কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১০




ঋজু  জানে তার মায়ের আরণ্যভাব। সে জানে তার মা এমন পথেই যাবে যেখানে বন্য পশুদের বিচরণ, যেখানে নাগরিক আদব কায়দার ধার ধারে না উন্মুক্ত প্রকৃতি, যেখানে প্রতীচীর সঙ্গে  প্রাচীর একমাত্র যোগসূত্র হল প্রভাকর। তাই সে দুটো কাজ করেছে।

(১) এই পথের শুরুতেই সে নানান অনুরোধ উপরোধে তার মাকে ফোনের মাধ্যমে  লোকেশন শেয়ার করতে রাজি করিয়েছে। তার মাযের সেলফোন ব্যবহারে ঘোর আপত্তি ছিল বহুকাল।  কলকাতা শহরে গেলে সে বিনা সেলফোনে ঘুরে বেরিয়ে অনেক সময় বন্ধুদের বিরক্তিভাজন হয়েছে। তাকে যোগাযোগ করতে গেলে হয় কলকাতার বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করতে হবে (ফোন ধরবেন তার বাবা যিনি সবসময়ে নম্বর লিখে রাখেন না) নয়তো ফেসবুক মেসেঞ্জারে ধরতে হবে। দুটো মাধ্যমই  যথেষ্ট নড়বড়ে। এর ফলে অনেক সময়েই ব্যাটে বলে হয়নি।

 

'বন্ধু তোমার আসার আশাতে

বসে আছি সাঁঝ রাতে

রাত হল শেষ প্রভাতে

তবু আমার দেখা হল না,

হল না হল না হল না  হল না।

বন্ধু মাঝ দরিয়ায় দাঁড় টানি

একূল ওকূল না জানি

হালে আমি পাই না পানি

তবু তোমার দয়া  হল না

হল না হল না হল না  হল না।'

তা এই দেশে ঋজু আমাকে চেপেচুপে একটা সেল ফোন দিয়েছে। সেই তার বিল মেটায়, দিনান্তে একবার ফোন করে কথা বলে। এ ছাড়া বাকি সময়ের বেশির ভাগ, আমার সেল ফোন  ক্যামেরাডিউটি আর রেকর্ডপ্লেয়ারডিউটি করে। কর্ণের সহজাত কবচ কুন্ডলের মত সেটি আমার অঙ্গজ নয়। সে থাকে তার মনে, আমি থাকি আমার মনে। এ হেন 'বন্য বন্য এই অরণ্য ভালো’ মানুষকে ফোনের মাধ্যমে লোকেশন শেয়ার করাতে রাজি করানো চাড্ডিখানি কথা নয়। তা ঋজু সেই অসাধ্যসাধন করল। আমিও মনে মনে ভাবলাম যে যদি আমি বাজ বাহাদুরকে  নিয়ে কোনো জনমানবহীন প্রান্তরে, এই পৃথিবী থেকে  সটকে পড়ি, তাহলে ঋজু অন্তত জানবে ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল!

(২) আমাকে একটা 'আমেরিকা দা বিউটিফুল' কার্ড দিয়েছিলো। এটি হলো আমেরিকার বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্কে বা জঙ্গলে যাবার বার্ষিক টিকিট। ও জানতো যে আমি অরণ্যের পথেই যাবো। তাই আমাকে যাতে প্রতিটি পার্কে আলাদা করে টিকিট কাটতে না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। সফরের এই পর্যায়ে এসে 'আমেরিকা দা   বিউটিফুল' কার্ডটি প্রথমবার ব্যবহার করবার সুযোগ পেয়েছিলাম।

প্রায় বিকেল ৪টা  নাগাদ  ওয়াল পৌঁছলাম। চেম্বারলেনকে পেছনে ফেলে পেরিয়ে গেছি আরো অনেকগুলি ছোট ছোট শহর । পেরিয়ে গেছি রিলায়েন্স ( এখানেও অম্বানি?), কেনেবেক ( আমি নেবোক !), ভিভিয়ান ( কোথায় তুমি ক্লার্ক গেবল ?), কাদোকা (কাদিনিকো !)। সবুজ শস্যক্ষেত কোথাও হয়েছে বিস্তীর্ন রুক্ষ প্রান্তর, কোথাও আকাশে আঙ্গুল উঁচিয়েছে গ্রানাইট পাথরের উদ্ধত কালাপাহাড়। কোথাও বাজ বাহাদুরের  গতির  সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছে বল্লমধারী অশ্বারোহী । তার মাথায় ঈগলের পালকের শিরস্ত্রাণ, কোমরে তীক্ষ্ণ কুঠার, পরণে বাইসনের চামড়ার কৌপিন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখেছি বহুক্ষণ। অনুভব করেছি তার তেজস্বী উপস্থিতি।

ইন্টারস্টেট ৯০ একেবারে ওয়াল শহরের ওপর দিয়ে যায়। আমেরিকার সব শহরের পার্ক স্ট্রিটের নামই বোধহয় মেন স্ট্রিট। হাইওয়ে থেকে ডানদিকে এক্সিট নিয়েই মেন্  স্ট্রিট। সেখানে কয়েকটা পেট্রল পাম্প, গিফট শপ, একটা সাবওয়ে স্যান্ডউইচের  দোকান আর দু মিনিট পরেই বাঁ দিকের ফুটপাথে আমার ছোট্ট ছাপোষা মোটেল। মোটেলের বাইরে একটা ফুলের টবে লাল টুকটুকে ফুলের থোকা  সূর্যের আলোয় রক্তাক্ত। বাজ বাহাদুরকে জায়গামতো বিশ্রামে রেখে মালপত্র নিয়ে মোটেলের দরজা ঠেলে ঢুকলাম।

বাইরের লাল ফুলের টব জানিয়েছিল এই স্থান কোনো রমণীর। ভেতরে ঢুকে দেখলাম আগাম সংবাদ অভ্রান্ত। কাউন্টারের পেছনে এক ঝকঝকে গোলগাল ভদ্রমহিলা। হাসিমুখে আমাকে অভ্যর্থনা করলেন।

'Welcome to Wall.'

'Thank you. I have a reservation for the night.'

নিয়মমাফিক রিসারভেশনের কাগজ, ড্রাইভার্স লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড, গাড়ির রেজিস্ট্রেশান নম্বর, আমার তরফ থেকে আর ব্রেকফাস্টের সময়, ওয়াই ফাইয়ের হদিশ, ঘরের চাবি, চেক আউটের সময় ওনার তরফ থেকে আদান প্রদান হল।

'So where are you traveling from all by yourself?’

বুঝলাম উনি একাকী পর্যটক খুব একটা দেখেন না। এক মুহূর্ত ভাবলাম, কী উত্তর দেব? মানকাটো ? শিকাগো? সিরাকিউস? বস্টন ?

‘I am driving down from Mankato in Minnesota.’

'Wow! That is some distance! You must be very tired.’

‘Not tired enough to not go out right now and visit Badlands National Park. Can you please show me the way? I still have about 5 hours of daylight.’


ভদ্রমহিলা আমার দিকে একটা ভুরু তুলে খানিক চেয়ে একটু মুচকি হাসলেন। তারপরে একটা টুরিস্ট ম্যাপ বার করে আমাদের হোটেল কোথায়, ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্ক কোথায়, কোন রাস্তায় যাবো সেই সব দাগিয়ে দিয়ে হেসে বললেন

‘Here you go. Enjoy the park but do get out before nightfall.’

‘Certainly. Thank you so much.’

একতলা ছিমছাম ঘর। জানালার বাইরে পাশের বাড়ির এক চিলতে বাগান। প্রথমেই ঘরে ঢুকে ইলেকট্রিক  কেটলিতে জল বসিয়ে হাত মুখ পরিষ্কার করে ধুয়ে নিলাম।  জানালার পাশে সোফাতে বসে এক ক্যাপ গরম দার্জিলিং চা আর দুটো বিস্কুট খেতে খেতে ঠিক করলাম যে ওই মেন্ স্ট্রিটের পেট্রল পাম্পে তেল ভরে, পাশের  সাবওয়ে স্যান্ডউইচের  দোকান থেকে একটা স্যান্ডুইচ প্যাক করে  ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্কে ঢুকে পড়ব। গাড়িতে জল রয়েছে। ওখানেই সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে রাত্তিরের খাওয়া সারা যাবেখন ।

মেন্ স্ট্রিট ধরে বিলকুল নাক বরাবর সোজা যে রাস্তাটা চলে গ্যাছে তার নাম SD-240 E. সেই  পথে দক্ষিণদিকে মাইল সাতেক গেলেই ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্কের গেট। আমি তো  টমেটো, লেটুস, পেঁয়াজ আর হানি মাস্টার্ড দেওয়া টুনা স্যান্ডউইচ, জল, দূরবীন, আর ঋজুর দেওয়া 'আমেরিকা দা বিউটিফুল' কার্ড নিয়ে বাজ বাহাদুরের সঙ্গে গেটে পৌঁছলাম। এই সাত মাইল পথে ঠাহর হচ্ছিলো কেন এই জায়গার নাম ব্যাডল্যান্ডস। রুক্ষ গ্রানাইট পাথর রোদের প্রচন্ড তেজে রুটির তাওয়ার মত গরম। পাথুরে উপত্যকায় কিছু ঘাসজমি দাঁত কামড়ে কোনোরকমে টিকে রয়েছে। বাজ বাহাদুর আমাকে বাতাস করে করে হাঁপিয়ে উঠছে। লাকোটা উপজাতির মানুষেরা এই জায়গার নাম দিয়েছিলো মাকো সিকা অর্থাৎ ল্যান্ড ব্যাড (জমি খারাপ)। পরবর্তী কালে ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান পশম ব্যবসায়ীরাও বলতো  "les mauvais terres pour traverse," যাতায়াতের জন্য খারাপ জায়গা। খারাপ কালো পাথরের রুক্ষ দেশ।

 

'তা সে যতই কালো হোক আমার ভালো লেগেছে।'

গেটে 'আমেরিকা দা  বিউটিফুল' কার্ড দেখাতেই চিচিং ফাঁক। পার্ক রেঞ্জার আমার লাইসেন্স দেখে নিয়ে আমাকে একটা পার্কার ম্যাপ দিলেন। সাবধানী মধুবাণী শুধোল:

'‘Er what are my chances of seeing wildlife?’

‘Perfect chance.

If you look to your right you will see a bison grazing in the distance. Just at this gate there is a Prairie dog colony. You could not miss them even if you tried. If you look up you will see several turkey vultures and two golden eagles soaring. This place is breathtaking at dusk’’

সূর্য নরম হয়ে আসছে। একটা হলুদ আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে  মাকো সিকার রুক্ষ প্রান্তর। আমি আলিবাবার গুহায় প্রবেশ করলাম।

'মাঠের ধারে গড়েছে মিস্তিরি

হলুদবাড়ি, সামান্য তার উঠান

ইটের পাঁচিল জাফরি-কাটা সিঁড়ি

এই সমস্ত – গড়েছে মিস্তিরি।

বাড়ির ওপর তার যে ছিলো কী টান

মুখের মত রাখত পরিপাটি

যাতে বিফল বলে না, বিচ্ছিরি

কিংবা শূন্য সম্মেললের ঘাঁটি।

মাঠের ধারে গড়েছে মিস্তিরি

হলুদবাড়ি — যেখানে  মেঘ করে।

এবং দোলে জাফরি-কাটা সিঁড়ি

ভাগ্যবিহীন, তুচ্ছ  আড়ম্বরে।

হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যাবেলা সড়ক

কাঁপিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো দক্ষিণে

দৌড়ে এলো মজা দেখার মড়ক

নিলেন তিনি সকল অর্থে কিনে।

  

লোকালয়ের বাহির দিয়ে সিঁড়ি

বদল করে দিলো না মিস্তিরি!'




 

(ক্রমশ)


1 কমেন্টস্:

  1. ‘ওয়াল’ নামটির উৎপত্তির মূলে রয়েছে ওই ‘ব্যাডল্যাণ্ড’এর প্রস্তরীভূত দেওয়াল।

    উত্তরমুছুন