কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

সুপর্ণা বসু

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৪১


ইজেল

 

খোলা-জানালার বাইরে স্তব্ধ-রাতের দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল নিশা। খানিকটা দূরে একটা মোবাইল টাওয়ারে আবার নতুন করে সবুজআলো জ্বলে উঠেছে। যেভাবে বহুবছর পরে দীপাঞ্জনের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হলো নিশার! যেভাবে রাতের আঁচলে তারার ঘড়া উপুড় করে দিয়েছে আকাশ, সেভাবেই দীপাঞ্জনও এত বছরের জমানো আকুলতা ঢেলে দিয়েছিল নিশার ওপর। সেই ছোট্টবেলার প্রেম। ভালোবাসতে বাসতে ক্রমশ  বড় হয়ে ওঠা। সব প্রেমের গন্তব্যই বিবাহ নয়। কোন কোন প্রেম পদ্মপাতায় জলের মতো আজীবন টলটল করে। মনে হয় এই বুঝি ঝরে গেল, এই বুঝি নেই হয়ে গেল!

বাঙালিরা বাড়ির শ‍্যামলা মেয়েটির নাম রাখে নিশা, তামসী অথবা রাত্রি। তারপর প্রতিদিন তাকে চলতে ফিরতে বোঝাতে থাকে তুমি তেমন সুন্দর নও। বুদ্ধিতে যতই জৌলুস থাক, পহলে দর্শনধারী পিছে গুণবিচারী! মেয়েরা কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেয়, কেউ হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। নিশা দ্বিতীয় দলের মেয়ে।

দীর্ঘাঙ্গী নিশা। তাজা দুর্বার মতই উজ্জ্বল তার গায়ের-রং। সুললিত কন্ঠে অফুরন্ত সংগীত। খুব ছোটোবয়স থেকে বড় ওস্তাদজীর কাছে তালিম নিয়েছে। বিয়ের পরে কয়েকটাবছর সেই গানই কন্ঠ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। বলা হয়, দুঃখ হতেই নাকি গানের জন্ম। অথচ নিশা নিজের জীবন দিয়ে দেখেছে, দুখের ভিতর  গান বাঁচতে পারে না। মরে যায়। একসময় গলা দিয়ে আর সুর বেরোয় না। গানের বাণী একলা বসে থাকে। শেষে সংগীতহীন বিবাহ-জীবন থেকে বেরিয়ে আসে নিশা। প্রাণের অতল থেকে খুঁড়ে বার করে সুরের ফোয়ারা। একলা জীবনেই ছন্দ ফিরে পায়। অজস্র গানের অনুষ্ঠান। মানিকতলার শ্বশুরবাড়ি থেকে লেকরোডের নিজস্ব আবাসন।

প্রতিদিন ভোবেলায় জানলা খুলে ভারি পর্দাগুলো সরিয়ে দেয় নিশা। এখন ভরাদুপুরে রোদের আভায় ঘর আলোকিত। চাঁপারঙের দেয়াল চোখকে আরাম দেয়। ঘরে বেশি ফার্ণিচার না থাকায় দৃষ্টি বাধা পায় না। এই এলাকাটা অভিজাত। খোলা জানলা দিয়ে পাশাপাশি যেসব ফ্ল‍্যাট দেখা যাচ্ছে সেগুলিও দৃষ্টিনন্দন। সকাল বিকেল হাঁটতে বেরিয়ে যাদের সঙ্গে দেখা হয় তারাও মার্জিত।

নিশার শোবারঘরের জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল‍্যাটের ডাইনিং দেখা যায়। কাঁচের দরজাটা খোলা এবং পর্দা সরানো থাকে। দুজন প্রৌঢ় নারীপুরুষ দুবেলা আলাদা-আলাদা সময়ে খেতে বসেন। ওঁরা কি দম্পতি? সারাদিন রাত কেবল এসির শব্দ শোনা যায়। শব্দ বলতে সেটুকুই।

মাঝবয়সের জীবন মাঝসমুদ্রের মতই নিস্তরঙ্গ। নিশাও ক্রমশ সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। জীবন নামক জাহাজের পালের মাথায় একাকী সীগালের মত বসে থাকা। সূর্যের তপ্তআলো বারান্দার মেঝেয় গ্রীলের নকশা আঁকে। যেভাবে ক্লায়েন্টের নগ্ন ত্বকের ওপর বিবিধ ট‍্যাটু এঁকে দেয় দীপাঞ্জন। চিত্রকরের ক‍্যানভাসের মতই মানুষের এই জীবন। দিন যাপনের কাঠামোটিই যেন ইজেল। সেই তো টানটান করে ধরে রাখে সমস্ত শিল্পকর্মকে। সমাজ নির্ধারিত নিয়মের বাইরে গেলেই কুঁচকে যায়। ঝুঁকে পড়ে।

নিশার একার সংসারে দীপাঞ্জন ইচ্ছেমত আসে যায়। তাকে কোনো সম্পর্কের শীলমোহরে বাঁধতে ইচ্ছে করে না নিশার। নিশা গুনগুন করে বৃন্দাবনী সারং গাইতে গাইতে টবেরগাছে জল দেয় আর ভাবে, আজ কি দীপাঞ্জন আসবে?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন