কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী




 

(২০)

 

কেস স্টাডি ৩

 

I think the real tragedy is in the inner war which is waged between people who love each other a war out of which comes knowledge.

D.H. Lawrence

 

কি বলা যায় বিশ্রুতকে? এপিক ক্যারেক্টার? ফাদার ফিগার? ছেলেমেয়েরা কতভাবেই যে বর্ণনা করতে চাইত ওকে। ওর মধ্যে দৃঢ়তা আর ভারসাম্য দুটোই ছিল। আর ছিল অন্যের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা। দায়িত্ববোধে, কর্তব্যপালনে, প্রেমে ও নিষ্ঠায় এক অতুলনীয় মানুষ।

 

গোড়ায় কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এরকমই ছিল না। হৃদয়ের মা মাঝেমাঝেই ডান্স ক্লাস নিতে যেতেন। সেখানেই আসত বিশ্রুত। ছোটোবেলা থেকেই অসম্ভব ভালো নাচ করত সে। একদম তাক লাগিয়ে দিত। নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল তার যা অন্য কারো সঙ্গে মেলে না। তাছাড়া সে ছিল অতি সহৃদয় মানুষ। ক্লাসে সবার সঙ্গেই সে সমানভাবে মিশত। ক্লাসের সেরা ছেলে বলে ওর আলাদা কোনো অহংকার ছিল না। ক্লাসে যে মেয়েটি ওর পরে সেকেণ্ড হত, তার সঙ্গে ও যেমন সহজভাবে মিশত, একইভাবে মিশত যে সবচেয়ে দুর্বল তার সঙ্গেও। মায়ের সঙ্গে হৃদয়ও মাঝে মাঝে ডান্স স্কুলে যেত। তখনই বিশ্রুতর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। বিশ্রুতর স্বভাবের এই নমনীয়তাই ওকে আকৃষ্ট করেছিল।

 

হৃদয়ের সঙ্গেও প্রথম থেকেই ওর একটা সহজ সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ওর ব্যাপারে  কেমন একটা প্রত্যাশা আর অধিকারবোধও হৃদয়ের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। সেটা প্রথম ধাক্কা খেল তুচ্ছ একটা ঘটনায়। সেদিন বিশ্রুত স্কুলে আসেনি। সেদিন জানতে পারল সেদিন ওর জন্মদিন। ক্লাসের অনেকেই সন্ধায় ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত। ওকে কিছুই বলেনি বিশ্রুত।

 

সাঁঝ পরে বলেছিল, তুই সব সময়েই প্রাপ্যের অধিক আশা করিস। তার কারণ মানুষকে নিয়ে তুই প্রাপ্যের অতিরিক্ত ভাবিস। এবং তাকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত দিতে চাস। যাকে তোর ভালো লাগে তার জন্য কোনও কিছুই তোর যথেষ্ট মনে হয় না। একদম নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তুই শান্তি পাস না। এতে একটা সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। যে কোনো সম্পর্কের মাপ ও ওজন বুঝে সেই অনুযায়ী চলা উচিত। কাউকে বঞ্চিত করা যেমন উচিত নয়, তেমনি কারো জন্য অতিরিক্ত কিছু করা বা তার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু আশা করাও উচিত নয়।

হৃদয় জানতে চেয়েছিল আমার কী করা করা উচিত।

সাঁঝ হেসেছিল। তারপর বলেছিল, সত্যিই তুই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। যাকে তোর ভালো লাগবে তার জন্য কিছু করার জন্য তুই উঠে পড়ে লাগবি। আর তুই যত করবি, তার কাছ থকে প্রত্যাশাও তোর তত বেড়ে যাবে। সে কতটা নিতে নিতে পারছে, কীভাবে ব্যাপারটা নিচ্ছে, এসব কিছুই ভাববি না। লোকের ভালো করার এ এক অদ্ভুত রোগ যা তোকে লোকের কাছে শুধু অপ্রিয়ই করে তোলে। মানুষের কাছে প্রিয় হতে গেলে আগে সংযত হতে হবে। সে গুণ তোর নেই। হৃদয়ের ব্যাপারে তুই খুবই অসংযমী। 

হ্যাঁ তুই খুব হৃদয়বান, আর সেই হৃদয়ের অপচয় করতেও তোর জুড়ি নেই। কোনো কিছুই বেশি বেশি ভালো নয়। যার যা প্রাপ্য তাকে সেটুকু দিলে সে খুশি হয়। অতিরিক্ত দিতে বা করতে গেলেই একটা অস্বাভাবিকতা সম্পর্কের ওপরে চেপে বসতে থাকে। হৃদয়ের ব্যবহারও তাই সংযত হওয়াই উচিত। এ তো মানুষের এক দুর্লভ সম্পদ। সেই সম্পদকে ব্যবহার করা উচিত খুব মেপেজুকে, হিসাব করে, মাথা খাটিয়ে। কোথায় ব্যবহার করবি, কতটুকু ব্যবহার করবি, কেন ব্যবহার করবি, সে ব্যাপারে পুরোপুরি সজাগ ও সতর্ক থেকে। তুই যদি তাকে অপ্রয়োজনে খরচ করিস, তবে তা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই আসবে না। লোকে তাকে অতিরিক্ত ভেবে কোনোদিনই তার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে না। বরং ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত বোধ করবে, আর একসময়ে হয়ত সেই ক্লান্তির চেয়েও প্রবল হয়ে উঠবে তাচ্ছিল্য। কারো কাছে বেশী প্রিয় হতে গিয়ে তুই তার মনে তাচ্ছিল্য জাগাবি? সেটা কি তোর প্রাপ্য? যে তোকে বোঝার সে তোর একটা ছোট্ট ইশারাও বুঝবে। তোর নীরবতাকেও অগ্রাহ্য করবে না। তোর জন্য যার মনে জায়গা আছে, তার কাছে নিজেকে অত খুলে খুলে দেখানোর দরকার পড়ে না। অত উদ্যোগ সম্পর্কের পক্ষে খুব ক্ষতিকর। বরং তার জন্যও জায়গা ছেড়ে রাখতে হয়, যাতে সে তার মতো করে সেই জায়গাকে কাজে লাগাতে পারে। তার যা প[আওয়ার সে নিজের উদ্যোগে পাবে। যতটুকু তার উদ্যোগ, ততটুকুই তার প্রাপ্য। তার হয়ে তুই কেন উদ্যোগী হবি? নিজেকে বিলিয়ে দিবি? তোর উদ্যোগের মধ্যে তার পাওয়ার সার্থকতা কোথায়? এসব ঘটে কারণ তোর আবেগ বেশি সেই আবেগকে প্রশ্রয়ও দিস খুব বেশি। নিজেকে তোর আরো বেশি শাসন করা উচিত।

একটু থেমে সে যোগ করেছিল, হয়ত আমি নিজে ভুক্তভোগী বলেই এভাবে বলতে পারলাম।

 

একটানা বলে গেছিল সাঁঝ। হয়ত শুধু এই ঘটনাপ্রসঙ্গেই নয়, আরও বহু ঘটনার সূত্রে, যার মধ্য দিয়ে হৃদয়ের স্বভাবের এমন একটা দিক উঠে আসে, যাকে সাঁঝ মন থেকে সমর্থন করতে পারেনি। হৃদয়ের ক্ষতিটাই তার চোখে বড়ো হয়ে উঠেছে। হৃদয় সেদিন বুঝেছিল, তার স্বভাবের এই দুর্বলতার বিরুদ্ধে তার নিজেকেই একটা আত্মরক্ষার কৌশল বের করতে হবে। কিন্তু সেই কৌশলটা কী হতে পারে, সেটা কিছুতেই তার মাথায় আসেনি।

 

বিস্রুত সম্পর্কে হৃদয়ের মনের অভিমান দূর হয়েছিল পরের একটা ঘটনায়। হৃদয় একটা মেলায় ঘুরছিল। আর তখনই একটা ফুলদানির ছবি ওর খুব পছন্দ হয়ে যায়। সেটা নিয়ে দরদাম চলতে থাকে। দোকানদার যা চাইছিল অত টাকা হৃদয়ের কাছে ছিল না। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত রাখে। হৃদয় তাকিয়ে দেখে, বিশ্রুত।

তুই ফুল খুব ভালোবাসিস তাই না? বিশ্রুত জানতে চেয়েছিল।

খুব।

আমিও। বিশ্রুত বলেছিল। তারপর হৃদয়ের সামনেই ওর পছন্দের ছবিটা কিনে নিয়েছিল। আর সেটা উপহার দিয়েছিল হৃদয়কে। হৃদয় কিছুতেই নিতে চায়নি। কিন্তু বিশ্রুত বলেছিল ওটা না নিলে সে খুব দুঃখ পাবে। এ নিছক কোনো উপহার নয়। বন্ধুত্বের দাবিও বটে। এরপর আর হৃদয় না বলতে পারেনি। বন্ধুত্বের দাবিকে সে কখনো প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। বন্ধুকে সে জীবনের অমূল্য সম্পদ বলেই মনে করে।

বহু পরে হৃদয় অবশ্য জানতে পেরেছিল, সেই ছবিটা কিনতে গিয়ে সেদিন বিশ্রুত নিজের জমানো টাকার প্রায় সবটাই খরচ করে ফেলেছিল।

এই ঘটনা বিশ্রুত সম্পর্কে হৃদয়ের মনোভাব বদলে দিয়েছিল। হৃদয় একদিন ওকে বলেছিল, ওরা যে ফুলের বাগান করছে, সেই কাজে বিশ্রুত যোগ দিতে চায় কি না। বিশ্রুত সানন্দে রাজি হয়ে গেছিল। কয়েকদিন ও খুব আসা যাওয়াও করল। কিন্তু সে মাত্র কয়েকদিনই। তারপরেই ছন্দপতন ঘটল। হঠাৎ বিশ্রুত আসা বন্ধ করে দিল।

 

কিন্তু শুধু এইটুকু হলে বলার কিছু ছিল না। হৃদয়ের মনে হল বিশ্রুত যেন ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। আর এতেই সে খুব অবাক হল। ফুল নিয়ে বিশ্রুতর উৎসাহ একদম খাঁটি বলে মনে হয়েছিল তার। আর এখন সে যে শুধু এড়িয়ে যাচ্ছে তাই নয়, একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছে। সেগুলো সবই বুঝতে পারছে হৃদয়। ধরতেও পারছে। কিছু কিছু প্রমাণও পাচ্ছে। আর এটাই তাকে আরো বেশী করে ভাবাচ্ছে। মিথ্যে কথা কেন বলছে বিশ্রুত?

আগ্নেয় একদিন হৃদয়কে বলল, গোটা ব্যাপারপ্টাই আমার কাছে খুব সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।

হৃদয়ও দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল, কিন্তু কেন ও অমন করল?

সেটা তো আমিও ভাবছি।

আর এত মিথ্যাই বা বলছে কেন? এটা কিন্তু সবাই পারবে না। তার মানে মিথ্যা বলার অভ্যাস ওর আছে। কিন্তু ওকে দেখলে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হয়। একটা আস্থা জাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। ভরসা জাগে। ওর দিকে তাকিয়ে বরাবর আমি এমন একজন মানুষকে দেখতে পেয়েছি, যার হৃদয় মনুষ্যত্বের দুর্লভ সম্পদে ভরা। আর সে কারণেই ওর আচরণ আমার কাছে এত রহস্যময় মনে হচ্ছে। সেই আচরণের সঙ্গে আমি ওকে যেভাবে অনুভব করেছি, তার কোনো মিলই আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

 

(ক্রমশঃ) 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন