আমির খুসরো ও সমঝদারির হালহকিকৎ
আমির খুসরো হচ্ছেন হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ‘ব্যাদ’। ত্রয়োদশ শতকের এই তুর্কি অভিজাত মানুষটি উত্তর প্রদেশের এটাহ-তে জন্মগ্রহণ করেন। সুলতানি আমলে (মুঘল নয়) উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে যা কিছু নবকলেবর হয়েছে, তার সব কিছুর জনক হিসেবেই তাঁকে ঘোষণা করা হয়। তা সে তবলা হোক বা সেতার, খেয়াল হোক বা কাওয়ালি, সুফি টপ্পা হোক বা আদি ঠুমরি; সবই এই নব ‘ব্যাদে’ আছে। আমরা হয়তো বীর পূজায় একটু বেশিই নিবেদিত হয়ে পড়ি।
তাঁর সম্বন্ধে দুটি কথা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এক, তিনি এক সত্যিকারের বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন; দুই, মধ্যযুগীয় প্রেমধর্মের পারসিক সংস্করণ, যা ‘সুফি’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ, ভারতবর্ষে প্রচারের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর প্রধানতম অবদান, সামবেদীয় চার তুক প্রার্থনাসঙ্গীত ধ্রুপদের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন লোকধারার সঙ্গীতকে সম্মিলিত করে আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতকে মানুষের হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি প্রেমসঙ্গীতের রূপে পরিবর্তিত করার মধ্যে। ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা’ সুফি দর্শনের এই মূলমন্ত্র আদিযুগে প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন স্তম্ভস্বরূপ।
তিনি আরবী ছিলেন না এবং আরবী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থিত পারসিক সভ্যতার প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে যতটুকু প্রামাণ্য জানা যায়, তাতে দেখা যায়, তিনি ভারতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে যা কিছু শ্রেষ্ঠ পারসিক সঙ্গীতসুধা, তার মেলবন্ধন করার প্রচেষ্টা করেছিলেন। আদিরূপের সেতার এবং রবাব (সারেঙ্গির আদিরূপ) ইরান ও মধ্য এসিয়াতে (যেখানে পারসিক সভ্যতারই একছত্র অধিকার ছিল) খুসরু নিজের সুফি সংগীতের সঙ্গে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। খেয়ালের ক্ষেত্রে শুধু নামটি (‘খেয়াল’) ছাড়া আর কিছুই আরবী নয়।
‘খেয়াল’ বলতে আজ আমরা যা বুঝি, তা অষ্টাদশ শতকে মহম্মদ শাহ রঙ্গিলের পৃষ্ঠপোষকতায় সদারঙ্গ ও অদারঙ্গের কাছ থেকেই আমরা প্রথম শুনতে পেয়েছি। আমির খুসরো যে এদেশে ‘খেয়াল’ শৈলির পথিকৃৎ, এমত একটি বিশ্বাস কারো কারো আছে। কিন্তু তার কোনও প্রামাণ্য দস্তাবেজ নেই। বলা হয়, ভারতীয় সঙ্গীত ধারা প্রতি চার বছরে নবরূপ ধারণ করে। আমির খুসরোর আমল থেকে প্রায় চারশো বছরের ইতিহাসে পাওয়া যায় না, খেয়াল নামে একটা এত মনমোহন সঙ্গীতশৈলী এ দেশে প্রচলিত ছিল। হিন্দুরা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নিতান্ত উদাসীন, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে প্রচুর ইসলামি ইতিহাসকার এসেছেন, তাঁদের রচনাতেও খেয়াল বিষয়ে প্রামাণ্য কিছু পাওয়া যায় না। আকবরের সময় যাঁরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরোধা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গীত বিষয়ে বহু উল্লেখ আছে নানা দস্তাবেজে; কিন্তু তাঁরা বস্তুত কী ধরনের সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তার বিশদ নেই। এর একটাই কারণ হতে পারে যে, শৈলী হিসেবে ধ্রুপদ ও কিছু তরলীকৃত, ধামার, এতটাই স্বীকৃত সঙ্গীত মাধ্যম ছিল যে এর বাইরে যে কোনও মার্জিত সঙ্গীতধারা আদৌ থাকতে পারে, এটাই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই পৃথক করে এ নিয়ে কোনও কলাবন্ত উল্লেখ বা চর্চা করেননি।
তবে ভারতীয় শাস্ত্রীয় অর্থাৎ অশরাফি বা সম্ভ্রান্ত সঙ্গীতে ক্রিয়াশীল ডায়নামিক্সের প্রসঙ্গ যদি আসে, তবে এককভাবে আমির খুসরো অবিসম্বাদী পথিকৃৎ। সঙ্গীত, অন্য সব শিল্পের মতোই এক সমন্বয়ী সাধনা। ‘শুদ্ধ’ সঙ্গীত বলে কোনও প্রপঞ্চ রসিক ব্যক্তির কাছে স্বীকারযোগ্য রসবস্তু হতে পারে না। বিভিন্ন সূত্র থেকে ক্রমান্বয়ে মেলামেশার পুণ্যেই সর্বত্র প্রকৃত সঙ্গীতের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। আমাদের দেশে আমির খুসরো এই সত্যটি যথাসময়ে অনুধাবন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ক্রমাগত প্রয়াসে তাকে প্রয়োগ করার নানা পদ্ধতিও সৃষ্টি করেছিলেন। ধ্রুপদ থেকে ভারতীয় সঙ্গীত ধারাকে খেয়ালের পথ পর্যন্ত নিয়ে আসতে যে সাহস ও উদ্ভাবনী প্রয়াসের ধারা চোখে পড়ে, তার পথিকৃৎ হিসেবে আমরা অবশ্যই আমির খুসরোর কাছে ঋণী। যেহেতু তিনি প্রকৃত অর্থেই ভারতবর্ষের ‘ভূমির সন্তান’ ছিলেন তাই ইসলামি রাজশক্তির সংস্কৃতির জগতে সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ের বীজ বপন করেছিলেন সাফল্যের সঙ্গে এবং তাঁর গুরু নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে মধ্যযুগের ভারতীয় ধর্ম সংস্কৃতির ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজের আজীবন সাধনার সুবাদে।
আমির খুসরো'র আরো একটি অবদান, দেশীয় ভাষায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অস্থি সংস্থানটি নিশ্চিত করা। চিরাচরিত সংস্কৃত বা ফারসি ভাষা ব্যবহার করে যে শ্রোতা ও সময়ের দাবি পূর্ণ করা যাবে না, এই সত্যটিও তিনি উপযুক্ত সময়ে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সুরের ফ্রেজগুলিকে বিবেচ্য রেখে তাদের ভারতীয় রাগরাগিনীর রূপ দেওয়ার জরুরি কাজটাও তিনি শুরু করেছিলেন। পণ্ডিত ভাতখণ্ডের ঠাটভিত্তিক রাগ পর্বীকরণের আদি প্রয়াস তাকে বলা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক, অতি জনপ্রিয় ভৈরবী বা কল্যাণ রাগের ফ্রেজগুলি। ভৈরবী রাগিনীর যে ফ্রেজ, তা পৃথিবীর সমস্ত দেশে নানা রকমের গানের মধ্যে পাওয়া যায়। বিশেষত লোকগানে। আমাদের দেশেও ভৈরবীর উৎস লোকগানের পরম্পরা। কয়েকদিন আগে একটি হাঙ্গেরিয় লোকগান শুনছিলাম, তা নব্বই ভাগ ভৈরবী। ইরানি বা আরবী সঙ্গীতে শুধু ভৈরবী কেন, অনেক ভারতীয় রাগের সমান্তরাল সুর পাওয়া যেতে পারে। এখানে সুরের স্ট্রাকচারটি জরুরি নয়, গানের স্ট্রাকচারটি জরুরি। পারসিক য়মন (বলা হয় আমির খুসরো এটিকে এদেশে নিয়ে এসেছিলেন) আর আমাদের কল্যাণ তো প্রায় পরিপূরক সুর। এ জাতীয় উদাহরণ তো বহু রয়েছে। আমির খুসরো এই সমন্বয়ী ক্রিয়াটির প্রাথমিক পুরোহিতের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রায় সমস্ত বড় ঘরগুলির পূর্বপুরুষ সনাতন ধর্মীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। ডাগরদের থেকে শুরু করে জয়পুরের আল্লাদিয়া খান থেকে সেনী ঘরানা সব্বাই। গোয়ালিয়ারের বড় উস্তাদদের অনেকেরই পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণ ছিলেন। ধ্রুপদগানে শৃঙ্গার রসের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। তার জন্য ধামার ছিল। তাই ধ্রুপদে হিন্দু পুরাণের মোটিফ এত অধিক মাত্রায় পাওয়া যায়। খেয়াল গানের আগে থেকে কব্বালির (কাওয়ালি) প্রচলন ছিল। কব্বালি গান সুফিয়ানা হলেও তার মধ্যে ইসলামি মোটিফ অনেক বেশি থাকতো (আজও থাকে)। সংখ্যাগুরু ঘরানার উস্তাদদের পূর্বপুরুষরা কব্বাল ছিলেন। কিম্বদন্তী অনুযায়ী কব্বালি গানও নাকি আমির খুসরো নামক ‘ব্যাদ’ থেকে এসেছে।
এই আলোচনা আমাদের সেই নির্ণয়েই নিয়ে যায় যেখানে রসগ্রাহিতা বা রসসৃষ্টির জগতে কোনও জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী বিশেষের মৌরসিপট্টা নেই। একমাত্র জাদু, বুঝলোক, যে জানো সন্ধান। সন্ধানটি যে আসলে কী, এবার আমির খুসরোর প্রসঙ্গ থেকে একটু সরে বোঝার সামান্য চেষ্টা করা যাক।
সঙ্গীতের ঔৎকর্ষ সম্বন্ধে শ্রোতাদের ধারণা তৈরি হয় কিছুটা পূর্বাগ্রহ, কিছুটা অভ্যেস আর বাকিটা নিজস্ব বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে। সমঝদারির কোনও ব্যাকরণ হয় না। সমগ্র সন্দর্ভটিই আপেক্ষিক ও ব্যক্তিগত। তবু সিদ্ধ শিল্পীরা এমন কিছু সৃষ্টির উন্মাদনা প্রস্তুত করতে পারেন, যা রসিক শ্রোতাকে শুকনো যুক্তির বেড়া পেরিয়ে মুগ্ধতার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। এই পরিবর্তনটির জন্য কে বা কী দায়ী তা সব সময় বুঝে ওঠা যায় না। শিল্পীর নিবেদন, না শ্রোতার আত্মসমর্পণ, তার সর্বজনগ্রাহ্য কোনও ব্যাখ্যা নেই। হয়তো দুটি কারণই বিভিন্ন মাত্রায় দায়ী। এ বিষয়ে শ্রদ্ধেয় আমজাদ আলি খানের কাছে শুনেছি, তাঁর পিতৃদেব হাফিজ আলি খান বলতেন, রাগরূপ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকলে সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যেও একটা রাগকে ফুটিয়ে তোলা যায়। তিনি নিজেও তাই করতেন। রেকর্ডিং ছাড়াও আসরে বড় জোর পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ অলংকারসহ দরবারি, রাগেশ্রী জাতীয় বড় রাগও পরিবেশন করতে পারতেন। আবদুল করিম খানও নাকি ‘ছোটা খ্যাল’ ছোট করেই গাইতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তবে দঙ্গলবাজির ব্যাপার হলে মুলতানিও আড়াই ঘন্টা গেয়ে আসর মাৎ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। আসলে যাঁরা ঐ সব মাপের শিল্পী তাঁদের কাছে এতরকম গয়না থাকে যে তাঁরা সেসব গুনে কূল পান না। রাগসুন্দরীকে কীভাবে তাঁরা সাজাবেন সে বিষয়ে স্বাধীনতা দিলে তাঁরা আপন মনের মাধুরী মিশায়ে এমনভাবে তাকে অলংকৃত করবেন যাতে গয়নার ভারে সুন্দরীর নিজস্ব সৌন্দর্য যেন ঢাকা না পড়ে যায়। যারা অল্পজ্ঞানী, তারা যা কিছু শিখেছে বা আদৌ শেখেনি, তার সব কিছু আদেখলার মতো পরিবেশন করে শ্রোতাদের চমকে দিতে চায়। এর ফলে পরিবেশনা দীর্ঘ হতে থাকে। এই নাচিজ পাক্কা গানা শুনছে, গত তিরিশ/বত্রিশ বছর। বড় শিল্পীদের পরিবেশিত দীর্ঘ পরিসর রাগ শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে কয়েকবার। নিজের অভিজ্ঞতা হলো বড় মাপের শিল্পীরা যদি সঠিক মেজাজ আর কদরদানির আবহে থাকেন তখন তাঁদের মধ্যে শ্রোতাদের সঙ্গে নিজেকে শোনানোরও একটা ব্যাকুলতা জাগে। ওটাই মণিকাঞ্চনযোগ। একেবারে win-win ব্যাপার। নয়তো শুধু পুনরাবৃত্তি আর চমকে দিয়ে হাততালি কুড়োনোর চেষ্টা।
এই প্রসঙ্গে আবার মনে পড়ছে উস্তাদ আমজাদ আলির একটা আসরের কথা। সন্ধেবেলা তিনি যখন তার বাঁধছিলেন, আমি স্ত্রীকে বললাম, দেখো আমি বোধহয় সুর কানা হয়ে গেছি! কারণ আমার মনে হচ্ছে উনি কাফি জাতীয় কিছু পর্দা লাগাচ্ছেন। সাধারণ শ্রোতাদের আসরের প্রথম রাগের ক্ষেত্রে, য়মনকল্যাণ বা ওই জাতীয় কিছু বেশ ছড়িয়ে বাজাবার মতো রাগের প্রত্যাশা থাকে (কারণ এর আগে ওঁকেই রাগ য়মনকল্যাণ আমি দু’ঘন্টার বেশি সময় ধরে বাজাতে শুনেছি)। জল্পনার শেষ হলো যখন তিনি ঘোষণা করলেন যে তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে কাফি বাজাবেন, যদি শ্রোতারা অনুমতি দেন। শ্রোতারা একটু হতভম্ব। তখন মৃদু হেসে তিনি বললেন, তিনি পুরনো চালের কাফি বাজাবেন যা তাঁর ওয়ালিদ সাহেব তাঁকে দিয়ে গেছেন এবং সেটা একেবারে পাক্কা চাল। হয়তো শ্রোতারা এমনটি কখনও শোনেননি। শ্রোতারা তো রোমাঞ্চিত। পিলু, কাফি, জিলা, গারা লোকে মন খারাপ হলে শোনে, তার ‘পাক্কা চাল’ ব্যাপারটা জানেই না কিছু, তো শুনবে কী? তিনি বাজালেন পুরো পৌনে দু’ঘন্টা একেবার ধ্রুপদী বীণ অঙ্গে, আর রাগ হলো কাফি। জানি না এখানে কেউ সে রকম কিছু শুনেছেন কি না, তবে সে একটা অভিজ্ঞতা। তার পরেই তিনি দেড় ঘন্টা বাজালেন মালকোষ, প্রিয় রাগ, এ পর্যন্ত একটি আমার শোনা শ্রেষ্ঠ মালকোষ। স্বর্গীয় ও রোমাঞ্চকর। এরকম স্মৃতি আরও আছে, তাই এটা বলতে পারি না দীর্ঘ হলেই পৌনঃপুনিক বা চমকাবার চেষ্টা। গোটা ব্যাপারটাই এত subjective যে কোনও কথা বলতে মন চায় না। নসিব হলে ডুবে যাওয়াটাই প্রেয়।
ফর্ম্যাট বদলাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে আবার একশো বছর আগের হিসেবে। সাড়ে তিন মিনিটের ‘যমুনা কি তীর’ ষাট-সত্তর বছর আগের রেকর্ড, কবে অজেয় ভাইরাসের মতো শরীরে ঢুকে গেছে, মৃত্যুতেও পুড়বে না। চলছে... চলবে। অনুষ্ঠান কতক্ষণ চললো সেটা ব্যাপার নয়, ভিতরে কতটা গেল, সেটাই বিবেচ্য।
গুরু বলেছেন, ‘লয়ে নাম, লয়ে জাতি/ পন্ডিতের মাতামাতি/ সে সকল তুলিস নে কানে’... ‘প্রাণ’ শুধু যা ‘প্রাণে’ পায়, তাই দিয়েই শিল্পের সার্থকতা। বহু অল্পপ্রাণ গায়কের শ্রুতি নিয়ে গোঁয়ারতুমি হয়তো শ্রোতাদের কাছে গানের প্রসাদগুণকে অলীক করে তোলে। সেক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায় আকাশপ্রমাণ উস্তাদ/ পন্ডিতেরাও শ্রুতির প্রামাণ্যতা নিয়ে সতত তেমন চিন্তিত নন বা এক কথায় কেয়ার করেন না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেকে যে কোনও সংগীতের ক্ষেত্রে ‘শুদ্ধতাবাদী’ ভাবতে ভালোবাসি। এককথায় বলতে গেলে তা মূর্খতা। রবিবাবুর গানই হোক বা গোয়ালিয়রের খেয়াল, কিছুই অবিমিশ্র ‘শুদ্ধ’ নয়। কিন্তু এই প্রশ্নে কিছু বলারও থাকে। ‘শুদ্ধতা’র মানে যদি প্রায়োগিক হয়, অর্থাৎ আলোচ্য সংগীতটি তার মূলের প্রতি কতটা বিশ্বস্ত, তার বিচারই মুখ্য প্রস্তাব হয়ে ওঠে, তবে দুইখান কথা আছে। ‘শুদ্ধতা’ নিরূপিত হবে, সঙ্গীতের উৎসের প্রতি আনুগত্য থেকে। এই আনুগত্য হবে ‘আত্মিক’ ও নিবিড়। বহিরঙ্গের চমক যেন তার সততায় কালি মাখিয়ে না দেয়। পুনরাবিষ্কার বা পুনর্মূল্যায়ন অবশ্যই হবে, কিন্তু পল্লবগ্রাহিতার ভারে যেন মূলোত্পাটন না হয়ে যায়। শ্রুতি বা এই জাতীয় অলঙ্করণধর্মী সাংগীতিক মাপদন্ড পন্ডিতদের জন্যই তোলা থাক, আমাদের মতো ইতর শ্রোতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও চলে। আমাদের ‘স্বার্থ’ ‘প্রাণের’ সঙ্গে ‘প্রাণ’ মিললো কি না, সেই সূত্রের সঙ্গে জড়িত। উস্তাদ আব্দুল করিমের ভাষায়, ‘সুননে মে মজা আয়া কি নহি...?’ এই প্রশ্নে সংগীতের দুই দেবতা, উস্তাদ বড়ে গুলাম ও উস্তাদ আব্দুল করিম প্রকাশ্যে আমাদের সঙ্গে আছেন আর অপর দেবতা আমির খান আছেন নীরবে।
সমঝদারির যে প্রক্রিয়া, তার মধ্যে তর্ক থাকবে, সন্ধান থাকবে, প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু রসবোধের নিষ্ঠায় যেন কোনও ফাঁকি না থাকে। এতো স্বাভাবিক, যে দীক্ষিত শ্রোতা ও কানসুনি কদ্রদানদের মাপদণ্ডগুলি আলাদা হতে পারে। কিন্তু নিজস্ব অনুভূতির জগতে, আনন্দ আদায় করার পুণ্যে, যেন কোনও আপোস বা অক্ষমতা না থাকে। অক্ষমের ঘৃণা বা ভালোবাসা, দুইই অর্থহীন। সর্বোপরি জীবন একটাই এবং তা বিশেষ দীর্ঘও নয়।
“প্যার ঘজল হ্যাঁয় গুনগুনানে কে লিয়ে,
প্যার নগমা হ্যাঁয় সুনানে কে লিয়ে,
ইয়েহ উয়োহ জজবা হ্যাঁয়, জো সবকো নহি মিলতা,
কিঁউকি হৌঁসলা চাহিয়ে প্যার কো নিভানে কে লিয়ে”। (ঘালিব)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন