কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

শতরূপা সান্যাল

 

সমকালীন ছোটগল্প


সুযোগ

লিলি যখন প্রথম অভিনয় করতে এসেছিল, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কাউকেই বিশেষ চিনতে না। প্রথমত অভিনয় করার কোন পরিকল্পনা ওর ছিল না। তাছাড়া ওর পরিবারের কেউ কস্মিন কালেও টালিগঞ্জের ধারেপাশে যায়নি। লিলিদের কলেজে একটা নাটক প্রতিযোগিতায় লিলিদের নাটক ফার্স্ট হয়েছিল। বিচারকমন্ডলীতে ছিলেন বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টর সম্রাট চক্রবর্তী। তাঁরই একটা সিনেমায় লিলির সুযোগ হয়েছিল মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার। সেই সিনেমায় প্রায় প্রত‍্যেকেই নাটকের অভিনেতা ছিলেন এবং তাদের অনেকেরই সিনেমার পর্দায় প্রথম কাজ ছিল ওটা।

এখন  লিলি প্রতিষ্ঠিত নায়িকা। নিজের বড় গাড়ি থেকে যখন দামি পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে, লাখ টাকা দামের পোষাক পরে সে কোনো অনুষ্ঠানে এসে নামে, মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় তাকে কাছে থেকে একটিবার চোখের দেখা দেখার জন্য। লিলি এটা বেশ উপভোগ করে। জনপ্রিয়তা একটা নেশার মত ব‍্যাপার।

সেদিন একটা শপিং মলের ভিতর একটা বড় ব্র‍্যান্ডের ঘড়ির বিপনী উদ্বোধন করার প্রোগ্রাম ছিল। নিজের ঘরের প্রকান্ড আয়নার সামনে প্রস্তুত হচ্ছিল লিলি। কেশসজ্জা করার জন্য তার নিজস্ব হেয়ার ড্রেসার আছে। মাধবী। মাধবী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আরো অনেকেরই কেশসজ্জা করে।

সে যথারীতি কেশসজ্জা করার জন‍্য তপ্ত স্ট্রেটনার দিয়ে টেনে টেনে লিলির চুলগুলোকে বাগে আনছিল আর টালিগঞ্জের অন্য যত নায়িকাদের ঘরে তার যাতায়াত, তাদের হাঁড়ির খবর উগরে দিচ্ছি। লিলি কিছু শুনছিল, কিছু শুনছিল না। বস্তত, পরনিন্দা পরচর্চা লিলির পছন্দ নয়। কিন্তু এই পেশায় জনান্তিকে কতজন যে পরচর্চার বিশেষজ্ঞ হয়ে বসে আছে, তাদের সংখ্যা অগুনতি! সকলেই একেকজন রয়টার বা  পিটিআই।

হঠাৎ লিলির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতে লিলি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ফোনটায় তুহিন অ‍্যাক্টর নাম ভেসে উঠেছে। লিলি খানিক মনে করার চেষ্টা করল, কে এই তুহিন? নাম যখন সেভ করা আছে, নিশ্চয়ই পরিচিত।  কিন্তু এই নামে কোন অভিনেতার কথা তো তার মনে পড়ছে না!

লিলি ফোনটা ধরতেই অপর প্রান্তে এক ভয়ানক অসুস্থ মানুষের কন্ঠ ভেসে এলো। আমি তুহিন! চিনতে পারছ? তোমার প্রথম সিনেমায় কাজ করেছিলাম… বর্ধমান থেকে আসতাম…!

এক লহমায় লিলির মনে পড়ে গেল - লম্বাটে মুখ, সুগঠিত শরীরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ এক অভিনেতার চেহারাটা। ঐ সিনেমায় সে একটা বখাটে ছেলের চরিত্র করেছিল। তিন চারটে দৃশ্যে ছিল। একটা দৃশ্যে সে লিলিকে বলেছিল – ‘কোথায় চললে সুন্দরী?’ কথাটা বলার সময় সে চোখ মেরেছিল অশ্লীলভাবে। ঐ চোখ মারার দৃশ্যটা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো লিলির। ঐ সিনেমা রিলিজ হওয়ার পর, মাঝে প্রায় দশ এগারো বছর পেরিয়ে গেছে। এখন কোথায় লিলি আর কোথায় বা অনামা অভিনেতা তুহিন!

লিলি বলল - মনে আছে। বলো!

--আমি খুব অসুস্থ, লিলি! কোনো কাজ নেই আজ কতদিন হয়ে গেলো। তার ওপর এই অসুস্থতা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মরিয়া হয়ে তোমায় ফোন করছি। ভাবিনি তুমি ফোনটা ধরবে।

--কী হয়েছে তোমার?

--সরকারি হাসপাতালে হার্ট অপারেশন হয়েছে। এখন শয্যাশায়ী একদম। অভিনয় ছাড়া অন্য কিছু তো  পারি না। অথচ, সিনেমায় আর কাজই পেলাম না। দরজায় দরজায় ঘুরেছি কত… পরিচালক প্রোডিউসার  কাউকেই ধরতে বাকি রাখিনি।

--হুম! আমি তোমায় কী হেল্প করতে পারি? তুমি তো এখন কাজ করতে পারবে না!

--না না, কাজ চাইছি না। বিছানা থেকে উঠতেই তো পারছি না। বলছি, আমায় কিছু টাকা দেবে? যতটুকু পারো, ভিক্ষা চাইছি… আরো অনেকের কাছে ফোন করেছি। বেশিরভাগই ফোন ধরেনি। টালিগঞ্জের কারো কাছ থেকেই কোনো সাহায্য পাইনি, লিলি!

--শিল্পীদের যে অ‍্যাসোসিয়েশন আছে, সেখানে সাহায্য চেয়েছিলে?

--না। …

--লিলি আর কথা বাড়ায় না। তুহিনের ব‍্যাংক ডিটেইলসটা নিয়ে তখনই ফোন থেকে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়। টুং করে একটা মেসেজ ঢোকে - থ‍্যাংকিউ।

মাধবী অনেকক্ষণ বকবক করতে পারেনি। তার পেট ফুলে উঠছিল। লিলির কথা শুনতে শুনতে ফোনের অপর প্রান্তে কে আছে - তা নিয়ে তার কৌতূহল যেন তপ্ত বাষ্পের মত মগজে ঠেলাঠেলি করতে শুরু করেছে। লিলি টাকা পাঠালো দেখে সে আর চুপ থাকতে পারে না। বলে, কে গো দিদি?

লিলি বলে, একজন অ‍্যাক্টর। অসুস্থ। তাই হেল্প চাইছিল।

মাধবীর কৌতূহল ক্রমশ বর্ধমান। সে বলে, কোন অ‍্যাক্টর? চিনি?

লিলি বলে, চিনতেও পারিস। তুহিন দত্ত। তেমন কিছু দরের অভিনেতা নয়। আমার সঙ্গে আমার প্রথম ছবিতে কাজ করেছিল।

মাধবী খানিক চোখ কুঁচকে থেকে বলে, তুহিন দত্ত, মানে তুহিনদা? কালো করে? বর্ধমান থেকে আসত? চিনি তো! আমাদের একজন হেয়ার ড্রেসার মেয়েকে ডাবলাদা, ঐ যে ম‍্যানেজার গো, খারাপ কথা বলেছিল বলে তুহিনদা ডাবলাদাকে কী মার দিয়েছিল! সেই গন্ডগোল মেটাতে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। পুলিশ এসে  উল্টে ডাবলাদাকেই ধরে নিয়ে গেছিল! সেই তুহিনদা?

লিলি বলে, আমি এ সব জানি না রে!

মাধবী তার দুই ব‍্যস্ত হাত ও ততোধিক ব‍্যস্ত মুখ সমানে চালাতে চালাতে বলে, তারপর তো সেই মেয়েটারও কাজ গেলো, তুহিনদাকেও আর কেউ বিশেষ কাজ-টাজ দেয়নি। দুজনকেই পরে আর টালিগঞ্জে দেখতে পাইনি।

লিলি শপিংমলের সেই বিপনীতে যথা সময়ে পৌঁছে গেল। মনের মধ্যে কিসের যেন খচখচানি! তবু, সে সুগন্ধি আঁচল উড়িয়ে, চুল সরিয়ে, সানগ্লাস চোখে মোহিনী হাসি মুখে মেখে প্রকাণ্ড গাড়ি থেকে নামল। চতুর্দিকে ভিড়ে ভিড়। উদ‍্যোক্তারা সুরক্ষিত বেষ্টনী রচনা করে তাকে নিয়ে শপিংমলে ঢুকে গেল। পিছন থেকে জনতার মধ‍্যে বহু উৎসাহী মানুষ চেঁচিয়ে উঠল, ম‍্যাডাম একটু এদিকে… এদিকে…!

লিলি শপিংমলের শেষ ধাপে উঠে পিছন ফিরে, সানগ্লাস চোখ থেকে নামিয়ে, জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে। অজস্র মুখ। কেউ পরিচিত নয়। ভিড়ের পিছনে বাঁ দিকটায় একজন হাত নাড়ছে, চেনা চেনা মনে হয়। লিলি আরেকবার সেদিকটায় তাকায়। একটি লোক অশ্লীলভাবে চোখ মারে। ও কি তুহিন? অ‍্যাক্টর?…

লিলি সানগ্লাসটাকে আবার পরে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়।

 

 


2 কমেন্টস্:

  1. বাস্তব জীবনের এক চমৎকার লেখনী। জীবনের বাঁকে বাঁকে চলার পথে আমাদের প্রত্যেকের বিশেষতঃ বিখ্যাত মানুষদের জীবনের একটু অভিজ্ঞতার অনাস্বাদিত আস্বাদ। মানুষ চেনা আর অসাধারণ প্রকাশে মন খারাপ ভালোর এক দোলাচলে রইলাম।

    উত্তরমুছুন