সমকালীন ছোটগল্প |
কী যে হল, কেন হল!
আপাদমস্তক
অনুশোচনায় জ্বলতে জ্বলতেই মানসিক হাসপাতাল থেকে ফিরছিল সায়ন। পথশিশুদের আবাসনে নিজ
থেকেই একটা কাজ নিয়েছে সে, সেখান থেকে রোজই বাড়ি ফেরার পথে ঐ শান্তিসুধা আবাসনে যায়
সায়ন। একমাসের ওপর হয়ে গেল, তিয়াসীর কোন উন্নতিই চোখে পড়ছে না। গত কয়েক দিনের চলচ্চিত্র
তুমুল ঝাপটায় ওলোটপালট করে দিচ্ছে অতীত আর বর্তমানের ভারসাম্য। চাপা বাষ্পে ঝাপসা চোখ
দুটো কর-কর করছে, কিন্তু পৌরুষের চিরাচরিত
দম্ভ ওর অন্তরের জ্বালাকে চোখের জল দিয়ে বেঁধে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে
- হেরে যাওয়া যুদ্ধ। কী হল, কেন হল, কী করে হল - ঘুরে ফিরে সীমাহীন অন্ধকার মনটাকে
কচলিয়ে দিচ্ছে। ওর মুখের হাসিটা কী করে ভুল করলাম, ওর সাত বছরের নিয়মে বাঁধা সংযত জীবনের
না বলা কথাটা কেন বুঝতে পারলাম না?
অভিমন্যু
শান্তস্বভাবের বাধ্যছেলে। স্কুলে পরীক্ষাতে বরাবরই ওপরের দশের মধ্যেই থাকে। আর আঁকাটা
ওর প্যাশন, দুরন্ত গভীর আসক্তি - স্কেচ অস্বাভাবিক ভাল আঁকে। তিয়াসী ওকে একটু বেশী
আশকারা দিত, বাক্যহীন ছিল বলেই বোধহয়! জন্ম থেকে দেবী সরস্বতী ওর বাকযন্ত্রটাকে অকেজো
করে দিয়েছেন, তাই বোধহয় অভিমান, আত্মসম্মান আর কোন কোন ব্যাপারে একগুঁয়েমিটা প্রকট
হয়ে উঠতো মাঝে মাঝে ছোট্ট অভির। সায়নের অনেকবার খটাখটি লেগেছে তিয়াসীর সঙ্গে এ নিয়ে
- অনেক সময় সায়নের অফিসের দরকারী কাগজ ওর ঝাঁপি থেকে এস্কিমোদের বরফঢাকা দেশের প্রতিচ্ছবি
নিয়ে বেরিয়েছে। তবু সায়নের অনভিপ্রেত অতিরিক্ত কাঠিন্যে এসব ছোটখাটো অশান্তি সংসারে
কোন ছাপ ফেলতে পারেনি, মা ছেলের অস্বস্তি সত্ত্বেও। পরিমান মত প্রশ্রয় অবশ্য সায়নও
কখনো কখনও দিত ওর বালকসুলভ আবদারগুলোতে। কিন্তু,
সে বরাবরই ছিল অফিস-অন্ত প্রাণ - সবসময়েই ইঁদুর দৌড়ে সবার আগে থাকার উন্মুখ প্রচেষ্টা।
দিনগুলো
কাটছিল ভালোই - সায়নের অফিস কনফারেন্স, মিটিং, তিয়াসীর দক্ষ গৃহস্হালী, ফুলের বাগান,
মোবাইল ফোন আর অভির পড়াশোনা, ওকে সঙ্গ দেওয়া, সখ্যতা, উৎসাহ আর আবদার মেটানোর মোটামুটি
সরল পাটিগণিতের নির্বন্ধ অনুযায়ী।
দিন
চারেক আগে হঠাৎ কাজের মাসী অসুস্হ হয়ে পড়ল। প্রথম দু’তিন দিন পাশের বাড়ির এক মেয়েকে
অস্হায়ী কাজে লাগানো হল। কিন্তু তারপর থেকেই বিপদে পড়ে গেল তিয়াসী। ভ্যাকুয়াম দিয়ে,
পাওয়ার মপিং করে ঘরবাড়ি চালাবার মত রাখা যায়, খাওয়াটাও হোম ডেলিভারি বা জোমাটোর দৌলতে
পার করে দেওয়া যায়, কিন্তু কাপড় চোপড় ধোওয়া, ছাতে শুকোতে দেওয়া, তুলে আনা? এখন আবার
আষাঢ় শ্রাবণের ভরা বাদল, কলকাতার বাড়িগুলিতে এমনিতেই সূর্যের আলো প্রায় নিষিদ্ধ আশেপাশের
বহুতল কাঠামোর দৌলতে। তার ওপর দূষিত আবহাওয়ায় আর বাঁজা গাছের এবড়ো খেবডো ছায়াতে সবসময়েই
কলকাতার কলুষিত হাওয়া দুর্বল, স্যাঁতসেতে, শক্তিহীন। একটা রুমাল শুকোতেও দুদিন লেগে
যাচ্ছে। স্যূট জ্যাকেটের নীচে সায়নের পরিধেয় বা গৃহবধু তিয়াসীর ঘরোয়া সাজপোষাকের অসুবিধা
হবার কথা নয়। কেবল অভির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চোস্ত পাট করা ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম পরে
যাওয়াটা অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে এবং তারজন্য শঙ্কিত অভি চরম সন্ত্রস্ত এবং একই সঙ্গে বিরক্ত।
পাখা আর হেয়ার ড্রায়ার চালিয়ে কত সামলানো যায়? বৃষ্টিটা যখন ধরে, বাইরে তারে কাপড়গুলো
ঝুলিয়ে কিচেনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তেলে বেগুনভাজার আওয়াজে পাশের গ্যারেজের টিনের ছাতে
বৃষ্টিফোঁটার চড়বড়ানি শব্দ শুরু হয়ে যায়। গ্যাস না কমিয়েই দৌড়, ফলাফল প্রচন্ড ধূমউদ্গিরণ
এবং কড়াই-এর ভেতরে কিছু অনাহূত নিকষকালো কয়লা পিন্ডের সমারোহ। জামাকাপড় শুকাবে কখন?
এসব নিয়েই আলোচনা চলছিলই, স্কুলের জামা কেনা, কাপড় কাচার মেশিন অর্ডার দেওয়া না পাশের লন্ড্রির সঙ্গে মাসকাবারী বন্দোবস্ত। এর মধ্যে সবসমযেই অভির অসহায়, হতাশ, বিরক্ত অভিব্যক্তি দুজনকেই একটু অসুবিধায় ঠেলেছে। অভিমন্যু যে তাদের পালিত এবং তার নিজেদের ছেলের মত সব আবদার যে মানা আবশ্যিক নয়, তুমুল অশান্তির ভয়ে সায়ন সেটা উচ্চারণই করতে পারে না। নিজেদের অসম্পূর্ণতা ঢাকার জন্যেই যে তাকে এই সংসারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেটা তো অভি জানে না, তার মায়েরও কখনই মনে পড়ে না।
হঠাৎ
সায়নের অফিসে বিদেশ থেকে কর্তাব্যক্তিরা এসে পৌঁছেছেন মিলিয়ন ডলার অর্ডারের বোঝাপড়া
করতে। তিন চারদিন ধরে সায়ন ধরা ছোঁয়ার বাইরে, বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে নটা দশটা, এসেও
মোবাইল আর ল্যাপটপ অক্টোপাসের মত আঁকডে থাকে সে। বিরাট বড় একটা কন্ট্র্যাক্ট, জার্মানীর
সঙ্গে দর কষাকষির শেষ পর্যায়ে। সিইও বলে দিয়েছেন এটা কোম্পানীর তো বটেই সায়নেরও মরণ
বাঁচন সমস্যা, টিকে থাকার লড়াই - কাজটা না
পেলে চলতি গিলোটিনটা উঁচু নিচু মানতে বাধ্য থাকবে না।
তিয়াসী
দুর্ভোগটা ভালভাবেই টের পাচ্ছে, শত অসুবিধায় পড়লেও কোন সাংসারিক সমস্যায় সায়নকে জড়াতে
চাইছে না। কিন্তু স্কুলের কথা ভেবেই, ওয়াশিং মেশিনের কথাটা তুলতেই হল, ছেলেকে সঙ্গে
নিয়েই - ওরই তো বড় সমস্যা। সায়ন অবশ্য অভির চোখে তার নীরব অনুরোধ ছাপিয়ে ঐ একগুঁয়ে
চাহিদার ভাবটাই কেবল পড়তে পারল, অসহায় মিনতিটা
নয়। খিটখিটে রাগটা তখনকার মত কোনমতে সামলিয়ে সায়ন ল্যাপটপে চলতি স্কিনটা ছেড়ে দিয়ে
আমাজনের লোভনীয় সম্ভারের মধ্যে ওয়াশিং মেশিনের সমাবেশে মন দিল বাধ্য হয়েই, অনিচ্ছাসত্বেও।
“আমার
ক্রেডিট কার্ডটা দাও তো” - মুখে একরাশ বিরক্তি।
শঙ্কিত
তিয়াসী বলে উঠলো, “এত তাড়াহুড়ো করছো কে? সন্ধ্যেবেলা ঠান্ডামাথায় আমরা দেখেশুনে একটা
ঠিক করে নেবো। আর পাড়ার দোকানটাতে গেলেও স্যাম্পল দেখে…
“যা
বলছি করো, কার্ডগুলো দাও, অবাধ্য ছেলেটা জ্বালিয়ে খেলো একেবারে!”
জানা
কথা, এর পরে আর কোন কথা হবার নয় - অনলাইন অর্ডার হয়ে গেল, পরশু ডেলিভারী! পুরনোটা ওরা
নামমাত্র দামে নিয়ে যাবে। অভির বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আর মায়ের সঙ্গে ওর চোখের ভাষায়
আদান প্রদান সায়নের চোখেই পড়ল না - সে আবার
ডুবে গেলো ওর সংখ্যা আর কন্ট্রাক্ট-এর অবোধ্য কচকচানির মধ্যে।
ক’দিন ধরে সায়নের খাওয়া পরার সময় নেই, বেশীরভাগই ল্যাপটপ, কনফারেন্স কল। ফোনে অবিরাম কথাবার্তা চলছে। কোন কথা বলতে গেলেই ঝাঁঝিয়ে উঠছে, “যা পারো করো না, সবসময়েই আমাকে বলে দিতে হবে কেন?” অথবা - “ছেলেকে সামলাতে পারছ না? ভিডিও গেম, রক মিউজিক, কার্টুন সব নিয়ে বাড়িটাকে পানের দোকান করে ফেলছে। এত লাই দাও কেন বুঝি না – ডিসগাস্টিং!” কালই মেশিনটা আসবে, কিন্তু এসবের মধ্যে ওটা কোথায় রাখা হবে, কোন টাকাপয়সা দিতে হবে কি না, নতুন করে জলের লাইন করাতে হবে কি না, এসব কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসই হল না তিয়াসীর।
মেশিনটা আসবে আজ, সায়ন সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে, মুখে অনিশ্চিত ফলাফলের গাঢ় মেঘ। কোথাও একটা গোলমালের আশঙ্কা করছে বোধহয় শেষমুহূর্তে। এই কাজটার ওপরে সায়নের তো বটেই, কোম্পানিরও ভবিষ্যত - সি ই ও কথাটা বেশ ভাল করেই ঝালাই করিয়ে দিয়েছেন। এবং পুরো দায়িত্ব সায়নের, ভাল-মন্দ ফলাফলেরও। তাই সারাদিন ফোন করে বিরক্ত করা কোনমতেই নয় - আগুন লাগলে দমকল আছে, মারাত্মক অসুখ হলে পাড়া পড়শী, এ্যামবুলেন্স আছে। ফিরতে রাত হতে পারে, কাজটা পেলে সাহেবদের নিয়ে একটা পার্টি তো অবশ্যম্ভাবী।
ওয়াশিং মেশিন এলো বিকেল পাঁচটা নাগাদ, ওরাই পুরনো কানেকশন দিয়ে মেশিনটা চালু করে দেখিয়ে দিল। গ্যারান্টি ওয়ারেন্টির কাগজপত্র, ম্যানুয়াল, হেল্পলাইন সব বুঝিয়ে দুটো তোয়ালে, রান্নাঘরের ঝাড়ন কেচে শুকনো করে দিয়ে চলে গেল। খুবই সোজা ব্যাপারটা। অভি সারাক্ষণ ওদের সঙ্গে থেকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মন দিয়ে দেখে গেল - মাকে তো সাহায্য করতে হবেই জানে সে। যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিকস এসবের ব্যাপারে মা একেবারেই হাত দিতে চায় না। সোশিয়াল মিডিয়া, ইন্টারনেট এসবের উপকারিতা মাকে বোঝাতে পারেনি আজ পর্যন্ত। মেকানিকদের কাজের মধ্যে অনিশ্চিত মাথা নাড়া আর মাঝে মধ্যে অভির দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসিটা ওর ধারণা আরও পাকাপোক্ত করেছে। অভি কিন্তু পুরো ব্যাপারটা মা’র মোবাইলে ভিডিও করে নিয়েছে। বাবাকে আসলে দেখাতে হবে তো - খুশী হবে, এমনিতে তো ওর কোন কাজেই দাম দেয় না। একে আনকোরা নতুন একটা যন্ত্র, তার ওপর মাত্র দু ঘন্টায় কাপড় কেচে শুকিয়ে দেবে, খটখটে রোদের জন্যে খোশামোদও করতে হবে না। নোংরা কোঁচকানো ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আর এখন মাথা নিচু করে সহপাঠিদের হাসির পাত্র হতে হবে না।
বাবাকে
অবাক করার উদ্দেশ্যেই নানারকমের কার্টুন স্টিকার আর ভ্যানিশিং কালি দিয়ে, লেখালেখি
করে রংচঙে করে তুলল নতুন খেলাটা। একটা আনন্দবার্তা দিয়ে যন্ত্রটার একটা ছবি তুলেও মেসেন্জারে
পাঠালো বাবাকে।
সারাদিনই
মিটিং, হিসেবের কুটকচালি, গ্র্যাফিক্স, চার্টের ওঠানামা, তার মধ্যে হঠাৎই চোখে পড়ে
গেল ঐ নতুন ওয়াশিং মেশিনের রংচঙে ছবিটা। এটা কি রং তুলির কারসাজি ফলানো হয়েছে? নিশ্চয়ই
মায়ের প্রশ্রয়ে, সম্মতি নিয়েই। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো, ছেলেটাকে শায়েস্তা করতেই
হবে আজ, আজকেই। মা যে ঐ ছেলেটাকে লাই দিয়ে কি পরিমান অপদার্থ করে তুলেছে, বাড়ি ফিরে
তার হিসেব হবে। এই মুহূর্তে এই বিজবিজে রাগটাই সায়নের মাথায় ধিকধিক করে কয়লা জ্বালাচ্ছে।
বাড়ি
ফিরল তখন দশটা ছুঁই ছুঁই - ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা, টাই-এর নট খোলা, অগোছাল বডিফিটিং
শার্ট, শুকনো মুখে পরাজয়ের গ্লানি। হতাশ চোখের কিনারায় লালচে রঙে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
হাতে কুঁচকিয়ে ধরা জ্যাকেট আর ল্যাপটপটা নিয়ে টলতে টলতে ঢুকলো সায়ন।
কন্ট্র্যাকটা
হাতছাড়া হয়ে গেছে। এবং তার জন্যে একমাত্র সায়নই দায়ী। হিসেবে সামান্য কিন্তু মারাত্মক
একটা ভুল আর আইনী মারপ্যাঁচের একটা বিপজ্জনক শব্দ, তাড়াহুড়োতে, অন্যমনস্ক হয়ে বাতিল
না করে গ্রহণযোগ্য করে নেওয়া। সামনে এখন শুকনো মরুভূমি অনন্ত বিষাদে হা হা করে হাতছানি
দিচ্ছে - নেই একফোঁটা শান্তির ছায়া।
“উফ্,
কি করে এই ব্লান্ডারটা করলাম - কি করে, কি করে?” টলটলে পায়ে, মাথায় অসংযত চিন্তার জট,
নিজের ওপর অসহিষ্ণু রাগের প্রচন্ড উত্তাপ আর সারা সংসারের ওপর অসহ্য বিরক্তি নিয়ে যখন
সে ঘরে ঢুকলো, তখন অভি খাবার টেবিলে। ওখান থেকেই মুখভর্তি খাবারের মধ্যে দিয়ে ওকে একটা
ধন্যবাদসূচক সরল হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। বাঁ হাতের তর্জনী নতুন যন্ত্রটার দিকে
প্রসারিত, আনন্দের ঢেউএ আন্দোলিত। সেলোটেপ, কাঁচি, রঙীন ফিতের বান্ডিল, আর্ট পেপার,
কার্টুনের প্যাক, মার্কার পেন সব তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেঝেতে। তিয়াসী তখন সায়নের হিংস্র
মুখ আর বিপজ্জনক চাহনি দেখে দরজার হাতল ধরে অশনির সংকেতে প্রস্তরিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে।
তার দুই চোখে একই সাথে উদ্বেলিত সান্ত্বনা
আর গাঢ় শঙ্কার ছায়া ওঠানামা করছে।
সায়নের
মাথায় এ্যাড্রিনালিন দাপাদাপি শুরু করেছে ঝঞ্ঝার বেগে। সব সর্বনাশের মূল ঐ অকৃতজ্ঞজ,
অনুভূতিহন, পরগাছা অভির অসহনীয় শিল্পকার্য্, যে ছবিটা মেসেজে দেখার পর থেকেই সায়নের
মন:সংযোগে ক্ষণিকের জন্যে একটু ভাটা পড়ে যায়। এবং সেই সুড়ঙ্গ পথেই এই বিপর্যয়ের প্রবেশ!
সাধারণ সুস্হমস্তিস্কে এটা কোন ন্যায্য কারণ হতেই পারে না, তবু কাউকে দায়ী করতে না
পারলে নিজের আকস্মিক বিফলতার হতাশাটা প্রতিহত করবে কি করে সায়নের মত উচ্চাকাঙ্ক্ষী
মানুষ?
দ্রুতবেগে
এগিয়ে চললো সে - “ওয়াশিং মেশিনটা তোমার ড্রয়িংবোর্ড? বদমাইসীর জায়গা পাওনি? এই আজগুবি
রঙচঙের স্যাম্পল সারাজীবন আমাদের সহ্য করতে হবে কেন?” কৈফিয়ৎ চাই। দারুণ আক্রোশে হয়তো
দুচারটে চড় চাপড়, অজস্র বকুনী, অভির নিজস্ব পরিস্হিতি বা ওর এই সংসারে কি প্রাপ্য
আর কতটা স্বাধীনতা, নিজের মতামত জাহির করা বা জেদ করা নিয়ে কর্কশভাবে ওকে বুঝিয়ে দেওয়া
দরকার। মনের গতি আর শারীরিক ক্ষমতার মধ্যে বাঁধল সংঘর্ষ, একটা গড়ানো পেনের ওপর পা
লেগে হুমডি খেয়ে পড়ে গেল টেবিলটার পাশে। নিজেকে
সামলে নিয়েছিল, কিন্তু শেষমুহূর্তে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে চেয়ারের হাতলটা ধরতে
গিয়েই হাত ফস্কে ল্যাপটপের শক্ত আঘাতটা গিয়ে সপাটে পড়েছিল অভিমন্যুর ঠিক মাথার ওপরে
- একটা ‘ওঁক’ করে শব্দ তুলে মুখ থুবড়ে অভি পড়ে গেল মাটিতে, গল গল করে রক্তস্রাবের
মধ্যেই।
আহত
বাঘিনীর ক্ষিপ্রতায় তিয়াসী ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অভিমন্যুর নিথর দেহের ওপর। ভেজা চোখে তীব্র ঘৃণা আর বিধ্বংসী আগুন।
ঐ একটা মিনিট দু:সহ আতঙ্কের মধ্যে কাটলো সায়নের মাটিতে বসেই, কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে।
উঠে দাঁড়িয়েছে তিয়াসী, খোলা উড়ন্ত চুলের রাশি, দীঘল চোখ জোড়া জল আর কাজলে মাখামাখি,
হাল্কা নীল আঁচল বিস্রস্ত, বিপথগামী - বুকে জড়িয়ে ধরেছে অভির স্তব্ধ দেহ। হা হা করে
কাঁদতে কাঁদতে বাঁ হাতে সায়নের টাই ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এলো মেশিনটার কাছে।
কার্টুনের
ছবি তিয়াসীর হাতের এক ঝটকাতেই উঠে এলো, উডন্ত আঁচলটা গাড়ির ওয়াইপারের মত দ্রুতবেগে
চালাতেই সব আঁকিবুকি অদৃশ্য হয়ে গেল - ভ্যানিশিং কালি দিয়ে সব লেখা।
টাই-এর
নটটা পাগলের মত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হঠাৎই অভির প্রাণহীন দেহটা সায়নের হাতে চাপিয়ে দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল তিয়াসী।
কোন নোংরামি নেই, রং কার্টুনের অস্তিত্বই নেই - কেবল, আয়নাপালিশ ধাতব পাতে বিরাট অক্ষরে
মোটা করে বোধহয় প্রাণের অবরুদ্ধ আবেগ মিশিয়ে লেখা ফুটে উঠলো -
“জাস্ট
ওয়ান্টেড টু টেল ইউ - আই লাভ ইউ পাপা”।
মাথাটা
ঝুঁকে পড়ল সায়নের, ধীরে, অতি ধীরে অভির নরম শরীরটা নিয়ে মেশিনের গায়ে এলিয়ে পড়ল সায়ন।
তিয়াসী
রোজকার মত আশ্রমে দেখা হতে আজও জিজ্ঞেস করেছে - “অভিকে আনলে না?”
বাহ খুব মর্মস্পর্শী লেখাটা.
উত্তরমুছুন