কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি : রবীন্দ্রনাথ




 

প্রতি

“এবারকার চিঠিতে আপনাকে কেবল 

বাংলার বর্ষাটা স্মরণ করিয়ে দিলুম

আপনি বসে বসে ভাবুন। ভরা পুকুর, আমবাগান,

ভিজে কাক ও আষাঢ়ে গল্প মনে করুন”।

না আমি নই, এ চিঠি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। এবং এবারের কিস্তিতে রবীন্দ্রনাথ, ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালিতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু বর্ষা। প্রস্তুতির চূড়ান্তে বর্ষামঙ্গল। যা মঙ্গলের আহ্বান করে, তাই তা মানুষের পক্ষ। চলছে কবিপক্ষ। এই পক্ষের মেয়াদ দিনের  নিরিখে নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ২৫ বৈশাখ থেকে মৃত্যুদিন২২ শ্রাবণ তিথিতে এর অস্তিত্ব। যাহ, মনে মনে দু-এক ফোঁটা জল মাথায় মনে হল … এই কি রাঙামাটিতে বর্ষা এল। চারদিক ঝাঁপিয়ে আসছে দাপুটে হাওয়া। রাস্তার পিচ কালোয় রোল খাচ্ছে অবাধ্য হলুদ কতশত ছিন্নপত্র ফুলেরা। বৃষ্টি বাদল নিয়ে বর্ষা। রবি ঠাকুরের কচিপাতার শ্যামলীর বর্ষা। কালোবাড়ির বর্ষা। এমনই বর্ষাদিনে মেতে উঠেছে তাঁর তৈরি চত্বর। চারদিকে সাজ সাজ। ফুলের সাজ, পাতার সাজ। বর্ষার আবাহনে প্রস্তুত নাটকে গানে পড়ুয়া অধ্যাপকরা। আসলে, সবাই এখানে কবির কথায় শিল্পী রাজা, বর্ষার রাজা, ভাবনার রাজা। কবির শান্তিনিকেতন ঘরভাসানিয়া বর্ষার কোপাই। ভোরে উঠে মেঘলা কালো আকাশের চিঠি নিয়ে বসে নাটকের মহড়ায়। উৎসব বলতে যা বোঝায়, সে আদতে তাই হয় যখন পড়ুয়া শিক্ষক মিলে যেতে পারেন। একপাতার গায়ে উৎসবের রঙ্গ। অন্যপাতার গায়ে পরীক্ষা। 

নাটকের পরীক্ষা চলছে কেইবা বুঝবে! গাছের ঝুরি থেকে নেমে এসেছে ঝুরি  ঝুরি দোলনা। সেপাই একজন দাঁড়িয়ে। কি করছে সে, গাছ পাহারা দিচ্ছে নাকি? আজকের দিনে গাছ চুরি হচ্ছে নাকি। একটা অমল দুলতে দুলতে গাছসবুজের ভেজা ডালে পরীক্ষা দেয়। রাজার চিঠি ততক্ষণে কোপাই পেরিয়ে গেছে। এদিকে আরেকটা অমলও। ঝুরি বটের ডালে দুলছে দেখো, রাজার চিঠি না হোক মেঘের চিঠি তো এসেছে। সাধারণ মেয়ে কে যেন দুহাতে ঢেলে দেয় ফুলের ইচ্ছেগুলো। আহা, এগুলোই যদি পরীক্ষার নাম্বার হত! জানতে পারলেই ছুটে আসত পরীক্ষা-দেওয়া বাধ্য-চিন্তিত অমলেরা। মেয়ে অমল? এই প্রথম দেখলাম। ওকি সুধা হতে পার্ট পায়নি?

না, ওর আজ অমল হওয়ার পরীক্ষা যে!  

ভাবছি সবাই অমল হলে ডাকহরকরা হবে কে, আমি?

ওমা, এমন সময় পাশের চারটে গাছের আড়াল থেকে কে যে! প্রথমে উঁকি  সামান্য। বাথান থেকে বেরিয়ে এলে হাতের খাতা দেখতে পাওয়া গেল। পরীক্ষার নাম্বার মাপতেই গাছিয়–কাঠামোর নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন পরীক্ষক। যদিও এ কলাবিকাশের জন্যেই নাটকের পড়া। তবুও পাঠকর্মের দ্বারা একটি পরিসংখ্যান দিতেই হয়। তাই …

তাই … একটি বালক থেকে হয়ে ওঠা অমল আজ মাস্টারমশাই। নাটকে, গানে, সংলাপে সেই বনদেবীর মধ্যে বাল্মিকী ভূমিকায়। যদিও, একথা কিছুতেই মেলে না, যদি মঞ্চসজ্জা নেই, তো রূপসজ্জাই বা কেন! হয়ত একদিন কোনও সাদা  খাতায় নতুন নাট্যরীতিতে সাদা বসনে সবুজ দেখবে। যে চেতনে পান্না সবুজ, না হলে চেতনায় রঙ দেখবে কিভাবে হে অচেতন! নইলে আরও তো হয় সজ্জার  কথা। নাটকের অভিনয়ে পরীক্ষা হোক বা নব্যরীতির দীক্ষা, মঞ্চে উঠলে বেশ, ভূষা পরিপাট্য – একপ্রকার নাট্য। নাট্যের পরীক্ষায় এখন সব ছেড়ে দিয়ে নবতম ভাবনার জয়। নাগরিক রীতির এই কাঠামো একটি রূপ ভেবেছিলেন নাট্যকার  রবীন্দ্রনাথ। সেই হোক আজকের নাটকের কথাটি। ঘটা করে তাই কুসুম হয়েছে গয়না। বাহুডোরে চুপ করে বাধ্য পত্রগুচ্ছ। পুচ্ছ জুড়ে গেছে খোঁপায়। বর্ষার কত ধন। বর্ষা আনবে ভরা কলসে ফসলের মঙ্গল। ওদিকে কিসের মহলা গো? কেইবা বলবে, সবাই ব্যস্ত আপন সংলাপে। শুধু দেখা যায় একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সেই টানা টানা পাপড়ির মতন দুচোখ রেখে ধরল হাত। আমি কাঁপলাম। ইস ঠাণ্ডা যে। ঠায়, জলে জলে, হবে না! বলি তুমি কে, কে? হেসে বলে,  বনদেবী। ওমা, কি সুন্দর যে, টগর কুঁড়ি, লাল রঙ্গন, কাঁঠাল  পাতা দিয়ে তৈরি করেছ গয়না।




হ্যাঁ, আমি নই। ওই যে উনি, দেবদারু পাতার মালা। আর মুকুটে সুধীররঞ্জনদার হাতের ছোঁয়া। কেমন লাগছে! অপূর্ব যে বনদেবী। এবারে। এবারে জল আসবে। ওই দেখ ওদিকে।  

দৃশ্য পরিবর্তন হলে দেখা যায় পিছন ফিরে কে যে জানলার দিকে বসে লিখছেন। আর দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ পড়ছে … রবিঠাকুরের চিঠি। "সুহৃদ্‌বর, আপনি তো সিন্ধুদেশের মরুভূমির মধ্যে বাস করছেন। সেই অনাবৃষ্টির দেশে বসে একবার কলকাতার বাদলাটা কল্পনা করুন।"

বললাম, করলাম।

আর "মেঘের তলে অশ্বত্থগাছের মধ্যে" বর্ষার খোলা চিঠি। "ভিজতে ভিজতে জলের কলস" হয়ে যাচ্ছে পড়ার ব্যাগখানা। একটা ছাতায় সব্বাই ঠাসাঠাসি। গাছের গায়ে গাছ লাগে যেমন। ওদিকে বৃষ্টির সংলাপ উড়িয়ে আনছে আনচান পাতাগুলো। তারই মধ্যে সাইকেলের চাকার জলের বাড়ি না ফিরে অপচয় হতে থাকা। সন্ধ্যায় একদল জামা ছাড়া দুষ্টু বাছুর হাড় বের করে ডাকছে, যেন তাড়া আছে। হ্যাঁ, গাড়ি যাচ্ছে আওয়াজ তুলে, তাই রেললাইন উঠল কেঁপে। ধুনুচি নাচিয়ে যত টেনে আনছে মেঘ। না গন্ধ নেই, শুধু ধোঁয়া। কাচঘরের সামনে  একটা পেল্লায় বাতি তার রেলা জমিয়েছে। কালকে ডাকবে বলে কাকমশাই আজ  চুপ। পিটপিটয়ে দেখে নিচ্ছে। এসব পেরিয়ে সাদামাটা পোশাকের সাদা সাদা অমল, অমলেরা মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে।

বলি, কই আলো? আলো দাও। ফোকাসটা কই? অ্যাই, ডিমারে কে আছো, জ্বালাও আলো।

আরে, আলো কি রাজার চিঠি যে তুমি বললেই জ্বলে উঠবে?

একি দেশ তোমাদের অমলেরা মিশে যাচ্ছে, আর আলো অপচয় করছ নাগরিক সজ্জায়!  

ওদিকে আলোরা যায় না। যায়নি কোনদিন।

তবে?

তবে আর কি, এই নাটকের শেষ।

আর অমল! সেকি বাড়ি ফিরতে পারবে এই অন্ধকারে?  

না হয় অন্ধ এক অভিনেতা সেজে ফিরবে, যেভাবে ফেরে।

বা বাউল।

যাইহোক, দেখলে তো কেউ কেউ অন্ধকারেও আলো দেখে নেয়।

বলছ?

বলছি।

অমল, পারবে?

হ্যাঁ, অমলেরাই যে পারে।

 

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী …

 

(সঙ্গের ছবি কৃতজ্ঞতা : কোয়েল মুখোপাধ্যায়)

 

 

 

 

 

 


2 কমেন্টস্:

  1. Ki je Sundar lekha! Jara mon diye porbe, tara MOU er lekhar sugandha anubhab korte parbe. Tomar lekha aro egiye jak --- ai ashay

    Tomar Pathok

    Dr. Bibhuti Bhusan Biswas

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার মন্তব্য আমার একান্ত ধন _ আজকের দিনে পাঠক পাওয়া যেন হাতে চাঁদ __✍️ তার মধ্যে আপনার মতন মান্য প্রফেসর যখন মন্তব্যে আসেন ... আনন্দ ঝরে বৃষ্টি যেমন

    উত্তরমুছুন