মেয়েখেলা (পর্ব ১)
যখন দিনাজপুর ছেড়ে আমরা
বাবার কর্মসূত্রে শহর বহরমপুর এলাম তখন দাদা শহরের এক নামী স্কুল আর আমি
মর্নিং সেশনের এক গার্লস স্কুলে ভর্তি হলাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার বাইরে যে
সমস্যা ছিল, পোশাকের বিধান। মেয়েদের কিছু কিছু স্কুলে আর্মিদের মতো ডিসিপ্লিন। এমন কি হেড ম্যামের কোনো
কারণে মেজাজ খারাপ থাকলে চুলে লাগানো রিবনের
ফুলের পেটাল কেন আসিমেট্রিক্যাল, তাই নিয়েও অ্যাসেম্বলিতে চুল টানা পড়ত। কিন্তু সেটা মায়ের প্রাপ্য, এইটি তারা জেনেও চালিয়ে
যেত। কোন্ শিক্ষাবিজ্ঞান মা চুল বাঁধলে মেয়ের ডিসিপ্লিন হবার জন্য মার্ক্স দেয়, কে জানে! ব্যাচ ভুললে তো ক্লাস টিচারের হাত থেকে রক্ষা নেই! যেন দেশের পুরো সুরক্ষা ব্যবস্থাই
ভেঙ্গে পড়েছে।
সকালে ড্রেসের সঙ্গে
ম্যাচিং রিবন দিয়ে চুল বেঁধে যাওয়ার জন্য মায়ের বিড়ম্বনাটা সইতে পারা ছিল বেশ
কষ্টকর। তাছাড়া ঘুম চোখে সেটা এতটাই দায়সারা হতো যে, স্কুল চলাকালীন চুল থেকে খসে পড়ত আর ফুল করা রিবন ব্যাগে
ঢুকিয়ে রাখতে হতো। হারিয়ে গেলে মায়ের হাতে থেকে বেরিয়ে আসত কিল, চড়, নানা ভাষার তুবড়ি। শয়তান দিয়ে শুরু, হায় কপাল দিয়ে শেষ। কেননা তাকে আবার ফিতে আনার
জন্য বাবাকে বলতে হতো। তিনি আবার ইমিটেশনের দোকানে মেয়েদের ভিড়ে যেতে বিরক্তি
প্রকাশ করতেন। প্রত্যেকে নিজের অবস্থান থেকে হ্যাবিট বা নেচারে বাঁধা ছিলেন, যা অতিক্রম করা সবার পক্ষেই
দুঃসাধ্য ছিল। ফলে সব দায় ছিল অবলা শিশুর। চুল উড়লেও মাথায় ক্লিপ দেওয়া যেত না, সেটা নাকি ফ্যাশন শো হয়ে
যাবে।
গার্লস স্কুলের কি বজ্র
আঁটুনি ফস্কা গেঁড়ো টাইপ রুলস! পায়ে বেড়ি পড়ানোর দায় সারাজীবন কেমন করে বইতে হয়
আর সেটা কি অবাঞ্ছনীয় ও অবৈজ্ঞানিক, তা বলতে বোর্ড পরীক্ষার পর ছুটে ছিলাম প্রাইমারীর প্রধান
শিক্ষকের কাছে। ভেবেছিলাম প্রণামের সঙ্গে জানিয়ে দেবো, কিন্তু বলা হয়নি, তিনি তার
আগেই গত হয়েছেন জেনে খারাপ লেগেছিল। রুল মেকারদেরও তা ফলো করতে বাধ্য করা অথরিটির বিশেষত শিক্ষা
বিভাগের জানা খুব জরূরী, নিয়মটা ঠিক কোন্ সুরক্ষা দেয়, কেননা জীবনটা রেল বা পি
ডব্লিউ ডিপার্টমেন্ট নয়। শৈশবে মানতে বাধ্য করা সব শৃঙ্খলা্র একটি মৌলিক ভিত্তি থাকা
প্রয়োজন। চুল বাঁধার দক্ষতা বা ক্লিপ ব্যবহার না করার সততার ওপর কোনো সরকারি চাকরি, শৃঙ্খলার ‘আন বান শান’ এমন কি বিবাহের দায় নমনীয় করে তোলার ছিটেফোঁটা নির্ভর করে না। স্কুলের সারাটা অধ্যায় চুল বেঁধে আর শাড়ি পড়ে আর অবাক করা নিয়মের সিঁড়ি ভেঙ্গে যে বিতৃষ্ণা অর্জন
করেছিলাম, সেই সব না করেই দাদা সব দিক থেকেই আমার চেয়ে বেশি সফল ছিল, কেননা দা্দা ছিল মুক্ত। বাবাকে তার জন্য স্কুলে
পাঠাবার আলাদা লেবার দিতে হতো না। শুধু তাই নয়, দাদাদের স্কুলে কেউ টিফিন পর্যন্ত নিয়ে যেত না, তাই
যথারীতি টিফিনের পার্টটাই বাড়িতে উঠে গিয়েছিল।
প্রাইমারি পেরিয়ে অভিজ্ঞতা
আবার অন্যরকম। হাজার বিশ্রী দেওয়াল লিখন। কিন্তু সে নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না টিচারদের বা সেগুলি
শিশুমনে কি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মেটানোর বা কারা লিখছে তা নিয়ে কোনো কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল
না। কিন্তু নির্দেশিকা ছিল, বাথরুম নোংরা করবে না মানে প্যাড ফেলবে না। অথচ তা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না আমাদের। শরীর খারাপ করলেই ধরে নেওয়া
হতো ওইটি সেই ব্যাপার। মেয়েদের বাড়ি চলে যেতে বলা হতো, বাকি নিজেকে নিয়ে বাড়ি পৌছানোর দায়টা সেই মেয়েরই থেকে
যেত। মা আছেন বা যে আছেন বাড়িতে তাকে এইটা বুঝে নিতে হবে, কেননা আখেরে মেয়েটি তার। মেয়েদের যেখানেই পিড়িয়ডস বা
শ্লীলতাহানি বা অন্য যাবতীয় শরীর সংক্রান্ত বিষয়, সেখানে সব সময় এক অদৃশ্য পিরামিড। চূড়ায় ভিক্টিম, নিচে সব দর্শক। শৈশবে বাবা-মা, কৈশোরে বিদ্রোহী বয়ফ্রেন্ড
বা কাপুরুষ বন্ধু, তারপর স্বামী বা তার পরিবার। নারীর পাশে এদেরই সফর ঘুরে ফিরে। এক যোনি আর দুই স্তনের জিম্মি এদের
কাছেই রাখা। এক রক্ষক, শুধু কেয়ার অফ বদলের পালা।
বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়ে এক
অন্যরকম বড় হয়ে ওঠা। প্রায় সকলেই পেয়ার হয়ে গেল। বর্ণের কারণে ঢালাও নির্বাচনের তালিকা
থেকে বাদ বিজোড় রইলাম আমরা। প্রস্তাবই এলো না, তাই বিবেচনার কোনো প্লট
তৈরি হলো না। পথে চলতে চলতেই চৌকস চেহারার মেয়েদের খবর নিতে থাকত বিভিন্ন শিকারী ছেলে। সন্দেশের পায়রা না থাকলেও পাড়ার মেয়ে ছিল ফিট। তারাই শেষে পত্রবাহক হয়ে
উঠত দুই পক্ষের। সুন্দর চেহারার কয়টি মেয়ে ভর্তি হলো কলেজে, তা নিয়ে এক কলরব চলত। সিনিয়ররা দেখতে আসত
সুন্দরীদের। তাদের লাকিগার্ল করার আয়োজন শুরু হয়ে যেত। এই বর্ণ প্রতিযোগিতায় আমরা ছিলাম
ডিসকোয়ালিফাই। তারপর সুন্দরীর সঙ্গী খুঁজে দেবার অভিযান তারাই চালাত। পারলে প্রাক্তন বদ্লে নব্যনিযুক্ত কেউ। সবটাই ছিল প্রো-অ্যাক্টিভ পুরুষদের কাঁধে। মেয়েবন্ধু নির্বাচনে তারা
মেপেজুখে ভালো ‘মাল’টাই সংগ্রহ করত। বাদ থাকলে কলেজের বটতলায় আওয়াজ উঠত, এই মালটাকে তো দেখিনি! মানে এ বুকড্ হয়নি কেন, আক্ষেপের সঙ্গে প্রচেষ্টার
যৌথ মেলবন্ধন।
মেয়েরা যে আখেরে পুরুষের
মালিকানা বা তাদের গিমিকের শর্তাধীন, তা বুঝতে শুরু করি তখন থেকেই। বেছে নেবার অধিকার তাদের। প্রত্যাখ্যান তারা নিতে
পারে না। মেয়েরা নির্বাচন করতে পারে না। মেয়েদের অনেকেই বলত, না বলতে খারাপ লাগে। তারা নীরবে মেনে নিতো চলতি বয়ফ্রেন্ডের আবদার। তা কলেজের ফাঁকা ঘরে বসা থেকে ভাগীরথীর পাড়ের সান্ধ্য অধিবেশন
পর্যন্ত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমে শরীর না দিলে মেয়েদের ভালোবাসা অপূর্ণ থেকে যেত, যেন আর সেটা পুরুষটি না নিতে পারলে সে অসমর্থ বা অদক্ষ থেকে যেত! যে ভালোবাসি ভালোবাসি খেলা কলেজের মেইন গেট পার করতেই দম হারিয়ে ফেলত, তা নিয়ে কী আবেগের ঝড় আর বাছাই পর্ব! এখন তো হস্টেলে জোরসে বলার
চল লিভ ইন রিলেশনের। তুমি ড্যামি স্বামী বা বউ বদল না করা পর্যন্ত এই
অঙ্গীকারে মেয়ে-ছেলে একসাথে থাকা। শুধু শরীর আর মন লুজার। বাকি সব ঠিকঠাক।
বক্তব্য পরিষ্কার। সমাজ কবে বুঝবে?
উত্তরমুছুনবক্তব্য পরিষ্কার। সমাজ কবে বুঝবে?
উত্তরমুছুনBold ! Hat's off
উত্তরমুছুনSrabani