কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি : আমাদের বিনোদ

 


প্রতি,

অভিনেতা অ –এ শেখান হয় না। বিশেষত ছোট থেকে এর কোন ক্লাস হয় না ইস্কুলে। বিশেষত এর কোন বই হয় না। পাড়ায় পাড়ায় যেভাবে নাচ গান আঁকা ব্যায়াম শেখার স্কুল হয় – তেমন নাটক শেখার হয় কই? এই আপ-শো-শ মেনে নিয়েই নাটক করতে আসিয়েদের ভিড়। শহরময় উৎসবের গন্ধ। কিছুমিছু নাট্য উৎসব করা এখন সংস্কৃতি-দুরন্ত ফ্যাশান। পাড়ায় পাড়ায় তাই নাট্যমেলা। চিৎকার করে ওঠে তারই মধ্যে গাড়ির চেনা হর্ন। আশপাশের মুঠোফোনের বাদ্যি। এরই মধ্যে কার কত সাধ্যি যে থিয়েটার থিয়েটার করে আর খেলে… তা সে যাইহোক ফিরছিলাম একদার ওই পাড়া দিয়ে। ওই পাড়া যার এদিকে গঙ্গা ওদিকে ইয়া বড় রাস্তা। মধ্যিখানে ওদের ঘরগুলো...। তার এপাশে একটা হাতিবাগান, স্টার থেকে বিনোদিনী থিয়েটার হয়ে গেলে জাতির সংস্কৃতি বুঝি ধ্বজা উড়িয়ে যেতে পারে। বিনোদিনী ওরফে পুঁটি ওরফে বিনোদ ওরফে যদি আজ থাকতেন, তবে? এই রঙ্গ-তামাশার স্টার - বিনোদিনী থিয়েটার, স্বকৃতই ছিল যা, তার নাম পালটে গেলে ওঁর নামে, উনি নিতেন? মানে, আরেকটা প্রতিবাদ বুঝি বা করতেন। এই আহায় আমি এই লেখা লিখতে পারলাম।

এই লেখা এক বিনোদিনীর। অন্য এক বিনোদিনীর, তাঁর যেমন জীবন তেমনই বুঝি নাটক। একটা বই পড়ছি... বিনোদিনী দাসীর লেখা, ওই একটাই বই যিনি লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি তো বই লেখেননি, লিখেছিলেন নিজের কথা, না-বলা কথাগুলো। তিনি তথাকথিত বা প্রচলিত শিক্ষাধারায় পড়ুয়া নন। নন যে, সেকথা জানি। কেননা, তাঁকে নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি গাল-গল্পও চলিত। তিনি স্টার। তাঁর নামে তো হয়নি রঙ্গালয়, কিন্তু তাঁর শরীরী-মূল্যে হয়েছিল। বোধহয় বিনোদিনীর জন্ম-বেত্তান্তে ওই এলাকার মেয়ে হয়োর খুঁতটুকু ছিল বলেই... তাকে নিজের মূল্যে একটা মঞ্চ গড়ে দিতে হয়েছিল।

 

তা বলে, সেখানে থিয়েটার করতে যেতে আটকায়নি থিয়েটারের শিক্ষিত ইতিহাসে নামকরা ভদ্দরলোক-বাবুদের। সে থিয়েটার আজ আর নেই। একদিন পুড়ল-ভাঙল-আবারও এক বেনিয়ার হাতে গড়ল। সেদিনই নাটকের বিনোদিনীও আরেকবার যেন বিক্রি হল। বেনিয়ার হাতে সংস্কৃতি কিছুটা জল পায়, কিন্তু সে জলে নুনভাবটা থাকে। সেসব তো পক্ষপাত দোষে আরেকটা মেয়েরই কথা, গবেষকের কথা হয়ত নয়। কিন্তু, সে কথায় পরে  আসছি। আরম্ভে নাটকের কথা না-পড়লেই নয়।

যে কথা আলোচ্য জীবন আর নাটকে মেয়ে-চরিত্র অপরিহার্য। জীবনে মেয়েদের এত বেশি করে পাওয়া  যেত, সেসময়ে যে কুলীন-ধর্মই হয়ে উঠেছিল অসম-বিয়ে।

বিয়ে তো তবুও ভাল। কিন্তু, ভাল আর থাকে না, যখন ওই বাহাত্তুরে বুড়োর সঙ্গে বে হওয়ার দিন-মাস না পেরোতেই বিধবা।

বিধবার একাদশী- সেও তো চোখের জল ফেলার চেয়ে মস্ত কোনও সোজা কাজ নয়।

যেমন, পাত্রের বয়স সত্তর হলে পাত্রী সাতও হতে পারত।আবার, পাত্র-পাত্রীর অসম সম্পর্কের বিয়ে মানে এক পুরুষের বহু বিয়ে।

কুলীন-ধর্ম মেনে নিয়ে জাতে-ধর্মে-বর্ণে মিল পাওয়া যোগ্য নাহোক, অযোগ্য পুরুষ নিয়েই চলছিল একরকম।

গলায় দড়ি, বিষ খেয়ে না-মরা অথচ সমাজে লাঞ্ছিত, সেই মেয়েদের মধ্যে জীবনের অন্য এক বাঁচা হয়ে এল নাটক।

তো লাগে। সেই শিশুদের আবার যাদের মায়েদের পরিচয় একটা নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ। তাদের জীবন-পরিধিও এলাকার বাইরে নেই প্রায়। তো, সেই এলাকার মেয়েদের কি যে মাথার চাপল, একজনকে দেখে অন্যজন ক্রমে আরেকজন এসে শুরু করল থেটারে অভিনয়। জীবনের ছেনাল-বারাঙ্গনা-প্রজাতির  মেয়েগুলোর দিন কাটল রিহার্সালে। আর মঞ্চের আলোয় পাঠ বলে, হাততালি কুড়িয়ে।

কিন্তু, এই দশকে দাঁড়িয়ে এ নিয়ে লেখা যত সোজা হচ্ছে, এ দশকের মেয়েদের কিন্তু থিয়েটার করতে থাকাটা এত সোজা নয়। থিয়েটার পেটের ভাত দিল প্রথম যে মেয়েটাকে, তার বয়স ছিল সাত-আট-নয় বা ওরকমই। আর যাদের জন্মের ঠিকানা নেই, তাদের বয়স গুণে লাভ কি। শুধু দেখার যে, তারা থিয়েটারে এল। একদল নিয়ে এলেন, মানে আসার পক্ষে তোড়জোড় এবং সওয়াল করলেন। অপরদল বিপক্ষে, অবশ্যই এসব কুলটা-কামিনীদের মেয়েদের সঙ্গে অভিনয় করতে করতে যদি সত্যিই মাথা ঘুরে যায়? কোনও কোনও বাবুদের ঘুরতও। আবার সেইদিক থেকে ঘুরে ফিরে যেতেও সময় লাগত না। সমাজের এই ধরনের ধাঁধায় জন্মান মেয়েদেরই নাক কুঁচকে বলা হয় ওরা ওই পাড়ার মেয়ে...।

গবেষক দেবযানী কর তাঁর বইয়ে লিখেছেন যেসব পাড়ার কথা, সেসব পাড়া কলকাতার ভূগোলে রয়েছে আজও। তা থাক, দুঃখ নেই, গবেষণা না করেও সেকথা বলা যায়। বাসে-ট্রামে চড়া কলকাতার সাধারণ নাগরিকের চোখ, যে সিগনালে গাড়ি দাঁড়ালেই চোখ ঠেরে ফেলে, সেই পাড়াগুলো থুড়ি মেয়েগুলোই হল- ওই ওরা।

ওদের পোশাক ওদের চামসে খুপরিতে বাস নিয়ে আলোচনা নয়। আলোচনা নয় ওদের জন্ম-বেত্তান্ত নিয়েও। তবুও ওরা... ওরা ওই পাড়ার মেয়েরা যে কি করে ভদ্দরলোকেদের লেখার বিষয়, আলোচনার বিষয়! কেননা অফুরান কৌতূহল, জনপ্রতি কুৎসা-কাহিনি আর ওদের প্রতি লোভ। জননী-মেয়ে থাকলেও,  যাদের পরিবার জনক-শূন্য, তারাই হল গিয়ে থেটারের মেয়ে।

এরকম মেয়েরা একদিন সমাজ-সংস্কারকদের হাতিয়ার হয়ে এসেছিল থিয়েটার বা নাটক করতে। নাটক ওদের দিয়েছিল বাঁচার মতন জীবন। দু-বেলা ভাত নাহোক, ততটা পপুলারিটি নাহোক, একটা পপুলার আর্ট ফর্মে বেঁচে থাকার অমরত্ব কম কথা নয়। কম নয় বলেই, আজকের গবেষণারও বিষয় ওরা। ওরা, মেয়েরা, পড়াশোনা না-জানা হতশ্রী কেউ কেউ বা দিব্যশ্রী, কেউবা হা-ভাতে কেউ বা পরিবারের শত্রুতায়- এক নিষেধের করিডোরে দাঁড়ান। যেখান থেকে ওরা সকলকেই দেখতে পায়, বা সকলে ওদেরকে নিবিদ্ধবাসী পতিতা বলে তাকায়।

হঠাৎ, সংস্কৃতির কথা বলতে হলে... ওদের মধ্যে থিয়েটারের বীজ ছড়িয়ে একটু ফসল উঠলেই, আহা উন্নতি বলা যায়। আর বলা যায় ... ২০২৫ সালে বিনোদিনী নামে থিয়েটার হল না, হলো একটা সিনেমা হল ... ওগো বিনোদিনী তুমি থেটার ছেড়ে সিনেমায়?

বুঝি বুঝি বুঝি শতবর্ষ যে তাই ... এখন তুমি বাংলার সংস্কৃতির ঝুড়ি মাথায় করে বইবে থিয়েটারের জন্যে...

ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী…

 

 

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. বেশ যুক্তিযুক্ত আলোচনা। সমাজকে বাদ দিয়ে তো আর সমাজের দর্পণ সম্পর্কে প্রতিবেদন সম্ভব নয়।
    বিনোদিনীকে সম্মান জানিয়ে অনেক আগেই ডানকুনিতে "বিনোদিনী নাট্য মন্দির" নির্মাণ হয়েছে এবং এখনও রয়েছে।

    উত্তরমুছুন