কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

রঞ্জনা ব্যানার্জী

চন্দ্রাবতী অথবা মেয়েটার গল্প


গতকাল থেকেই মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। গতকাল উথালপাথাল বৃষ্টি হয়েছিল।  সকাল থেকেই টানা বৃষ্টি। সারা শহর কোম জলে ডোবা। মোড়ের দোকানগুলো ঝাঁপ  টেনে দিয়েছিল বিকেলের আগেই। বাবারও অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল। বাসে অসম্ভব ভি চারদিক জল থই থই; রাস্তাঘাট একাকার। কন্ডাক্টরকে বলেছিলেন  একটু ধার ঘেষে নামাতে, রাস্তা পেরোতে হয় না তবে, ‘আর রে দাদু নামেন তাড়াতাড়ি’, প্রায় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিল ইতর কন্ডাক্টর হাটুর পরে গোটানো  প্যান্ট, তাও রক্ষা হয়নি। বাসটা নোংরা জলের পিচকিরি ছিটিয়ে চলে গিয়েছিল। খালি  রিকশ’ নেই কোথাও। ড্রেনগুলো জলের তলায় হাপিশ। শহরটায় মেয়রই বদল হয়, জলাবদ্ধতার কোনো কিনারা হয় না। বাবা গজ গজ করছিল; মাও। তবে মা’র  কারণ আলাদা। বাবা নোরা জলের প্রায় পুকুর বানিয়ে দিয়েছেন ঘরে ঢুকেই; মা’র  শুচিবাই কে জানত এই রাত ঘোর কাল রাত হয়ে যাবে সহসাই!

কারেন্ট চলে গিয়েছিল দুম করে। বাবার ফোনে চার্জ দেয়া হলো না। মেয়েটার  মোবাইল তখনও সচল। ছ’টার সময় বাবাকে বলেছিল, দামপাড়ার কাছে রাস্তা ভেসে গেছে; বিশাল জ্যাম। তারপর আর যোগাযোগ নেই। দুঘন্টা অপেক্ষার পরেও আর ফোন এলো না। কারেন্ট ফেরেনি। ফোনের চার্জ এক দাগে, তাও প্রায় আট দশবার  রিং দিলেন বাবা। অন্য প্রান্তে ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে’। এত দেরি তো হওয়ার কথা নয়! রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করছিল ক্রমশঃ। অস্থির বাবা  শেষে কোতওয়ালির মোড়ে ছাতা মাথায় চলে গিয়েছিলেন। হাওয়ার তোড়ে ছাতা উল্টে  যাচ্ছিল বারবার। তাও ভেজা কাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন একা। নীল রঙের ‘ওশান টু ওশান শিপিং কোম্পানী’ লেখা অফিসের সাদা মাইক্রোবাসটা আসেনি; মেয়েটাও ফেরেনি।  

মেয়েটার দুই সহকর্মীকে ফোন করা হয়েছিল। তাদের একজন তরফদার সাহেব; ঝড় ভেঙ্গে বাড়ি এসেছিল। মেয়েটার পরেও তিন জনকে নামায় ড্রাইভারজানা গেল মেয়েটা সাতটার দিকেই নেমেছিল কোতওয়ালির মোড়ে। তবে? অতঃপর ঘড়ির কাটা একটা পেরোলে মায়ের চাপা কান্নার আওয়াজ দেয়াল পেরিয়ে পাশের মুন্সি মিয়ার  বউয়ের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। এসেছিলেন অন্য ভাড়াটেরাও।

ওরা এসেছিল কোনো কারণ ছাড়া, যেমন প্রায়ই আসে। ওরা তিনজন; শিল্পী, কবি  এবং ওদের অপেক্ষাকৃত তরুণ বন্ধুটি, যাকে ওরা আড়ালে ‘সওদাগর পুত্র’ বলে ডাকে। তিনজনের মধ্যে সেই-ই স্বচ্ছল। ওর বাবা স্টেশন রোডের ‘বিসমিল্লাহ হোটেল’এর মালিক। দরজা খোলাই ছিল। বারান্দাটার দু’পা ওধারে বসার ঘর। এ বাড়িতে এলে ওরা এই ঘরেই বসে। কিন্তু আজ ঘর ভরতি লোকজন। ওদের বসানো  হলো মেয়েটার ঘরে। মেয়েটার খাটে। এ'ঘরে ওরা আগে আসেনি কখনও। ঘরে পা  দিয়েই ওদের নজর চলে গেল জানালাটায়; একই সাথে! কী বৃত্তান্ত বুঝতে সময় লেগেছিল খানিকটা। বিছানায় ফুল তোলা চাদর। আহা! একদিন আগেও ঠিক এইখানে গা এলিয়ে শুয়েছিল মেয়েটা!
      
ওরা তিনজন কাল আলাদা করে মেয়েটাকে নিয়ে ভেবেছিল। তিনজনই ভেবেছিল অন্য দু’জনকে না জানিয়ে বাস-স্টপে আসবে, একা।  রিকশ’ ভাড়া বাঁচাতে মেয়েটা হেঁটেই বাড়ি ফেরে। ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলে দেবে কথাটা। কিন্তু শেষমেশ ভাঙ্গা  আকাশ আর জলে ডোবা শহরটা বাড়িতেই আটকে রেখেছিল ওদের। আশ্চর্য! ওরা তিনজনই গত রাতে মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখেছিল। 
   
তিন চার দিন আগে, বিকেলে ওরা মেয়েটার বাড়ি এসেছিল। মেয়েটার বাবা বেশ  খুশি খুশি গলায় জানিয়েছিলেন, একটা ভাল পাত্রের খোঁজ মিলেছে অবশেষে! মেয়েটা  চা দিয়ে গিয়েছিল, সাথে মুড়িমাখা। ঠিক তখনই ওর বেরসিক বাবা পাত্রের খবরটা জানালেন তিনজনেরই হাত উঠে গিয়েছিল বুকের বাঁপাশে, অজান্তে। মেয়েটা মুড়ি ভরতি বাটিটা রেখে তড়িঘড়ি চলে গেল ভেতরে। মুড়িমাখা থেকে কাঁচা সর্ষের তেলের ম’ ম’ গন্ধ বেরোচ্ছিল। রাজনীতি কিংবা ক্রিকেট কিছুই জমেনি আর। ‘আজ আসি, কাজ আছে,’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিল ওরা। রাস্তায় নেমেই প্রতিদিনের মতো চোখ চলে গিয়েছিল দোতলার রাস্তামুখি জানালায়। ছয় মাসে এই প্রথম কাঙ্ক্ষিত ‘সে’ দাঁড়িয়ে  ওখানে! বিষণ্ণতা গ্রাস করেছিল ওদের তিনজনকেই।

বছরখানেক আগে ব্রিজঘাট থেকে ফিরছিল তিনজন। ঢাকার এক নামী প্রকাশক কবির বই ছাপাতে রাজী হয়েছেআকাশে সেদিন ঝকঝকে কাঁসার থালার মতো চাঁদ।  বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলে ভরপেট খেয়ে ব্রিজঘাটের দিকে গিয়েছিল ওরা। চাঁদকে নিয়ে কবির অসংখ্য কবিতা। কবির উচ্চারণ বড্ড বাজে, তাও সেদিন অন্য দু’জনের খারাপ  লাগেনি শুনতে। ফেরার পথে চোখের সামনেই সেই এক্সিডেন্ট। ভদ্রলোক রিকশ’য় ছিলেন। ট্রাকের ধাক্কায় রিকশ’ দুমড়ে মুচড়ে গেলেও ভদ্রলোক বা রিকশওয়ালা ভাগ্যগুণে অল্প চোটে রক্ষা পেয়েছিলেনভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বেশ।  ডায়াবেটিক  রোগী, কুল কুল ঘামছিলেন। 
  
ঠিকানা জেনে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল ওরা। বাড়ি কাছেই। দরজা খুলে দিয়েছিল শ্যামলা রূপসী প্রথম দর্শনেই তিনজনের মনেই হোলি। তারপর কীভাবে যেন এই  বাড়িতে তাদের নিত্য আসা-যাওয়া। খালু আর খালাম্মার পুত্রসম স্নেহ বাড়তি পাওনা। কিন্তু মেয়েটা অধরা হয়ে আড়ালেই রয়ে গেল। চা আর জল খাবারের বাটি রেখেই উধাও হতোনাম ‘সুস্মিতা’, ওরা ডাকত’ ‘চন্দ্রাবতী’। কবির দেয়া নাম।
    
মেয়েটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওরা তিনজন ব্রিজ ঘাটের দিকেই হাঁটতে লাগল চুপচাপ। সেদিন মেয়েটা কেন দাঁড়িয়েছিল জানালায়? 

আজ হাওয়া নেই অথচ আকাশে তারার নহবত। চাঁদটা আজও কাঁসার থালার মতোই গোল; নদীর জলে হাল্কা দোল খাচ্ছে। হু হু করে হাওয়া পাক খায় ওদের বুকে। হঠাৎ সওদাগর পুত্র ডুকরে কেঁদে ঠে। বাকি দুজন চুপ চাপ চাঁদকে দেখে। দেখতেই   থাকে।   


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন