কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


দৃষ্টি

 

হ্যাঁ, এমনই এক কালবৈশাখীর রাতের পরে ভোরের প্রথম আলোয়, ঠিক এভাবেই পাওয়া গেছিল একটা বাজপড়া কালোমূর্তি। টালির চালার সামনে পুঁইমাচা আর রাংচিতার গেট পেরিয়ে পুকুর ঘাটে বসেছিল শ্যাওলা ঢাকা ভাঙা  সিঁড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে। বসেছিল শঙ্করীর পোড়া দেহটা। তাও তো সে অনেক বসন্ত আগের কথা।

ভূষণ মণ্ডল তাকিয়ে ছিল একেবারে উত্তর কোণের ওই যেদিকে নদীটা বাঁক নিতে গিয়ে চরা পড়ে গেছে, সেই দিকে। কিন্তু ও টের পাচ্ছিল ঠিকই যে, আসলেই পশ্চিম সীমান্তের অতল থেকে উঠে আসছে প্রকাণ্ড কালো দৈত্যের মত মেঘটা। আসলে ভূষণ কোনদিকে তাকাল তাতে কিছু যায় বা আসে না। ভূষণ সবটাই বুঝতে পেরে যায়। যে দিকে দৃষ্টিপাত ঘটনা ওপর প্রান্তরে।

বটগাছের নিচে বসে আছে সে। বিকেলের পর্দা সরিয়ে রাত নামছে। তার পাশেই ভাঙাহাত আর গলে যাওয়া থ্যাঁতা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খড়ের কাত্তিক। মাথার ওপর আসে পাশে নেমে এসেছে পেত্নির হাতের মত ঝুলি আর ঠিক তার মাথার ওপর গাছের ফাটলে বাসা করে থাকে কালো বেশ বড় সড় একটা প্যাঁচা। এই জানাগুলো সবই তার নিজের পর্যবেক্ষণ। যদিও গত তিরিশ বসন্ত আগে সে শেষবার পৃথিবীর আলো দেখেছিল।

লোকে অনেক কথাই বলে। শুনে শুনে আর নিজস্ব আবছা স্মৃতি মিলে মোটামুটিভাবে সে একটা ধারণায় নিজেকে বুনে রেখেছে। নদীর দিকে পেছন  ফিরে ঘর মুখো হয় সে। পেছনে তাড়া করে আসছে হু হু বাতাস। শঙ্করী মাগি আজকেও তাকে শুষে নেবে জানে। আজকাল আর কিছুতেই কিছু হয় না তার। শঙ্করী গালি দেয় গুমরে গুমরে। তবে এটুকু তার পাওনা। হাভাতের ঘরে মা বাপ মরে যেতে এসে উঠেছিল অকাল বিধবা বছর পঁচিশের শঙ্করীপিসি। তিনকুলে আর কে-ই বা ছিল! ওই শঙ্করী পিসির গায়ে গা দিয়ে বুকে মুখ চুবিয়ে ঘুমিয়ে  পড়ত। তখন তো ধীরে ধীরে আলো ফুটছে ওই গাঙের পাড়ে মাঠে। ফনি মনসার ঝোপ আর বিলের ধারে সবুজ গাঢ় হয়। বিকেল শেষে পিসি দাওয়ায় দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ত "ভুসো... বাপ আমার ঘরে আয় "শাঁখ বাজলেই ডাক পেত। গড়িয়ে গড়িয়ে ইস্কুলে ফি বছর পাশ। তখনও তো রাতের বেলা শঙ্করী। ভুষণ সবটাই  জানে। উপত্যকার রং, ঘাস জমিন আর অরূপ গুহার কথা। পা ছড়িয়ে বসে হাত রাখে নিজস্ব মহীরূহে। তারপর যখন পদ্মা এলো তার মন ভাসিয়ে, শঙ্করী যেন  উন্মাদিনী ঈর্ষায়। তারপর এলো মড়ক। অজানা জ্বরে ভুগে ভুগে বিছানায় মিশে যাবার উপক্রম। কত লোক মরে গেল। কতক বাঁচল। শঙ্করী চোখ মেললেই দেখতে পেত মুখের ওপর তার শুকনো মুখ। দিনরাত এক করে সুস্থ করে তুলেছে তাকে, তাও ঠিক।

লোকে বলে অসুখে তার চোখ গেল, পদ্মা বলে ওই শয়তানি ধুতরোর বিষ দিয়ে অন্ধ করে দিয়েছে। আরো অনেকের মুখে এরকম একটা কথা সেও শুনতে শুনতে পুরোদস্তুর লোক হয়ে গেল একসময়। কিন্তু  ততদিনে তার সব কিছু বন্ধক শঙ্করীর কাছে। শঙ্করীর শরীরময় খিদে। আশ আর মেটে না। ক্রমশ পুড়ে গেল সে। সাদা থান আর একগলা ঘোমটার আড়াল দিয়ে দাঁড়ালে তবু লোকে থমকে যেত। শঙ্করী দাপিয়ে বেড়াতো পাড়া। আড়ালে কু-কথা কে না বলে! ভূষণ হাঁপিয়ে ওঠে। ভালো লাগে না কিছুই আর। তবু অভ্যাস।

তখন নদীতে অনেক জল। বিদ্যুতের আলো পড়ে তার কানা চোখে। না দেখলেও অনেক পরিবর্তন টের পাচ্ছিল ভূষণ। পাকা সড়ক হলো। বাঁশঝাড় কেটে তিনতলা কোঠাবাড়ি। গ্রাম থেকে মফস্বলের যাত্রা। পদ্মাকে নিয়ে অশান্তি হয়েছিল, এটা ঠিকই। ভূষণ পদ্মার জোয়ারে ভাসতে চাইছিল, তাও ঠিক। পদ্মা এখনও প্রখর, জানে ভূষণ। তিন গ্রাম পরেই বিয়ে করে দুটো ছেলে মেয়ের মা। পদ্মা বাপের ঘরে এলে সে ঠিক গন্ধ পায়।

এমনই একটা মেঘ কালো অপরাহ্নে শঙ্করী একরাশ বাসন নিয়ে গেলো পুকুর ঘাটে। আর ফিরলো না। অঝোর বৃষ্টিতে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। আচমকা কান ফাটানো আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখেছিলো শুধু বিদ্যুৎ।

জলভরা মেঘের গুম গুমের মধ্যেই খয়েরপুরের  দিকে পা বাড়ায় সে। আজকাল মদের নেশা হয়েছে তার। নবীন, প্রভাত, খোকন ওরাই নিয়ে গেছিল একদিন। বিয়ের গয়না দিয়ে একটা ছোটো দোকান করে দিয়েছিল শঙ্করী তাকে। কানা ভূষণের দোকান। সঙ্গে  থাকত লোচন ময়রার ছেলে হাবু, তারপর বদরপাড়ার স্বপন। চালটা ডালটা তেল বিস্কুট বড়ি। চলেই যায় জীবন। 

কাছে একটা বাজ পড়ল। পা চালায় ভূষণ। দোকানে বসে থাকে অন্ধকারে। এক কোণে টিমটিমে কেরোসিন বাতি। চারিদিকে ছায়ানৃত্য। ভূষণের শূন্য ঘরে এখনও শঙ্করীর বিকট ছায়া উষ্ণতা খোঁজে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন