কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

রেজাউল করিম

 

সমকালীন ছোটগল্প


জীবন

 

অফিস থেকে ফিরে হাসান বারান্দায় চেয়ারে বসে। সারাটা দিন ভীষণ গরম আর কাজের চাপে অসম্ভব ক্লান্তিতে কেটেছে। গা থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। হাসান জামা খুলে বাতাসে দেয়। লীনা স্কুল থেকে ফেরেনি। আজ ওর স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হবে। গভর্নিং বডির মিটিং আছে বলেছিলো।

এক সময় হাসান ঘুমিয়ে পড়ে চেয়ারে। সন্ধ্যায় ভ্যাপসা গরমটা কমে আসে।  বাতাসের জোর বাড়ে। জানালায় বাতাসের ধাক্কার একটা শব্দ হয়। ঘুম ভাঙ্গলে হাসান টের পায় লীনা তার পাশে বসে আছে। হাসান ওঠে হাত মুখ ধুয়ে এসে আবার লীনার পাশে বসে। লীনা ততক্ষণে চা তৈরি করে অপেক্ষা করছিলো। বিস্কুট তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে হাসান জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার ইনক্রিমেন্টের কিছু হলো’। লীনা উত্তর দিলো উৎসাহহীনভাবে, ‘না মিটিং হলো না তো! সেক্রেটারী অনুপস্থিত।’

হাসান ভেবেছিলো লীনার বেতনটা বাড়লে বড় ভাইয়ের ছেলেটাকে এখানে এনে কাছে রেখে পড়াবে। বাবা-মা-হারা ছেলে। ছাত্র হিসেবেও ভালো। শহরে থেকে  পড়াশোনা করতে পারলে ভালো রেজাল্ট করতে পারতো। তাছাড়া লীনাও তো  মাঝে মধ্যে দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে পারতো। মার অসুখও তো প্রায় লেগেই আছে। কিছুদিন কাছে রেখে চিকিৎসা করবে হাসানের প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছে না।

ছুটির দিন সাধারণত হাসান বিকেলে  বা সন্ধ্যার পর বের হয়। আজও সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হয়ে সোজা পাবলিক লাইব্রেরীতে ঢোকে। মঈনুলের থাকার কথা। কিন্তু মঈনুলকে দেখতে পেলো না। হাসান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা স্থির করে একটা দৈনিক টেনে নিলো।

আধাঘন্টা পরে মঈনুল এলো। ওকে খুব চিন্তিত মনে হলো হাসানের। লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে বাগানের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসলো। সিরারেট ধরালো দু’জনেই।  মঈনুল দেরি হওয়ার কারণ জানালো। মার্তুজাকে হাসপাতালে ভর্তি করলো আজ। কয়েক মাস থেকে বুকে একটু একটু ব্যথার কথা শুনেছে হাসান। কিন্তু আজ হঠাৎ কাশির সাথে রক্ত আসার কথা শুনে হাসানের খুব খারাপ লাগলো। এক বছরও হয়নি ওদের বিয়ের। এরই মধ্যে মার্তুজা এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লো। হাসান শান্তনা দিলো। ‘দেখ ঘাবড়াবার কি আছে! আজকাল তো ভালো চিকিৎসা  আছে, ওষুধও বেরিয়েছে। কয়েকদিনেই দেখবি ও সেরে গেছে।’ ‘কিন্তু আমার ভয় করছে ভীষণ। ডাক্তার এখনও ফাইনাল কিছু বলেনি। ভয় হচ্ছে যদি ক্যান্সার হয়!’ মঈনুলের কথায় হাসানের মনটাও কেমন করে উঠলো। একটা কষ্ট অনুভব  করলো হাসান। বললো, ‘আগামীকাল লীনাকে নিয়ে মার্তুজাকে দেখতে যাবো’।

মঈনুলের সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে হাসান একটা রিক্সা ডেকে ওঠে পড়ে। কিন্তু গোটা রাস্তায় মঈনুল আর মার্তুজার জন্য একটা বেদনাবোধ হাসানের মধ্যে বিচরণ করতে লাগলো। সমস্ত চিন্তা ভাবনা থেকে একটা চিন্তার মধ্যে, বেদনাবোধের মধ্যে এসে আটকা পড়লো। নিজস্ব দু:খগুলোকে ক্ষীণ মনে হতে থাকে হাসানের কাছে। পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসে। হাসান মঈনুল  মার্তুজা ওদের ভার্সিটির চার বছরের স্মৃতি। সিনেমা দেখা। পার্কে বসে আড্ডা দেয়া। ভার্সিটির যে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় বেড়ানো। একবার ওরা কক্সবাজারেও গিয়েছিলো। সেন্টমার্টিন। কিন্তু হাসানের সেন্টমার্টিন ভালো লাগেনি। তবে নদী সমুদ্র যাত্রায় ভালো লেগেছে। গাংচিল। কী সুন্দর দলে দলে!

রিক্সা প্রেস ক্লাবের মোড়ে এসে একটা জটলায় দাঁড়িয়ে যায়। হাসান রিক্সা থেকে নেমে জটলাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় একটা যুবক মাটিতে পড়ে আছে। জামায়, মুখে, শরীরে রক্ত। তাজা রক্ত। পকেটমার বলাবলি করছিলো লোকজন। হাসান ছেলেটিকে চিনতে পারে। ওর অফিসের পিয়ন কালামের ছোট ভাই। মেট্রিক পাশ করেছে। চাকরীর জন্য কিছুদিন ঘোরাফেরা করেছে। বাবা মা ভাইয়ের কাছেই থাকতো। অর্থাভাবে বেশী পড়াশোনা হয়নি। হাসান তাকিয়ে থাকলো কালামের ভাইয়ের রক্তমাখা শরীরটার দিকে আরো কিছুক্ষণ। এ্যাম্বুলেন্স  এলো। এ্যাম্বুলেন্স কালামের ভাইকে তুলে নিয়ে চলে গেলো। রিক্সায় আবার  উঠলো হাসান। ভাবতে লাগলো আজ সন্ধ্যায় বের না হলেই বোধ হয় ভালো হতো। শুনতে হতো না মার্তুজার অসুখের কথা। দেখতে হতো না কালামের ভাইয়ের এই অবস্থা।

বাসায় ফিরলো হাসান রাত দশটায়, লীনা ঘুমিয়েছে। পাশের বাসার রেডিয়োতে গান বাজছে। হাসান লীনাকে ডাকলো না। বারান্দায় চেয়ারটায় বসলো। পাখির কিচিরমিচির শব্দ হচ্ছে ঘরের উপরের গাছটায়। রাস্তার মধ্যে কয়েকটা কুকুর চিৎকার করে ছুটাছুটি করছে। হাসান অনুভব করলো কিছুক্ষণ আগের বেদনাবোধটা, কষ্টটা এখনও তার বুকে নড়াচড়া করছে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই অফিসের তাড়া। ঘন রোদ। সামান্য হাওয়া বইছে। বৃষ্টি নেই অনেকদিন। হাসানকে বের হতে হয় মফস্বলে যাবার জন্য। ড্রাইভার অসুস্থ। নিজেকেই গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে। বেশী দূরের পথ না। গাড়ি ধীরে ধীরে  চলছিলো। কিছুদূর এসে হাসানের ইচ্ছে করে গাড়ি থেকে নামতে। রাস্তার দু’ধারে ধানক্ষেত। বিস্তৃত মাঠ ফসলে ভরা। আর কয়েকদিন পরেই সোনালী আভা নিয়ে  ধানগাছ দোল খাবে। হাসান একটা প্রকান্ড জারুল গাছের নিচে গিয়ে বসে।  শহরের কোলাহলহীন সময়টা উপভোগ করে। ভালো লাগে তার তাকিয়ে থাকতে জনহীন প্রান্তরে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন