নিমজ্জন
অদ্ভুত একটা
ব্যাপার। আবার
অদ্ভুতও না।
এরকম আগেও
ঘটেছে। কিন্তু
প্রত্যেকবারই নতুন।
গন্ধটা নতুন, রংটা নতুন, গায়ের ভেতর
যে শিরশিরে
অনুভূতিটা জাগছে
সেটা নতুন।
আবার নতুনও
নয়। দীর্ঘদিন
বাসে যেতে
যেতে নিরানন্দ
যে ক্লান্তিটা
চেপে ধরে
মনে তার
একঘেয়েমি থেকে
বের হতে
পারলে যে রকম
ফুরফুরা লাগে, এ যেন
তেমনই এক
ঝড়ো হাওয়া।
আস্তে আস্তে
নরম চুলে
বিলি কেটে
দিচ্ছে, মুখের
উপর এসে
পড়েছে এলোমেলো
কিছু ছায়া।
রাজহাঁসেরা ডানা
ঝাপটিয়ে পানি
সরাতে শুরু
করলে মোমের
মতো গলে
পড়ে নিস্তেজ
হাসি। কতকাল
দক্ষিণা হাওয়ার
স্রোতে ভেসে
ভেসে উড়িয়েছি
ম্যাজেন্টা ঘুড়ি।
তখনও এরকম
হিম ঝরে
পড়ত উদ্বেলিত
হাওয়ার সাথে।
সেই সব
বহুকাল আগের
কথা। তবু
যেন আনকোরা।
হৈমন্তিক শস্যের
মতো মৌ
মৌ গন্ধ
নিয়ে এসে
দাঁড়ায় শীতের
শেষে।
কখন থেকে যে এমনটা ঘটতে শুরু করল তা ঠিক মনে করতে পারি না। হয়তো কোনো এক সন্ধ্যায়, তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল বাসন্তিক গন্ধ। বুনো নয় বেশ মিষ্টি মাধবীলতার মতো মৃদু গন্ধ। নাটকের শেষ দৃশ্যে অভিনয় করবার জন্য মঞ্চে পৌঁছাতেই সব আলো নিভে গেল। ঘূর্ণির মতো পাক খেতে খেতে কালবৈশাখি উড়িয়ে নিয়ে গেল মঞ্চের উল্টোপাশে। বিপন্ন সেই মুহূর্তে এক টুকরো খড়কুটোর মতো চোখে ভেসে উঠেছিল শান্ত সৌম্য দুটি চোখ। যার নির্লিপ্ততা স্মরণ করবার মতো। হয়তো তখনকার মুহূর্তটা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে আর তার দেখা মিলত না। কখনোই না। তার প্রয়োজনও হয়তো থাকত না। কিন্তু সেই বিক্ষুব্ধ সন্ধ্যায় রিকশাটা চলছিল। মসৃণ বাতাসে বয়ে যাচ্ছিল স্রোতহীন জলকেটে। তারপর বহুদিন সূর্যের রং ছিল কমলা, ঠিক কমলালেবুর মতো। গন্ধটাও হৃদয়গ্রাহী। তোমার নির্বিকার চোখেও দেখা দিয়েছিল উৎসবের রং। দিনগুলো কাটছিল আরবি ঘোড়ায় চেপে বাধা-বন্ধনহীন। কিন্তু কিছুকাল যেতেই মুখ থুবড়ে খানা-খন্দে পড়ল সে ঘোড়া। ঝড়ের রাতে রঙিন আলোটা যেমন আকস্মিক জ্বলে উঠেছিল নিভেও গেল ধুপ করে। অদ্ভুত ঘটনারা যেমন তাক লাগিয়ে দেয়, তেমন নাটকীয় ভঙ্গিতে দ্রুত নেমে গেল মঞ্চের পর্দা। নাটক শুরু হওয়ার প্রারম্ভেই সম্ভাবনাগুলো চুপসে গেল। এটা কি পরিচালকের অতিমাত্রায় সাবধানতা নাকি নির্বুদ্ধিতা বোঝা গেল না ঠিক, বোঝার উপায় ছিল না। হয়তো চরিত্ররা আরও কিছু বলত। তাদের অসহিষ্ণুতা কানা উপচিয়ে পড়ত। নয়তো হিম হয়ে আসতো রাতের বাতাস। স্ক্রিনে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকত ঘটনার অবশেষ। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। অর্জুনের তীর শুধু গেঁথে রইল দ্রৌপদীর স্মৃতিতে।
মিথোজীবী
ঘরটিতে থাকত
তারা দুজন
লোক। শুধু
দুইজন। একজন
যুবক, অন্যজন
বৃদ্ধ। সামাজিক
নিয়মের কোনো
নিগড়ে বাঁধা
ছিল না
তারা। তাদের
খাবারের ভাণ্ড
ছিল পৃথক, পৃথক শয্যা
এবং জীবিকা।
একজন প্রত্যহ
পশ্চিম মুখে
সিজদা দিত
আর অন্যজন
সারাটা সকাল
বুঁদ হয়ে
থাকত নাস্তিক্যবাদে-কোমলগান্ধার কোনোদিন
তাকে স্পর্শ
করেনি। দুইজনের
কথা বলার
ঢঙ এবং
চিন্তার সূত্রমুখ
সমান্তরাল বয়ে
যেত। কেউ
কোনোদিন তাদেরকে
এক পথে
চলতে দেখেনি।
এমনকি তারা
মোড়ের দুটি
ভিন্ন দোকান
হতে ক্রয়
করত প্রতিদিনকার
রসদ, উননের
জ্বালানি।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষেও
তাদের দেখা
গিয়েছিল পৃথক
লঙ্গরখানায়। নিশাচর
যুবক কখনো
বৃদ্ধের প্রগাঢ়
ঘুমকে বিনষ্ট
করতে পারেনি; নেশায় চুর
হয়ে শুয়ে
থেকেছে পৃথক
শয্যায়, ক্লান্তিহীন।
তাদের আকর্ষণও
ছিল ভিন্ন
জাতের দুই
নারীর প্রতি।
এমনকি প্রতিদিন
তারা বৈকালিক
আড্ডার জন্য
যেত শহরের
দুই প্রান্তে।
কখনো তাদেরকে
এক পাত্র
হতে চা
পান করতে
দেখা যায়নি।
জ্বরে একজন
যখন হাসপাতালে
শয্যাশায়ী অন্যজন
তখন পান
করে চলত
দেশি লেবেল
আঁটা কঠিন
পানীয়। তবু
কোনোদিন তারা
বৃন্তচ্যুত হয়নি।
দুটি পৃথক
শাখায় ঝুলে
থেকেছে বছরের
পর বছর।
দুটি পৃথক গন্তব্য হতে প্রতিদিন তারা ফিরে এসেছে অভিন্ন ডেরায়। কেউ হয়তো মধ্যাহ্নে অন্যজন গভীর রাতে। কিন্তু কেউ কখনো তাদেরকে এক হতে দেখেনি, পৃথক হতেও নয়।
মিথ
নোনাজল আর
ঝড়ো হাওয়াময়
দক্ষিণের এই
পুরনো শহরের
নাগরিকেরা প্রতিদিন
ঘুম থেকে
জেগে ওঠে
ভয়াবহ সব
দুঃস্বপ্ন দেখে; তাদের চোখেমুখে
আতঙ্ক আর
আধোঘুম আধোজাগরণের
চিহ্ন আঁকা
থাকে। দক্ষিণের
এই পুরনো
শহরটির উৎসকাল
সম্পর্কে বহুশত
গল্পগাথা প্রচলিত
আছে। যা
তারা প্রত্যেকেই
জানে। সেইসব
গল্প একজন
হতে অন্যজনে, এক প্রজন্ম
হতে অন্য
প্রজন্মে বয়ে
চলে নতুন
নতুন ডালপালা
ছড়াতে ছড়াতে।
হায় নিয়তির
লেখন কে
আর খণ্ডাতে
পারে! তারা
সকলেই জানে
সাগরের উত্তাল
জলস্রোত একদিন
অকস্মাৎ তাদের
ডুবিয়ে দেবে; অবশিষ্ট থাকবে
না কিছুই।
তারা সকলেই
এমনকী তাদের
কচিকাঁচা, আধফোটা
দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও
ডুবে যাওয়ার
আশঙ্কায় ভীত, সন্ত্রস্ত। জলঘেরা
দক্ষিণের দ্বীপবাসীরা
ক্রমাগত দিন
গুণতে থাকে।
যে কোনোদিন, হ্যাঁ
যে কোনো ক্ষণে
তারা তলিয়ে
যাবে সাগরের
ফেনিল স্রোতে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন