কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

মেঘ অদিতি

কথা বা ছবিদের ফোকাস


এখনও মাঠটা আছে। বৈকালিক হাওয়ার বলে নবীন পায়ের ছুটোছুটি আছে। কেবল চাঁদে চরকা কাটা সেই বুড়িটা, সে নেই।

বাড়ি এলে এই মাঠটার পাশে প্রায় বিকেলে যখন এসে দাঁড়াই, টের পাই পুরনো জায়গার একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে, সাথে থাকে প্রিয় কিছু ছবি। গন্ধ বা প্রিয় ছবি যা কেবল স্মৃতিকথাদের উসকে দেয়, আর এসব সময়ে হঠাৎ মনে অদ্ভুতভাবে উঠে আসে  যা, তা কিছুটা এরকম - আচ্ছা... কথাদের তো বয়স বাড়ে, তাহলে তাদের চোদ্দ  না কি চব্বিশ কতদিন আয়ু? যুগল কথারা কখনও তো দ্বিতীয়া কি তৃতীয়ার চাঁদেও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। আমাদের অরণ্য ভাবত নিলীমাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে। অথচ নিলীমাকে পেয়েও ঠিক একহাজার পঁচানব্বই দিনের মাথায় সে অরণ্য চিরতরে মৌনতার স্যানেটোরিয়াম হয়ে গেল।

এখন এই মাঠের পাশে আমি, হ্যাঁ ঘুরে ফিরে সেই আমিই - সুযোগ পেলে পুরনো ছবি আর কথাদের খোঁজে এসে একলা দাঁড়াই।

মাঠের পুবদিকটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এখন তো সব হাইরাইজ বিল্ডিং। একসময় সোমাদের বাড়ি ছিল ওখানে। বাড়িটাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম বছর দশেক  আগে। ঝুলমাকড়সা আর বুনোলতায় ছেয়ে থাকা এক পরিত্যক্ত বাড়ি। অথচ এ বাড়িটা এক সময় সোমার মায়ের হাতে পড়ে কী পরিচ্ছন্ন আর জৌলুসময় ছিল!  বিকেলে মাঠে খেলা শেষ হবার পর উনিই প্রথম আমাদের ডেকেছিলেন হাতছানি দিয়ে। তারপর থেকে প্রায় সন্ধেতে খেলা শেষের পর প্রথম দিনের ওই মনোহরা পুডিং কি গোলাপজামের লোভ জিভে সরসর করে উঠলে আমি, অরণ্য আর বাবলু সোমাদের বাড়ির গেটের বা দিক ঘেঁষে আলো জ্বলে ওঠা ঘরের দিকে জুলজুল তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের অদৃশ্য লেজ ঘনঘন নাড়িয়ে সোমার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রাণপ চেষ্টায় আমরা যখন জেরবার তখনই হয়তো গেট খুলে অফিস ফেরত সোমার বাবা  বাড়ি ঢুকতেন। রাশভারি ভদ্রলোকের সামনে পড়লে এমনিতেই গলা শুকিয়ে আসত আর সে সময়টায় এক পেট খিদে নিয়ে ছোট হতে হতে আমরা তখন দেয়াল ঘেঁষে  ছায়া হতে শুরু করেছি। অন্ধকার সামান্য গাঢ় হতে শুরু করলে আমরা যে যার বাড়ির পথ ধরতাম।

আমাদের নদীটার নাম বড় অদ্ভুত। বাউলাই কংস আর সোমেশ্বরীর সঙ্গমে জন্ম  তার। তখন আমার কলেজের পাট সবে চুকেছে। নিশির সাথে বন্ধুত্বর ঠিক এক বছর। ‘বাউলাই নামটা কেমন না! শুনলেই মনে হয় ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে কোনো   বাউল গান গাইছে...’ বলে নিশি দাঁতে ঘাস কাটতে কাটতে ফিক করে হেসে ফেলত। হাসলে ওর গজদাঁতটা দেখা যেত। ওই গজদাঁত দেখতে দেখতে ভাবতাম নিশি মেয়েটা বড় ভালো। বড় সরল ও। নামে নিশি অথচ পৃথিবীর অন্ধকারগুলো ও চেনেইনি এখনও আর বিপরীতে আমি... ঢেউয়ের ভেতর লাট খেয়ে চলা অন্ধকারের প্রাণ।  নিশি হাসত কুলকুল। নিশি গাইত গুনগুন। আমার বুকের ভেতর ব্যথার পাড় ভাঙত কেবল। নিশি আমার ব্যথা ছুঁতেও জানত না, কেননা যে মন খারাপ কী তাই জানত না সে কী করে আমার মন খারাপগুলোকে ছোঁবে! কবে যেন পথ আলাদা হলো তাই।

রাত বেড়েছে এখন শুনশান এ মাঠ। অনেক দূরে একটা দুটো সিগারেটের জ্বলে  ওঠা। জমাট অন্ধকারে গা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে আমার। শীতের শেষ দিকটায় খোলা মাঠে হু হু হাওয়া বইছে। গায়ে তেমন কিছু গরম জামা নেই। গায়ে কাঁপন নিয়েই ঘাসের ওপর শুয়ে থাকি। উত্তর কোণটা ঘেঁষে এখন যেখানে চা কফির ঠেক করেছে, বারো বছর আগে ঠিক এ জায়গাটাতেই বাবলুকে...!, বাবলুকে নিয়ে   তেমন কিছু বলা হলো না। বাবলু আসলে এত মুখচোরা ছিল যে কেবল বলা যায় অনুভাবী মানুষের সংখ্যা এ পৃথিবীতে খুব বেশি কখনই নয়, স্বল্পসংখ্যক সেই মানুষের ভেতর বাবলু একজন যাকে ছোট থেকে দেখে আসছি। অবশ্য আমাদের দেখার খুব সুযোগ ও দিলই বা কবে! ছোটবেলায় তবু একসাথে হৈ হৈ দিন পার করেছি কিন্তু দিন যত সামনে এগোলো ও তত নিজেকে আড়ালে রাখতে শিখল। ততদিনে স্কুলজীবন শেষ। খেলার মাঠে আমি আর অরণ্য, অরণ্য আর আমি, বাবলু কই! সে তখন গড়ে তুলেছে আপন এক জগত। প্রান্তিকদের কাছাকাছি থেকে ওদের জন্য পথে নামছে। আর আমরা দুটিতে যে যার চোখে প্রশ্ন তুলে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুঝে যাচ্ছি, সবারই মনের ভেতর থাকে অজস্র গোপন কুঠুরি যার হদিস বাইরের কেউ কখনও পায় না।

বাবলু খুব ভালো বাঁশি বাজাত। কখনও অনেক রাতে ওর বাঁশির সুর ভেসে আসত আমার এই উত্তর পাড়ার বাড়ি অবধি। আমরা কলেজ ছেড়েছি। সোমা তখন ওই একই কলেজে। বাবলুর সাথে সোমার কিছু ঘটেছিল কি না তা আমরা কেউ জানি না। কলেজ বা ছোট এই শহরের ওদের কেউ একসাথেও দেখিনি কিন্তু যেদিন সোমা  নিখোঁজ হলো সেদিন থেকে বাবলু কেমন ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল, বাঁশিও সেদিন থেকে চুপ। বাউলাই নদী ঘেঁষে মাটিচাপা সোমার হদিস মিলল পনের দিনের মাথায়। চাপ চাপ রক্ত কালচে হয়ে উঠেছে। নগ্ন ধর্ষিত সোমা।

পনেরতম দিনের সন্ধ্যায় বাবলু ঢুকে পড়ল তার ঘরে। বাবলু নামের এক অস্বচ্ছ কাচের সামনে আমি আর অরণ্য দীর্ঘ সময় বসে থেকে থেকে ফিরে এলাম মাঠের ওই পুবদিকে। সোমার বাড়ির সব আলো নিভে গেছে কখন।


ষোলতম দিনশেষে মধ্যরাতে বাবলু জ্বলে উঠেছিল দাউদাউ এ মাঠের উত্তর কোণে..

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন