার উত্তরে বাংলা উঠেছে গর্জে। অরবিন্দের নেতৃত্বে বাংলায় বোমা বানানো হচ্ছে ইংরেজদের মেরে তাড়ানোর জন্যে। ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’র ব্যানারে অরবিন্দের সাথে আছেন ভাই বারীন, বাঘা যতীনের মতো বাঘের বাচ্চারা। ভুল জায়গায় বোমা মেরে শহীদ হলো প্রফুল্ল, ফাঁসিতে চড়ানো হলো ষোল বছরের ক্ষুদিরামকে। সারা বাংলার আকাশে বাতাসে ভাসতে লাগলো মর্মস্পর্শী গান – ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’।
ছ’বছর পর কাটা বাংলা জোড়া লাগাতে বাধ্য হলো ইংরেজ, কিন্তু রাজধানী কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে গেল দিল্লী। ভাবলো, দিল্লী দূর হ্যায়! সেই ঊনিশশো তেরোতেই ঊড়িষ্যার কটকের র্যাভেনশ’ কলেজ থেকে ম্যাট্রিকে সেকেন্ড হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সীতে পড়তে এলো এক সুদর্শন যুবক। সেখানে ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন ভারতীয়দের নিয়ে ভুলভাল মন্তব্য করায় তাকে এমন শিক্ষা দিল যে, তিনি ওঠেন কি বসেন, বুঝতে পারলেন না। ভারতের পরবর্তী ইতিহাসের অনেকটা এই ছেলে সুভাষের নিজের কীর্তি। দিল্লী চলো ডাক দিয়েছিল সে, সেখানে পৌঁছাতে পারলে আজ দেশের হাল অন্যরকম হতো।
দেশের অন্যপ্রান্তেও সেই তেরো সালে বিচিত্র ঘটনা ঘটছিলো। মহীশূরের উপকণ্ঠে ধারোয়ার ও হুবলি দুই পাশাপাশি শহর, যমজ ভাইয়ের মতো। চিক্কুরাও নাদিগার নামে এক ভদ্রলোক, তাঁর বাড়ি ধারোয়ারে, চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্ত্রী অম্বাবাঈ ভালোবাসেন গান, কর্ণাটকী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত। দুর্ভাগ্য তাঁর, যে পরিবারে অম্বা-র জন্ম হয়েছিল, সমাজের চোখে সেটা নিচু জাত, তাদের গান গাওয়ারই অধিকার নেই, স্টেজে পরিবেশন তো দূরের কথা। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন অম্বাবাঈ, সাধনা করে যান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। হয়তো এমন দিন আসবে, যখন এই নিষ্ঠুর জাতপাতপ্রথা দূর হয়ে যাবে। তাঁর নিজের জীবিতকালে না হলেও, হয়তো পরবর্তী প্রজন্মে।
ঊনিশশো তেরো সালে তাঁর কোল আলো করে এলো এক কন্যাসন্তান, চিক্কুরাও তার নাম রাখলেন গাঙ্গুবাঈ। পরে সারা ভারত তাঁর ক্লাসিকাল গানের যাদুতে মুগ্ধ হলো।
আমাদের দেশে গান শুনলেই এখন লোকে বলে, কোন্ সিনেমার? তো সেই তেরো সালেই ভারতের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি রিলীজ হলো সিনেমাহলে, তার নাম ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, পরিচালক দাদাসাহেব ফালকে। এ ছবিটি ছিল অ-বাক্। ভারতীয় ছবিতে সংলাপ শুরু হওয়া আরো পরের ঘটনা, কিন্তু সেই যুগে পরাধীন ভারতে এটাও এক অবাক কাণ্ডই বটে। আর সেই চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপাতে সেই তেরো সালেই রাওয়ালপিণ্ডি শহরে এক পাঞ্জাবী ক্ষত্রি পরিবারে জন্ম হলো যুধিষ্ঠির সাহনির, আমরা যাঁকে পরে চিনলাম বলরাজ নামে। আর মুম্বইয়ের শহরতলিতে কাপড়ের কলে চাকরি করা আভাজী পালব-এর ঘরে জন্মালেন ভগবান, ক্রমে তিনি হয়ে গেলেন ভগবান দাদা।
মরেচে! রম্যরচনা লেখার কথা, এটা হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস। তার ওপর গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গল ছাড়া এতে আর কোনো মহিলার নাম নেই। ইতিহাস কি শুধু পুরুষের তৈরি এক ইমারত, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিগত দিনের শত শত ভুল?
ঊনিশশো তেরো সালের এক মহিলার কীর্তি দিয়ে শেষ করি এই সংখ্যার চারানা আটানা। সেই বছরের শেষের দিকে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এক তরুণী মেরী ফেল্প্স্ জেকব আবিষ্কার করলেন মহিলাদের প্রথম আধুনিক বক্ষবন্ধনী। তাঁর করা নতুন ডিজাইনের পেটেন্টও নিলেন তিনি। এর আগে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের ঊর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস হিসাবে ব্যবহৃত পোশাক ছিল কর্সেট, তা শুরু করেছিলেন ফরাসী রাজা দ্বিতীয় হেনরির পত্নী রাণী ক্যাথেরিন। মেয়েদের সৌন্দর্য বলতে বোঝানো হতো আওয়ারগ্লাস ফিগার অর্থাৎ ভারী বক্ষ ও নিতম্ব, মধ্যে সরু কোমর, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্সের সেই ছত্রিশ-চব্বিশ-ছত্রিশ। ক্যাথেরিনের তাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের সরু কোমর বীভৎসভাবে আঁটসাঁট করে রাখা। তাঁর ডিজাইনের কর্সেটে ব্যবহৃত হতো তিমিমাছের কাঁটা অথবা ধাতব সরু রড, যেগুলো দিয়ে কোমরের কাছটা টাইট করে রাখা হতো। মাঝে মাঝেই সেগুলো হয় শরীরে ফুটে যেত, বা পোশাক ভেদ করে দৃষ্টিকটু হয়ে শজারুর মতো খাড়া হয়ে থাকত।
দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফ্যাশনের নামে মেয়েরা সহ্য করে এসেছে যে যন্ত্রণা, মেরীর এই ব্রেসিয়ার আবিষ্কার তা থেকে তাদের মুক্ত করে। দিনে দিনে মেরীর অন্তর্বাসের চাহিদা বাড়তে থাকলেও মেরী এই ব্যবসা চালাতে পারেননি, তিনি তো ব্যবসায়ী ছিলেন না! ভাবলে অবাক লাগে, মাত্র পনেরশো ডলারে তিনি তাঁর পেটেন্ট বিক্রী করে দেন ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নামে এক কোম্পানীকে। এরা কিন্তু সিনেমা বানানোর ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নয়। পরবর্তী তিরিশ বছরে এই কোম্পানী দেড় কোটি ডলারের বাণিজ্য করে শুধু এই বক্ষবন্ধনীরই। ১৯১৭ সালে পুরনো কর্সেট ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছরে প্রায় আঠাশ হাজার টন ষ্টীল অন্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পায়।
ঊনিশশো তেরো সালের আগে, তার মানে ব্রা-ফ্রা ছিল না। সে জন্যেই কি কবিরা উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতে পারতেন? রবি ঠাকুরের ঠিক তেরো সালেই নোবেল পাওয়ার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ আছে কিনা, এই নিয়ে একটা থীসিস করা যেতে পারে না? এনিবডি ইন্টারেস্টেড?
দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা -- সব চলে গেল। এ বারের মতো পুজোর সীজ্ন্ শেষ। তেরোর গেরোয় আটকে থাকা বছরের বাকি ক’টা দিন একই রকম উৎসবমুখরিত থাকুক আপনাদের জীবন, অন্তরে শক্তি থাক, পাতে সুখাদ্য থাক, মুখে থাক অনাবিল হাসি, এই কামনা করেই আজ ছুটি নিচ্ছি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন