কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


অমলতাস

 

-মাস্টারমশাই কোথায় চললেন? ওষুধের দোকান তো উল্টোদিকে।

হঠাৎ মনে হল স্বপ্নজগৎ থেকে ফিরলাম যেন। লোকটার পান খাওয়া দাঁত। অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমার মাথার ওপর গনগনে সূর্য। দেখে মনে হচ্ছে অন্তরের বেদনায় ঝলসে যাচ্ছে

-"কী ওষুধ কিনবেন দেখি? আমি এনে দিচ্ছি। আপনি এইখানে দাঁড়ান মাস্টারমশাই।"

আমার উত্তর দেওয়ার আগেই লোকটা হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিল। আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। আমি জানি লোকটা আর ফিরবে না। রোজ এমনই হয়। তবুও সবিতা বাইরে বেরনো থেকে আমায় আটকায় না।

আমি চন্দ্রার জন্য ওষুধ কিনতে বেরোই। চন্দ্রা আমার মেয়ে।

খিদিরপুরের এই অঞ্চলটায় সেই ছোটবেলা থেকে রয়েছে আমি। এখানেই একটা স্কুলে পড়াই। দেশভাগের সময়ে মা আমায় নিয়ে এখানে চলে এসেছিল। বাবা কথা দিয়েছিল, পরে আসবে। বাবাকে না দেখতে পেলে আমি নাকি ভাত খেতে চাইতাম না। সাদা ভাত। বাবাও ভাতের মতোই একটা শুভ্র মানুষ ছিলেন।

শেষদিনও বাবাকে এমন সাদা রংয়ের লাগছিল। বাবা ফিরে এসেছিল। মৃতদেহ হয়ে। বাবার মুখটা আশ্চর্য সাদা লাগছিল। সঙ্গে কান্নাধোয়া ধূপের গন্ধ। বাবারা কি তবে কথা রাখে না কখনোই? তারপর থেকে আমি আর মা এই খিদিরপুর ছেড়ে কোথাও যাইনি। আসলে এই অঞ্চলটাতে মাটির গন্ধ পাই আমি। আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী, স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড, পাপড়িখসা দেওয়াল সবেতেই মাটির গন্ধ।

তারপর আমার জীবনে সবিতা এলো। আমার আর সবিতার মেয়ে চন্দ্রা। আমার একটা ছটফটে, চঞ্চল, প্রাণবন্ত মেয়ের শখ ছিল। ছেলেবেলা থেকেই চন্দ্রা রুগ্ন। খালি ভোগে। আমিও ভুগি। ভেতরে ভেতরে। চন্দ্রার ওষুধ আনতে ভুলে যাই। তবুও চন্দ্রাকে আদর করতাম। চন্দ্রা তাকিয়ে থাকত। ফ্যালফ্যাল করে। চন্দ্রকে দেখতে ঠিক অমলতাস ফুলের মত লাগত। কিন্তু চন্দ্রা কথা বলে না। খেতে চায় না। আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর মাথায় হাত বোলাই। তবে বেশিক্ষণ ওর কাছে বসলেই আমার কান্না পায়। তাই আমি স্কুলেই থাকতাম বেশিরভাগ সময়। আমার স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীদের একেক দিন অমলতাস ফুলের মতো দেখতে লাগত।

সেদিন চন্দ্রা খুব অসুস্থ ছিল। সকাল থেকেই শুকনো, বিবর্ণ ফুলের মত দেখাচ্ছিল ওকে। সবিতা বারবার বারণ করেছিল আমার স্কুলে যেতে। আমি শুনিনি। স্কুলের ওই ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যেই তো আমার চঞ্চল, ছটফটে চন্দ্রাকে খুঁজতাম।

সেদিন স্কুলে বারবার ধূপের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাড়িতে ফিরতেই ধুপের গন্ধটা তীব্র হয়ে উঠল। চন্দ্রা একটা ফুলের বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ বোজা। সবিতা পাথর।

চন্দ্রাকে এরকম সাদা, ফ্যাকাশে ফুলের মত লাগছে কেন! ঠিক যেন আমার বাবা  শুয়ে আছে। আমার হঠাৎ করে মনে পড়ল, আমি ওষুধ আনতে ভুলে গেছি। বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন।

তারপর থেকে আমার আর কারোর সঙ্গে দেখা হয় না। আমি আর সবিতা এক বাড়িতেই থাকি এখনো। তবুও আমাদের দেখা হয় না ‌। তবে চন্দ্রার সঙ্গে এখন আমার রোজ দেখা হয়।

আমি নিয়ম করে প্রতিদিন ওর জন্য ওষুধ আনতে বেরোই। শুধু ওষুধের দোকান পর্যন্ত পৌঁছানো হয় না। আর চন্দ্রার মৃত্যুর পর থেকে অমলতাস ফুল আর দেখতে পাইনি।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন