হেমিস
ও হৈমবত
চারদিক ঘিরে আছে রুক্ষ রঙিন পর্বতমালা। ধূসর, পিঙ্গল, লালিম, নীলিম, পীত। তার পিছনে টানা শুভ্রশির কারাকোরম গিরিসারি। পাথুরে পথের চড়াই-উতরাই। একটি নীরস, নিষ্ঠুর পথের সমকোণী বাঁক পেরিয়েই সামনের পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ দেখা যাবে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা অধিবাস্তব পৃথিবী। সারি সারি শৈলাবাস। এভাবেই আমরা পোঁছে যাই পৃথিবীর বৃহৎ, অন্যতম প্রধান বজ্রযানী বৌদ্ধ বিহার 'হেমিস'-এ।
লেহ শহর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে দক্ষিণে পঁয়তাল্লিশ কিমি। যেপথে লোকে প্যাংগং হ্রদ যায়। সারা রাস্তা ডানদিক ধরে বয়ে চলেছে সিন্ধু নদী। পথে কারু নামের একটা ছোট্টো জনপদ ছাড়িয়ে রাস্তা বদল। নদীর উপর সংকীর্ণ সেতু। পেরিয়ে যেতে হবে পাঁচ-ছ কিমি। একটি বিশাল স্বাগত তোরণ। কিন্তু হেমিস গোনপার খোঁজ নেই। চড়াই পথে হঠাৎ একটা মোচড় মেরে সামনে তাকালেই পাহাড় জোড়া হেমিসের রাজপাট। লদাখের সব চেয়ে বড়ো আর সম্পন্ন বৌদ্ধ বিহার এটি। ঢোকবার সময় মনে হবে সত্যিই এক অজানা রহস্যপুর দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে সামনে একটি বিশাল আয়ত অঙ্গন। যার ডানদিকে শ্বেতশুভ্র বিহারের প্রধান ভবনটি। ১৮৭৫ সালে বিখ্যাত রুশ শিল্পী ভ্যাসিলি ভেরেশ্চেগিনের আঁকা হেমিস গোনপার ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে গত দেড়শো বছরে এই বিহারের আকার-প্রকার কিছু বদলায়নি। সময় থেমে যায় এই চত্বরে এস। বাঁদিকে টানা রঙে রঙে ঝলমল জাদুঘর ও অন্যান্য ভবনগুলি। বিহারের ভিতর দরাজ মাপে প্রার্থনাকক্ষ। মস্ত মূর্তি শাক্যমুনির। সঙ্গে গুরু পদ্মসম্ভবও আছেন।
প্রায় দু'হাজার বছর আগে কুশান রাজত্বের সময় মহাযানী সংস্কৃতি তক্ষশীলা থেকে হিমালয় পেরিয়ে তিব্বত বা ভোটদেশে প্রবেশ করে। যে মহাযানী ধর্মবিশ্বাস এদেশ থেকে তিব্বতে পৌঁছেছিলো, সময়ের সঙ্গে তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। ভোটদেশে বজ্রযানী বিশ্বাস শাক্যমুনির সদ্ধর্মের পথ থেকে সরে আসে। কিছু এদেশের এবং মূলত স্থানীয় তন্ত্র-মন্ত্র, ভূত-প্রেত কেন্দ্রিক বিশ্বাস ও লোকাচার সেদেশের ধর্মাচরণকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলে। পণ্ডিতরা সেই বিশ্বাসটিকে বজ্রযানের লামাযানী শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। লামাযানীরা বিশ্বাস করেন তাঁদের আদিগুরু ছিলেন পদ্মসম্ভব বা গুরু রিনপোচে। তাঁরা মনে করেন শাক্যমুনি বুদ্ধই গুরু রিনপোচে হয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছিলেন। পদ্মসম্ভব সম্ভবত বর্তমান পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকা বা ওড়িশার পুষ্পগিরি অঞ্চলের মানুষ ছিলেন।
লামাযানী বৌদ্ধ বিশ্বাসের দুটি প্রধান শাখা আছে। দ্রুকপা ও গেলুগপা। দ্রুকপা শাখাটি বারোশতকে গুরু সাংপে গ্যারা প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বজ্রযানী সাধক। নরোপা প্রস্তাবিত তান্ত্রিক মহামুদ্রা ও ছয়টি যোগাচার ছিলো তাঁর সাধনা। অন্যদিকে গেলুগপা শাখাটির উৎস ছিলো অতীশ দীপঙ্কর প্রবর্তিত 'কদমপা' বা করুণার বাণী। চোদ্দো শতকে মহাযানী প্রাসঙ্গিক মাধ্যমক দর্শনের ভিত্তিতে গুরু জে সঙ্গখাপা এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন। প্রসঙ্গত, বর্তমানে এটাই সংখ্যাগুরু তিব্বতীয় ধর্মমত, যার অধিনায়ক দলাই লামা। সাহেবরা সংক্ষেপে দ্রুকপা মতের অনুসারীদের Red Hat এবং গেলুগপা মতের অনুসারীদের Yellow Hat নামে ডেকে থাকেন। কারণ তাঁদের শিরোভূষণগুলি সেভাবেই রাঙানো থাকে। হেমিস মঠটি দ্রুকপা মতের অনুসারীদের অধিকারে আছে। গুরু পদ্মসম্ভবের সম্মানে প্রতি বছর জুন মাসে হেমিস মঠে উৎসব পালিত হয়।বৌদ্ধ ও খ্রিস্টিয়, উভয় ধর্মমতেই হেমিস মঠের বিশেষ গুরুত্ব আছে। ইতিহাস, কাহিনি ও কিংবদন্তির ধূসর আবছায়া জগৎকে ঘিরে হেমিস চিরকালই এক রহস্যময় সাংগ্রিলা। হেমিস নিয়ে গল্পের শুরু হাজার দুয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। যদিও জানা গেছে হয়তো মাত্র কিছু দিন আগে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চর্যাপদের পুথি, চর্যাচর্য-বিনিশ্চয়' উদ্ধার করেন গত শতকের গোড়ার দিকে (১৯০৭)। তাঁর গবেষণা গ্রন্থটির নাম ছিলো 'হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান'। এই 'আবিষ্কারে'র সূত্রে বাঙালিরা জানতে পারে হাজার বছরেরও বেশি আগে বজ্রযানী বৌদ্ধতন্ত্রের উপাসকরা ছিলেন 'আদি বাংলা' ভাষার প্রথম প্রবর্তক। এই ধর্মীয় মতের উপাসক গুরুদের 'সিদ্ধ' বা 'সিদ্ধ আচার্য' বলা হতো। আর্য ভারতে ভাষাটিকে বলা হতো অপভ্রংশ। পূর্ব ভারতে তার নাম ছিলো 'অবহট্ঠ'। এই ভাষাই ছিলো আদি বাংলা, আদি ওড়িয়া, আদি অসমিয়া আর আদি মৈথিলির উৎসমুখ। ছিলো সিদ্ধাচার্যদের 'মাতৃভাষা'। তাঁরা গান রচনা করতেন এই ভাষায়। গানের বিষয় ছিলো তাঁদের গোপ্য তন্ত্রসাধনার নানা দিক। সঙ্গে ছিলো আপাতভাবে দুরূহ এক ভাষাশৈলী। সাধারণ মানুষদের কাছে তা ছিলো ধাঁধার মতো। যাঁরা বজ্রযানী তন্ত্রসাধনায় দীক্ষিত ছিলেন না, তাঁরা এই সব গানের কোনও অর্থ বুঝে উঠতে পারতেন না। এই জন্য ভাষাটির নাম ছিলো 'সন্ধা' বা সন্ধ্যাভাষা। সন্ধ্যার আঁধারে লুকোনো এই সব গানের অন্তর্বস্তু। তন্ত্রোক্ত 'গণচক্র' অনুষ্ঠানে চর্যাগীতের সঙ্গে সমবেত নৃত্যের মাধ্যমে সিদ্ধগুরুরা ধর্মীয় আচার পালন করতেন। আজও বিভিন্ন তিব্বতি লামাবাদী অনুষ্ঠানে লামারা যে সামূহিক মুখোশ নৃত্য পরিবেশন করেন, তা সেই পরম্পরারই অংশ। তন্ত্রসাধনা চিরকালই গোপনীয়তার আড়াল নিয়ে চলে। চর্যাপদের গানে বাইশ-তেইশ জন সিদ্ধাচার্যের ভনিতা দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন লুইপাদ, সরহপাদ, কুক্কুরিপাদ, ভুসুকুপাদ, কাহ্নপাদ, ডোম্বিপাদ প্রভৃতি বৌদ্ধ তন্ত্র সিদ্ধাচার্যরা। লুইপাদকে বজ্রযানীরা বুদ্ধের অবতার বা বোধিসত্ত্ব মনে করতেন। আবার এই সিদ্ধাচার্যকে নাথপন্থী সাধনার প্রধান গুরু মৎসেন্দ্রনাথের সঙ্গে এক করেও দেখা হয়। সিদ্ধাচার্যদের এই পরম্পরায় হেমিস মঠের সঙ্গে যুক্ত আছে যোগী তিলোপা, তাঁর শিষ্য গুরু নরোপা এবং নরোপার শিষ্য মারপার নাম।
জুয়ান জং (হিউ-এন-সাং) বলেছিলেন এইসব মহাযানী সাধকদের মূল কেন্দ্র ছিলো নালন্দা মহাবিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা ছাড়াও ছিলো ওদন্তপুরী, রক্তমৃত্তিকা প্রভৃতি অসংখ্য মহাযানী বিহার গড়ে উঠেছিলো পঞ্চম থেকে বারো শতক পর্যন্ত। মহাযানী সিদ্ধাচার্যদের সাধনক্রিয়ার ভিত্তি ছিলো এই সব বৌদ্ধবিহার। নালন্দা আর অন্য বিহারগুলি ধ্বংস হয়ে যায় বারো শতকের তুর্কি আক্রমণে। অসংখ্য ভিক্ষু ও আচার্যদের হত্যা করা হয়েছিলো। তাঁদের মধ্যে কিছু সাধক দেশত্যাগ করে নেপাল, তিব্বত ও বর্মাদেশে আশ্রয় নেন। যদিও এই তিন দেশেই অন্তত সাত-আটশো বছর আগে থেকে মহাযানী বৌদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ভারত থেকে নির্বাসিত আচার্যদের যোগদানের ফলে সে সব দেশে বজ্রযানী তন্ত্র সাধনায় জোয়ার আসে।
চর্যাপদের সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ঐক্যমত্য নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার, সুকুমার সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচি, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বা রাহুল সাংকৃত্যায়ন, সবারই অনুমানের মধ্যে ফারাক আছে। সাত থেকে চোদ্দো শতকের মধ্যে ওঠানামা করে তাঁদের নির্ণয়। তবে মোটামুটিভাবে সবাই মানেন দশ থেকে বারো শতকের মধ্যেই ছিলো চর্যাপদ যুগের শীর্ষবিন্দু। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন এই সময়েরই মানুষ। তিব্বতে মহাযানী ও বজ্রযানী তন্ত্রসাধনার তিনিই ছিলেন প্রাণপুরুষ। এই সময়কালের মধ্যে তিনজন সিদ্ধাচার্যের প্রযত্নে তিব্বতের লামাবাদী বজ্রযানী তন্ত্র সাধনা প্রসারিত হয়। তাঁরা ছিলেন গুরু তিলপাদ বা তিলোপা, তাঁর শিষ্য নরপাদ বা নরপা এবং নরোপার শিষ্য মারপাদ বা মারপা। এঁরা শূন্যবাদী বজ্রযানী তন্ত্র সাধনা করতেন। নরোপা এসেছিলেন নালন্দা মহাবিহার থেকে। গুরু নরোপার প্রযত্নেই হেমিস গোম্পার প্রথম পত্তন হয়েছিলো দশ-এগারো শতক নাগাদ। লামাবাদী বজ্রযানী সাধনার কাগ্যু শাখার প্রবর্তক ছিলেন গুরু নরোপা। হেমিস বিহার সারা বিশ্বে কাগ্যু শাখার বজ্রযানী দর্শনের মূল কেন্দ্র।
এবারের গল্পটি একেবারে আলাদা। ১৮৮৭ সালে নিকোলাস নোটোভিচ নামের একজন রুশ পর্যটক এসেছিলেন সেই সময়কালের নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পশ্চিম তিব্বতে, যার নাম এখন লদাখ। তাঁর গন্তব্য ছিলো হেমিস গোনপা বা বিহার। তিনি এসেছিলেন কাশ্মিরের পথ ধরে। শ্রীনগরের রোজাবল, খানইয়ার অঞ্চলে পরবর্তীকালে অতি বিদিত হয়ে ওঠা দরগাটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে সেই দরগাটি ছিলো 'ইশা' নামের এক মহাপুরুষের সমাধিক্ষেত্র। কৌতুহলী নোটোভিচ খোঁজখবর করে ইঙ্গিত পান 'ইশা' আর কেউ ন'ন, স্বয়ং নাজারেথের যিশু। নোটোভিচের মাথায় একটি ফুলকি জ্বলে ওঠে। তিনি একটি ঘোড়ার ভরসায় যাত্রা করেন অতি দুর্গম পূর্বদিকে। যেখানে পৌঁছোনোর কোনও নির্দিষ্ট পথরেখা নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তিব্বতের অন্দরে সাদা মানুষদের প্রতি ঘোর অবিশ্বাস ছিলো। তাঁর গন্তব্য, লাসার পোতালা বৌদ্ধ বিহার। তাঁকে কেউ বলেছিলো সেখানে যিশুর সঙ্গে কাশ্মির বা তিব্বতের সংযোগ নিয়ে পুথিপত্র পাওয়া যাবে। কিন্তু লাসা তখন পূর্ণতঃ নিষিদ্ধ নগরী। কোনও বিদেশীর প্রবেশ নিষেধ সেখানে।
অলঙ্ঘ্য প্রতিকূলতাগুলি নোটোভিচের কৌতুহলকে প্রতিহত করতে পারেনি। তিনি কাশ্মির থেকে লদাখে পৌঁছোন। লদাখের রাজধানী লেহ থেকে হেমিস গোনপায় এসে তিনি এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পান। তাঁর থেকে জানা যায় 'ইশা' তিব্বতি বৌদ্ধদের কাছে একটি শ্রদ্ধেয় নাম। তাঁকে অনেকেই অন্যতম 'বুদ্ধ' হিসেবে স্বীকার করেন। তিনি ভারত ও ইজরায়েলের মানুষদের মধ্যে তাঁর নিজস্ব মত ও উপদেশ প্রচার করেছিলেন। কিন্তু প্যাগানরা তাঁকে হত্যা করেছিলো। আশ্চর্যের ব্যাপার সেই সব প্যাগানদের সন্তানরাই পরবর্তীকালে বিপুলভাবে ইশার মত গ্রহণ করে। ইশা সম্পর্কিত নথিপত্রগুলি ভারত থেকে নেপাল হয়ে তিব্বতে এসে পৌঁছেছিলো। পালিভাষায় রচিত সেই সব পুথি লাসায় রয়েছে। তবে মূল পালি-পুথিটির একটি তিব্বতি অনুবাদ হেমিস গোনপায় রয়েছে। কিন্তু হেমিসের প্রধান দু-চারজন গুরু ছাড়া আর কেউ সেগুলি দেখার অধিকার পায় না। নোটোভিচ এবার লাসা যাবার আশা ছেড়ে হেমিসের প্রধান লামাদের ধরে পড়লেন। অনুরোধ করলেন 'ইশা' সংক্রান্ত পুথিগুলি তিনি অনুবাদ করে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু লামারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন। ভগ্নমনোরথ হয়ে নোটোভিচ যখন লেহ ফিরছিলেন, তখন একটি দুর্ঘটনায় ঘোড়া থেকে পড়ে যান। ফলে তাঁর একটি পা ভেঙে যায়। লামারা চিকিৎসার জন্য আবার তাঁকে হেমিস মঠে ফিরিয়ে আনেন। এই সময় নোটোভিচ সেখানে কয়েক মাস শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। এই অবসরটি তাঁকে লামাদের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে নিয়ে আসে। তখন তাঁর অনুরোধ লামারা অগ্রাহ্য করতে পারেননি। দোভাষীর মাধ্যমে তাঁকে ইশা বিষয়ক পুথিগুলি পড়তে দেওয়া হয়। তিনি দোভাষীর তর্জমা অনুসরণ করে পুথিগুলি রুশ ভাষায় লিখে ফেলেন। দেশে ফিরে নোটোভিচ তাঁর রচনার পাণ্ডুলিপি ভ্যাটিকানের কার্ডিনাল ও রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান সন্ন্যাসীর গোচরে আনেন। তাঁরা উভয়েই বিষয়টি নিয়ে নোটোভিচকে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে নিষেধ করেন। কারণ তাঁরা জানতেন, এ জাতীয় 'তথ্য' খ্রিস্টিয় ধর্মীয় সমাজে বিপুল আলোড়ন নিয়ে আসবে। নোটোভিচ তাঁদের উপদেশ অমান্য করে পাণ্ডুলিপিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে দেন। বইটির ইংরেজি নাম, 'The Unknown Life of Jesus Christ'.
খ্রিস্টিয় ধর্মগুরুদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে সারা য়ুরোপে মহা আলোড়ন শুরু হয়ে গেলো। নোটোভিচের প্রতি 'ধর্মদ্রোহিতা'র অভিযোগে মুখর হয়ে উঠলো খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের সমস্ত শাখাই। সেই সব দেশ থেকে বহু সন্ধানকারী হেমিসের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। এই সূত্রে তিনজন মান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। শিক্ষাবিদ এলিজাবেথ কাসপারি, বিখ্যাত শিল্পী, দার্শনিক নিকোলাস রোয়েরিখ এবং স্বামী অভেদানন্দ। এঁরা বলেছিলেন, হেমিসের লামারা তাঁদের ইশাসংক্রান্ত মূল তিব্বতি পুথিটি দেখিয়ে ছিলেন। রোয়েরিখ তাঁর Heart of Asia গ্রন্থে ঘটনাটির উল্লেখ করেছিলেন। হেমিসের প্রধান লামা, স্বামী অভেদানন্দকে জানিয়েছিলেন লাসার কাছে মারবোর গোনপায় মূল পালি পুথিটি রয়েছে। এই লামা ইংরেজি জানতেন। তিনি স্বামী অভেদানন্দকে তিব্বতি পুথিটির কিছু অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন। সেই অনুবাদের সঙ্গে নোটোভিচের বর্ণনার কোনও তফাত ছিলো না। তিনি আরও বলেছিলেন পুথিটি লেখা শুরু হয়েছিলো যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার চার বছর পর থেকে। তার মধ্যে এমন বহু লোকের নাম উল্লেখ আছে যাঁরা যিশুকে দেখেছিলেন। এমন কি কয়েকজন বণিকের কথাও আছে যাঁরা যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
তখন থেকে শুরু করে অধুনা আরও অনেক বিদেশী পরিব্রাজকদের রচনায় হেমিস গোনপায় এই পুথির অস্তিত্ত্ব বিষয়ে ইতিবাচক উল্লেখ পাওয়া যাবে। নোটোভিচ বলেছিলেন ভ্যাটিকান গ্রন্থাগারে ভারত, চিন, মিশর ও আরবদেশ থেকে সংগৃহীত যিশু বিষয়ক তেষট্টিটি পুথি রয়েছে। কিন্তু সমগ্র খ্রিস্টিয় ধর্মজগৎ কদাপি এই দাবির সত্যতা স্বীকার করেনি। জে আর্চিবল্ড ডগলাস নোটোভিচের মাত্র আট বছর পরেই হেমিস গোনপার লামাদের সঙ্গে 'বিশদ আলোচনা করার পর ঘোষণা করেছিলেন নোটোভিচের দাবিটি শুদ্ধ 'জালিয়াতি'। গুন্থার গ্রেনবোল্ডও একই কথা বলেছিলেন। যিশু বিষয়ক এসব 'তথ্য'কে তাঁরা নেহাতই প্রলাপ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যিশুর জীবন এবং তাঁর শিক্ষায় প্রাচ্যের জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভূমিকা বিষয়ক যাবতীয় সন্ধান ভ্যাটিকানের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। দীর্ঘকাল হয়ে গেলো, আর কাউকে হেমিস গোনপা থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। হতে পারে, বিষয়টির পিছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিগত তাৎপর্যও রয়েছে। বিষয়টি চিরকাল কুয়াশাচ্ছন্ন এক কিংবদন্তি হয়েই থেকে যাবে। প্রামাণ্য ইতিহাসটি যে কী, তা কেউ কখনও জানতে পারবে না। লাসা বা ভ্যাটিকান, কেউই চায় না লোকে জানুক। যিশুর চোদ্দো থেকে আঠাশ বছর জীবনযাপন রহস্যময় গুহার আঁধারেই নিহিত থেকে যাবে শেষ পর্যন্ত। মানুষ হয়তো তাই চায় । ভালোবাসে।
হেমিসের গ্রন্থাগারে আছে অসংখ্য বহুমূল্য পুথিপত্রের সম্ভার। আছে সোনার মূর্তি, মণিখচিত স্তূপ আর অমূল্য থাংকার সংগ্রহ। লদাখের প্রধান বিহারগুলির মধ্যে হেমিস প্রধানতম। প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে গুরু পদ্মসম্ভব রিনপোচের স্মরণে হেমিস উৎসব পালিত হয়। সে এক জমকালো, বর্ণাঢ্য আয়োজন। লামাদের সমবেত মুখোস নৃত্য বা চামস, অসংখ্য বজ্রযানী লোকাচার, দেশবিদেশের দর্শক-অতিথি এবং একটি বিস্তৃত মেলার আয়োজনে হেমিস উৎসব মুখর হয়ে থাকে কদিন। এমনিতেও হেমিস গোনপা লদাখের সব চেয়ে জনাদৃত দর্শন স্থল।
কবি বলেছেন, 'বিপুলা চ পৃথ্বী'। আমি বলি বিপুলতর আমাদের এই দেশ। সব জায়গায় যাওয়া যাবে না। সব কিছু দেখা যাবে না। আকাঙ্ক্ষাটি তবু কমবে না কখনও। যেসব জায়গা না দেখলে ভারতবর্ষের সন্ধান অপূর্ণ থেকে যায়, তার মধ্যে একটি ঠিকানা হেমিস গোনপা। যে সব পথিক চার দিশায় ভারত নামক রূপকথার রহস্য খুঁজে বেড়ান, তাঁদের জন্য হেমিস এক নির্ভুল ইশারা।
(সৌজন্য : ইচ্ছেডানা)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন