কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

প্রথম বিশ্বের হাট  


ভারতে তথা পশ্চিমবাংলার একেকটা পাড়ায় ঢুকলে বাড়ির সামনাসামনি ফেলে দেওয়া আসবাব এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের পাহাড় দেখা যায় না। প্রথম বিশ্বের দেশে এই বর্জন স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। বর্জনই তো পুনর্বার গ্রহণের পথ প্রশস্ত করতে পারে। তৃতীয় বিশ্বে বর্জ্যকে বিক্রয়যোগ্য করে তোলা হয়। হতে হয়। আর এখানে, যার নাম প্রথম বিশ্ব, সেথায় সপ্তাহ বা মাসের শেষে বাড়ির বাইরে জিনিস জমা করে রেখে দেওয়া হয়, যাতে যে যার মতো তুলে নিয়ে যায়। বিক্রয় এখানে সংগ্রহ  কিম্বা দানের পথে হাঁটে। এইভাবে একেকটা বাড়ির বাইরে রাস্তার পাশে আরেকটা ছোটখাটো বাড়ি গজিয়ে ওঠে। সেকেন্ড হ্যান্ড বাড়ি। সময় বাড়তে বাড়তে সেই বাড়িতে বাড়-বাড়ন্ত দেখা যায়। সামগ্রী সমগ্র ভেঙে এদিক ওদিক সজাগ সংগ্রাহকের হাতে একাধিক বাড়িতে পাড়ি দেয়। এহেন স্থানীয় সংস্কৃতির দর্শক হয়ে থাকে দেশে-শহরে নতুন আসা পরিব্রাজক। যদি কেউ না নিয়ে যায় রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা বিষয়-আশয়, তবে শেষে সেগুলো সিটি কাউন্সিলের গাড়িতে স্থান পায়। সেই গাড়িই তাদের স্থান থেকে অস্থানে নিয়ে যায়। সাইকল যেখানে রিসাইক্লিং করতে জানে। 

পড়ন্ত বিকেলের আভায় তৃতীয় বিশ্বের এক পর্যটক বৈদেশিক স্বর্ণমূদ্রার খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল প্রথম বিশ্বের অমন এক পাড়ায়। দিনটা ছিল রবিবার। ঘর পরিষ্কা করার  দিন। পর্যটক আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল সেকেন্ড হ্যান্ড বাড়ির আশায়। কোথাও টেবিল চেয়ার, কোথাও ডেস্ক, পাখা, এয়ার-কন, কোথাও আবার তৃতীয় বিশ্বে এখনো পর্যন্ত মোটের ওপর বেমানান বারবিকিউ। একেকটা বাড়ির বাইরে যা যা উপুড় করে দেওয়া হয়েছে তা থেকে তাদের বিত্ত তথা শ্রেণীচরিত্রের একটা আভাস মেলে। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের পর্যটকটি তো শ্রেণীকক্ষে যাবার আগে থেকেই শ্রেণী-সংগ্রামের কথা শুনে এসেছে। মা' কাছে টয়লেট ট্রেনিং নেওয়ার সময় থেকেই সে হোয়াট ইজ টু বি ডান বলত। শেষ বেলার রাঙা আলোয় পর্যটকটি দেখলো একজোড়া লাল-বই রাখা রয়েছে একটি বাড়ির সামনে। পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া দুটো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। অস্তমান সূর্যের লাল আলোয় আরো লাল হয়ে ওঠা বইদুটো তার চোখে বড় মায়াময় ঠেকলো। পর্যটক ছোটবেলায় পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রায় তা পিছনের গাড়ি থেকে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে গাইতে গাইতে গিয়েছিলেন। আর বড়বেলায় দেখেছিল নবারুণ  ভটচাজের শেষযাত্রায় তার গাড়ির পেছন পেছন ঘেউউ ঘেউউ করে ছুটেছিল ছোট বড় নানা সাইজের নেড়ি। প্রথম বিশ্বে নেড়ি মেলা ভার। বরাত থাকলে দুয়েকটা হুলো মিলতে পারে বড়জো 

পর্যটক কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-জোড়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে যখন এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল, তখন সামনের বাড়ির দরজাটা খুলে গেল আর এক মহিলা বেরিয়ে  এলেন। তাঁর হাতে একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা। তিনি পর্যটকের দিকে এগিয়ে আসছেন  দেখে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তিনি এসে লাল বইজোড়ার ওপরে বাচ্চাটাকে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে ফিরে গেলেন। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আশেপাশের একেকটা বাড়ির দরজা খোলার শব্দ কুচকাওয়াজ করে উঠলো। একে একে একেকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে কেউ তাদের বাবা, কেউ মা, কেউ ঠাকুমা, কেউ দাদু, কেউ মেয়ে, আবার কেউ পোষা কুকুর কিম্বা বেড়ালকে রেখে দিয়ে গেল। এইভাবে বাড়ির বাইরের সেকেন্ড হ্যান্ড বাড়িগুলো আস্তে আস্তে মানবিক হয়ে উঠলো। সূর্য তখন প্রায় অস্তে। আমাদের তৃতীয় বিশ্বের পর্যটকের বেড়ানোও প্রায় শেষের পথে। পায়ের কাছের শিশুটি ততক্ষণে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করেছে। দৃষ্টি তার দূর দিগন্তে 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন